আঠেরো বছর অতিক্রম করল, এ নেহাত মুখের কথা নয়। বছরের পর বছর বাঙালির এক দুপুর ‘রোববার’ জুড়ে কখনও ৫২ পাতা কখনও ৪৮ পাতার একটা পত্রিকা , ইদানীং খানিক কম। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর বিশেষ সংখ্যা, মূলত যা গদ্য দিয়ে সাজানো প্রতি রবিবার। ভালো লাগে এখনও একটা বিশেষ নামকরণ থাকবে সবসময় লেফট সাইড নিচে, আর প্রচ্ছদের ঠিক রাইট আপে থাকবে মানানসই রঙের লোগো, যার নাম ‘রোববার’। তবে আঠেরো বছরের এক পাঠক হয়েই বলব, কিছু ইতিহাস যখন বইয়ের পাতায় পড়েছি, তার পাশে যতই বড় হয়েছি, ইতিহাস উপলব্ধি করে উঠতেও দেখেছি। ২০০৫ সালে প্রথম আমার মফসসল ছেড়ে কলকাতার কলেজে বাংলা নিয়ে পড়তে আসা। আর এসে এসেই দৈনিক সংবাদপত্রের এই রাজকীয়ভাবে পথ চলতে নেমে পরার আয়োজন খুব সহজেই পেয়ে ছিলাম।
ঋতুপর্ণ ঘোষ সম্পাদক এবং সহযোগী সম্পাদক অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়। আজ কতটা পথ এগিয়ে এসেছে, ‘রোববার’। বাঙালির রোববার-এর মাংস-ভাত আর দুপুরের বাংলা সিনেমার তথাকথিত রেওয়াজ থেকে বেরিয়ে বাঙালির রবিবার কাটতে থাকল যেন ‘রোববার’-এর পাতায়। সেই ’০৬ থেকে আজ ’২৩ মধ্যে কেটে গেছে কত ইতিহাস আর সময়। এই পত্রিকা বাংলা বা বঙ্গ সাহিত্য সংস্কৃতির অবশ্যই একটা মূল প্রবাহের মতো। ফার্স্ট পার্সন, রোববার লাইব্রেরি খোলা, ভালোবাসার বারান্দা, গোঁসাইবাগান, দেখা না দেখায় মেশা, খোলাখুলি বলছি– একের পর এক ধারাবাহিক শুধুমাত্র আমাদের মতো কতিপয় পাঠকের মন জয় করেনি, সঙ্গে সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতি ও সাহিত্য রুচিতেও অনেকটা বাড়তি অক্সিজেন দিয়েছে। আমার মনে পড়ে, বাংলা ভাষা বা বাংলা সাহিত্য যখন পড়ছি কলেজে, তখন যে শুধুমাত্র কলেজের সিলেবাস পড়ছি, তেমন নয়। বুদ্ধির ছুরিতে যেন প্রলেপ পড়ত সেই সময়। নানা ঘটনার কথা মনে পড়ে, যেমন ট্রেনে বা বাসে যেতে যেতে এমন অনেক লেখা পড়া বাকি থেকে যেত, তখন পড়ে নিতাম। তখন কথায় কথায়, যেখানে-সেখানে কথা বা নানা সাহিত্য আলোচনার কথা উঠলে ‘রোববার’কে এনে হাজির করতাম। রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কত লেখায় কত ইংরেজি বইয়ের বা বাংলা বইয়ের নাম পেলেই, কলেজ স্ট্রিটের দেজের কাউন্টারে খোঁজ করতাম। যদি ওই বইটা হাতে পাই। জয় গোস্বামীর লেখা পড়ার পর থেকেই তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ শুরু। একবার শক্তি চট্টোপাধ্যায় নিয়ে একটি লেখা পড়ে, রাতেই ওঁকে এসএমএস করেছিলাম। তারপর থেকেই তাঁর সঙ্গে মূলত যোগাযোগ বা পরিচয় হয়েছে। একটা পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা ‘রোববার’। এই ‘রোববার’ই দেখিয়ে কত অভিনব ভাবনা, সাহিত্য নিয়ে কত নতুন তাত্ত্বিক গবেষণার দিক।
আমার মনে পড়ে, ফার্স্ট পার্সন যতবার পড়তাম, ততবার মনকেমন করত। এই ভেবে একজন সম্পাদক একটা সাবলীল কথা বলছেন, একটা বিষয়ের ওপর কতবার কতরকমভাবে। তাঁর দেখার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্য দিয়ে এই সমাজ ও সংসারে সব কিছুর ওপর যেন একটা যোগসূত্রের অনুভব আর উপলব্ধিগুলোকে শান্ত নিস্তব্ধতায় অনুভব করা। যে কোনও পরিস্থিতিতে একজন সম্পাদক তাঁর ঘটনার সঙ্গে লেখার একাত্মতা, সেটা হয়তো ঋতুপর্ণ তাঁর নিজের সিনেমার বাইরে এসে তিলে তিলে প্রমাণ করেছেন। তারপর ‘রোববার’-এর লাইব্রেরি খোলাতে যখন এলাম, তখন ভাবতাম এই বিশ্বের কত বই এখনও অজানা। আজ ১৮ বছর পরেও এক এক সময় বন্ধুদের আড্ডায় বা চায়ের দোকানে এখনও বলি বা কখনও সখনও দেখাই লাইন বাই লাইন দাগিয়ে রেখে পড়া। কত বই জেনেছি রঞ্জনবাবুর লেখায়। ‘ভালোবাসার বারান্দা’ যতবার পড়েছি আশা মেটেনি। আর ‘গোঁসাইবাগান’-এ যখন এসে ঢুকলাম তখন তো কবিতার প্রেমে পড়লাম নতুন করে। জয় গোস্বামী অনেক কিছু দিয়েছেন কবিতা দিয়ে, সাহিত্য দিয়ে, কিন্তু তাঁর এই বিরাট একটা কবিতার আত্ম-অনুভূতি সত্যিই আমাদের মতো একটু সাহিত্যপ্রেমী পাঠকের কাছে বিরাট এবং উপরি পাওনায় বটে। ‘দেখা না দেখায় মেশা’য় সুধীরবাবুর লেখা পড়তাম মন্ত্রমুগ্ধের মতো। খোলাখুলি বলেছেন সমরেশ মজুমদারও। এসব পড়তে পড়তেই এক এক করে সব সংকলন ( রোববার লাইব্রেরি খোলা, দেখা না দেখায় মেশা, গোঁসাইবাগান) করে ফেলেছি নেশার মতো। আমাদের কলকাতার স্কট লেনের একটা বাইন্ডিং খানায় জমিয়ে জমিয়ে দিয়ে এসেছি। মাত্র আট টাকার বিনিময়ে পাড়ায় তিন মাসের কখনওবা এক বছরের বাঁধানো সংকলন করেছি। যদিও দে’জ আর প্রতিভাস তিনটে সংকলন করে আমাদের বাংলার পাঠকের হাতে অমূল্য সম্পদ দিয়েছেন।
বাংলা ভাষার সাবলীল গদ্য লেখার যে বিরাট একটা বিক্ষণ কেন্দ্র বা ল্যাবরেটরি, সেখানে তার প্রধান হাতিয়ার আমাদের প্রতিদিনের ‘রোববার’। রাস্তার দরমা দেওয়া চায়ের ঠেক থেকে গ্র্যান্ড হোটেলের এক কাপ চা– এসব কিছুই ‘রোববার’ আমরা উপভোগ করি। আর এইভাবেই নিজের বাড়ির বুক সেলফে আসতে আসতে জায়গা করে নিয়েছে সেন্ট্রাল স্টিচের ৫২ পাতার একটা কথা বলার কাগজ। যেখানে ধারাবাহিক মলাটের পিছনে থাকবে কোনও গয়না পরা অলংকারের বিজ্ঞাপন আর মাঝে মাঝে পতাকা চা অথবা মেডিকা হসপিটাল। আর সাহিত্যে একটু নেশা চলবে না, সেজন্য মেক ডনাল নম্বর ওয়ান সোডা।