রবীন্দ্রনাথ জানেন তাঁর মন স্পর্শকাতর বলেই সেখানে আবেগের অতিরেক দেখা দিতে পারে। যদি দেখা দেয় তাহলে emotionalism তরল ও সরল আকার নেবে। সেই তারল্য কর্মনাশা, বিবেচনাশূন্য। তাই তিনি চান আবেগকে ‘অধঃকৃত’ করতে। এই অনুশীলিত মন ছিল বলেই তো পুত্র-কন্যার অকাল-মৃত্যুর বেদনা সহ্য করতে পেরেছিলেন তিনি। আবেগকে কেবল ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি নয়, দেশ ও সমাজের কাজেও আবেগকে সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে প্রয়োগ করতে হয়।
রবীন্দ্রনাথ কবি, কবিতা লিখতে গেলে অন্তর্গত আবেগের ওপর ভরসা করতে হয়। তাঁর ‘জীবনস্মৃতি’র পাঠক মাত্রেই জানেন তীব্র আবেগের উৎসার থেকেই একদিন লিখেছিলেন ‘নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ’-র মতো কবিতা। তাঁর মনের চোখ সেদিন গিয়েছিল খুলে– কবিতার পঙ্ক্তিগুলি স্বতঃস্ফূর্ত জলধারার মতো মনের পাথর ভেঙে বাইরে এসেছিল। পরিণত রবীন্দ্রনাথ কিন্তু আবেগসর্বস্বতাকে পছন্দ করতেন না। বরং বাঙালির আবেগের অতিরেক তাঁর বিরক্তির কারণ। ১৩৩৪-এর ভাদ্র সংখ্যার ‘প্রবাসী’-তে প্রকাশিত হয়েছিল ‘রবীন্দ্রনাথের সহিত কথোপকথন’। কবির সঙ্গে কথা বলেছিলেন নিবারণচন্দ্র দাশগুপ্ত। কবি তখন শিলং-এ, গরমের ছুটি কাটাচ্ছেন। ১১ জ্যৈষ্ঠ নিবারণচন্দ্রকে রবীন্দ্রনাথ যা বলেছিলেন, তার অংশ বিশেষ লেখাটি থেকে উদ্ধার করা যাক। ‘আমরা যে কতবড় একটা ভাব-প্রবণ জাতি তা আর কি বল্ব। ওর জন্য দায়ী বাংলার মাটি। … আমাদের শুধু emotionalism … পরকীয়া প্রেমের রসাস্বাদনে পর্য্যন্ত। যেমন বাঙালির ধর্ম্মে তেমন কর্ম্মে। সর্ব্বত্রই ঐ ভাব প্রবল (dominating)! আমরা হয় ভেঃ ভেঃ রবে কাঁদ্ব কি মা মা শব্দে আকাশ ফাটাব … এইত ? … এই ভাব-প্রবণতাই আমাদের সেরেছে … কথায়-কাজে-লেখায়-পড়ায়, রচনায়– গদ্যে-পদ্যে সর্ব্বত্রই সেই ভাব-প্রবণতা।’
……………………………………………………………………………………………………………………………………
ছাতিমতলা। পর্ব ১৮: রবীন্দ্রনাথ কখনও গীতাকে যুদ্ধের প্রচারগ্রন্থ হিসেবে বিচার করেননি
……………………………………………………………………………………………………………………………………
ভাবই যে কর্মনাশা এ-কথাটা বাঙালিদের অনেকেই মনে করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। উনিশ শতকে প্রথমে বঙ্কিমচন্দ্র, পরে বিবেকানন্দের লেখায় কর্মনাশা ভাব-প্রবণতার বিরোধিতা চোখে পড়ে। এই ভাব-প্রবণতার কারণ হিসেবে রবীন্দ্রনাথের মতোই বঙ্কিমচন্দ্র মাটির দোষ দিয়েছিলেন। তাঁর সিদ্ধান্ত বঙ্গদেশের মাটি উর্বরা, চাষ সহজে হয়– ফলে গোটা জাতি গৃহসুখভিলাষী, আলস্যপরায়ণ হয়ে উঠল। আর এই গৃহসুখপরায়ণ জাতির উপযুক্ত সাহিত্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল প্রেমের পদাবলি। বিবেকানন্দ উদ্বোধন পত্রে ধারাবাহিক ভাবে লিখেছিলেন ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’। সেখানে বিবেকানন্দ রূঢ় কৌতুকে জানিয়েছিলেন যাঁরা জন্মাবধি পিরিতের কবিতা লেখেন, তাঁদের প্যাক করে সিংহলে পাঠিয়ে দেওয়া উচিত। বঙ্কিমচন্দ্র-বিবেকানন্দের পথেই ১৩৩৪-এ emotionalism-এর বিরোধিতা করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। শুধু তাই নয় এই আবেগকে কীভাবে ধর্মগুরুরা কাজে লাগিয়ে সুবিধে আদায় করে, সে-কথা জানাতেও ভোলেননি। সেই কথোপকথনে জানিয়েছিলেন, ‘‘… ওখান (বিলেত) হ’তে ফিরে, কি ওখানে থেকেই আরো জাঁদরেল অবতার হওয়া যেতো, যদি কৌপীন্-টৌপীন্ পরে সেভাবে চলা যেত। ওদের সার্টিফিকেটের ঢের আদর।’’ বিবেকানন্দ বিদেশ থেকে ফিরে এসে তাঁর গুরুভাইদের দেশের কাজে লেগে যেতে বলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নী সরলার স্মৃতিকথায় তার উল্লেখ আছে। সরলা লিখেছিলেন, ‘গুরু রামকৃষ্ণদেবের নামে উন্মুক্ত মিশনের ধর্ম হল আর্তের, দুঃস্থের, বিপন্নের সেবাকার্য ও অতিথি সৎকার, শুধু ভগবদ্-ধ্যানে ভোঁ হয়ে থাকা আর কলকে টানা নয়।’ বিবেকানন্দ যে ধর্মের নামে অলস-আবেগের চর্চার ঘোরতর বিরোধী, তা তো অজানা নয়। অবশ্য রবীন্দ্রনাথ বনাম বিবেকানন্দ শিবিরপন্থী গবেষকরা মাঝে-মাঝে বলার চেষ্টা করেন বিবেকানন্দ তাঁর ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’ রচনায় যে প্রেমের কবিদের নিয়ে রূঢ় কৌতুক করেছিলেন, তার লক্ষ্য নাকি ঠাকুরবাড়ি আর রবীন্দ্রনাথ। বনামপন্থী গবেষকরা অবশ্য আগু-পিছু বিচার করার মানুষ নন। ‘বিলাতযাত্রীর পত্র’ উদ্বোধন-এ যখন ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল, তার আগেই রবীন্দ্রনাথ দেশের কাজে তাঁর কর্মশক্তি ও বিবেচনা-শক্তির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। তিনি যে আবেগ-বিলাসী কবিমাত্র নন, তা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
……………………………………………………………………………………………………………………………………
ছাতিমতলা। পর্ব ১৭: ক্রিকেটের রাজনীতি ও সমাজনীতি, দু’টি বিষয়েই তৎপর ছিলেন রবীন্দ্রনাথ
……………………………………………………………………………………………………………………………………
রবীন্দ্রনাথ তাঁর নিজের মনের খবর বিশেষ ভাবে দিয়েছিলেন স্নেহভাজন দিলীপকুমার রায়কে। ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৩২ তারিখের চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমার মন স্পর্শকাতর এই তোমার ধারণা। এ ধারণা অসত্য নয়। আমার বেদনা বোধ যদি অপেক্ষাকৃত অসাড় হত তা হলে সুরুতেই কবির কাজে ভর্ত্তি হওয়া চলত না– আমার বেদনাকে যদি অধঃকৃত করতে না পারতুম তা হলেও কবির হার হত। এই দুই বিরুদ্ধতার জন্যেই একদল বিচারক আমার স্বভাবে বেদনাবোধের অভাবই দেখতে পায়। সংরাগ, ইংরেজিতে যাকে passion বলে, আমার স্বভাবে তার স্বল্পতা তারা কল্পনা করে। দুটোই সত্য এবং দুটোই সত্য নয়। কিন্তু এ সমস্ত তর্কের কথা, যে তর্কের চরম নিষ্পত্তি নেই– অন্তর্য্যামীর মহলে কথা কাটাকাটি চলে না।’ রোমান্টিক কবিতা লেখার সময় আবেগকে কীভাবে শমিত করতে হয় তা লিখেছিলেন ওয়ার্ডসওয়ার্থ– ‘লিরিক্যাল ব্যালাডস’-এর ভূমিকায় তার ব্যাখ্যা ছিল। রবীন্দ্রনাথও নিজের মনের চরিত্র ও সেই মনের অনুশীলন দু’য়ের কথা লিখেছিলেন এই চিঠিতে। রবীন্দ্রনাথ জানেন তাঁর মন স্পর্শকাতর বলেই সেখানে আবেগের অতিরেক দেখা দিতে পারে। যদি দেখা দেয় তাহলে emotionalism তরল ও সরল আকার নেবে। সেই তারল্য কর্মনাশা, বিবেচনাশূন্য। তাই তিনি চান আবেগকে ‘অধঃকৃত’ করতে। এই অনুশীলিত মন ছিল বলেই তো পুত্র-কন্যার অকাল-মৃত্যুর বেদনা সহ্য করতে পেরেছিলেন তিনি। আবেগকে কেবল ব্যক্তিগত ক্ষেত্রেই নিয়ন্ত্রণ করা জরুরি নয়, দেশ ও সমাজের কাজেও আবেগকে সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে প্রয়োগ করতে হয়। ‘বঙ্গভঙ্গ’ আন্দোলনের সময় রাজনৈতিক আবেগের দিশাহীনতা লক্ষ করেছিলেন। আবেগের উন্মাদনা গর্জন করে, বর্ষণ করে না। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনে যোগ দিয়ে এই সার-সত্য বুঝতে পেরেছিলেন বলেই গ্রহণ করেছিলেন স্বদেশি-সমাজ গঠনের ব্রত। তাঁর শিক্ষালয়কে কেন্দ্র করে যে গঠনমূলক-স্বদেশির বিস্তার হয়েছিল, তা পল্লি-পুনর্গঠনের সুচারু পরিকল্পনায় স্থিতি লাভ করে। চরমপন্থী বিপ্লবীদের আত্মত্যাগের প্রতি রবীন্দ্রনাথের শ্রদ্ধার অভাব ছিল না তবে আবেগের বশবর্তী হয়ে আত্মত্যাগের নামে এমন অনেক গুপ্তসমিতির গুপ্তপন্থার তাঁরা উদ্ভাবক যা শেষ অবধি দিশাহীন বদ্ধতায় আটকে যায়। আবার এ-কথাও ফেলে দেওয়ার নয় রাজনৈতিক আবেগের পালে হাওয়া দিয়ে ‘ঘরে-বাইরে’ উপন্যাসের সন্দীপের মতো নেতারা তৈরি করে দাঙ্গা পরিস্থিতি। নিজেরা পালায়– তরুণেরা মরে। ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাসেও রাজনৈতিক আবেগসর্বস্বতার সমালোচনা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ছাতিমতলা। পর্ব ১৬: রবীন্দ্রনাথ কি ক্রিয়েটিভ রাইটিং শেখানোর কিংবা কপি এডিটিং করার চাকরি পেতেন?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
খুব সহজ ছিল না এ-সমস্ত কথা বলা ও লেখা। বিশেষ করে আবেগের দিকেই সংখ্যাগুরু জনগণ ঢলে পড়েন। তখন আবেগের বিরুদ্ধে বিবেচনার কথা বলেন যিনি, তিনি সংখ্যাগুরুর ক্রোধের কারণ। সত্য কথা তো সবসময় প্রিয় হয় না। রবীন্দ্রনাথও emotionalism-এর বিরোধিতা করে অপ্রিয় হয়েছিলেন।
একালে অবশ্য সত্য বলা দস্তুর নয়– আবেগের হুজুগেই রাজনীতি-ধর্মনীতি-সমাজনীতি চলছে– চলবে বলেই মনে হচ্ছে।