সমাজ থেকে কি অন্যায়, অত্যাচার, দুঃখ-বেদনা, শোষণ, নির্যাতন উঠে গেল? যদি না ওঠে, তবে সমসাময়িক শিল্প সাহিত্যে তার ছায়া পড়ছে না কেন। ছায়া না পড়া কিন্তু ভূতের লক্ষণ! এমন বাজারে বিপুলের কবিতা পড়ে খানিক থমকেছি। আসল কথা পূর্বসুরি নজরুল, সুকান্ত, সুভাষ (মুখোপাধ্যায়), দীনেশ (দাস), মণীন্দ্র (রায়), বীরেন্দ্র (চট্টোপাধ্যায়)-দের মতো লাল সূর্য ওঠা নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখেন বিপুল চক্রবর্তী।
শিল্প-সাহিত্যের সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকতে নেই? মানুষের জন্য শিল্প না কি শিল্প কেবল শিল্পের জন্য? ‘পোসেনজিতের বই’ মার্কা এই ঘিসাপিটা ডায়লগ মনে পড়ল বিপুল চক্রবর্তীর কাব্যগ্রন্থ ‘হে দেশ হে আমার জননী’ পাঠ করে। তবে কিনা পৃথিবীতে বহু কবি ও শিল্পীর জন্মই হয়েছে অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের তাগিদে। বেশি উদাহরণের প্রয়োজন নেই। দীনবন্ধু মিত্র ব্রিটিশ শাসকদের অত্যাচারের প্রতিবাদে ‘নীলদর্পণ’ নাটক লিখেছিলেন। কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম যৌবনের লেখালিখির একটা বড় অংশ ব্রিটিশবিরোধী প্রতিবাদী কবিতা। ফলে হুলিয়া জারি, গ্রেপ্তারি, হাজতবাস ইত্যাদি। আজকের কাব্য ও সাহিত্যের একটা বড় অংশের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বড় ভাবনা হয়– সমাজটা কি নন্দনকানন হয়ে গেল মাইরি! তাহলে কি ‘তেনারা’ তৃতীয়বার ক্ষমতায় আসার আগেই রামরাজত্ব স্থাপিত হল! সমাজ থেকে কি অন্যায়, অত্যাচার, দুঃখ-বেদনা, শোষণ, নির্যাতন উঠে গেল? যদি না ওঠে, তবে সমসাময়িক শিল্প সাহিত্যে তার ছায়া পড়ছে না কেন। ছায়া না পড়া কিন্তু ভূতের লক্ষণ! সিনেমা-ওয়েব সিরিজ-উপন্য়াসে ঘুরছে ‘মধ্যবিত্ত’ থ্রিলারের ভূত, কবিতায় ঘুরছে সানি লিওনি মার্কা পরকীয়া ভূত অথবা লাইট ফেসবুকের মতো লাইট আধ্যাত্মিকতা ভূত। মোদ্দা কথা, সৃজনশীলতার নিশ্চিন্তপুরে দিন কাটাচ্ছেন কবি, সাহিত্যিক, শিল্পীরা।
…………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: আমার একটুখানি অ্যাক্টিং-এর ঠেলায় তোমাদের ফিল্ম ক্রিটিক কুপোকাত
……………………………………………………………………………………………………………………………………
এমন বাজারে বিপুলের কবিতা পড়ে খানিক থমকেছি। কাব্যগুণের প্রশ্ন পরে আসছি। আসল কথা পূর্বসুরি নজরুল, সুকান্ত, সুভাষ (মুখোপাধ্যায়), দীনেশ (দাস), মণীন্দ্র (রায়), বীরেন্দ্র (চট্টোপাধ্যায়)-দের মতো লাল সূর্য ওঠা নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখেন বিপুল চক্রবর্তী। সহজ, নির্ভার এক নান্দীমুখ হয় কৃশকায় কাব্যগ্রন্থের বিভাব কবিতায়– ‘এ কি ভোর না সন্ধ্যা, জানি না/ শুধু জানি/ দুহাতে কুয়াশা ঠেলে ঠেলে তুমি আসছ…/ সামনে দিন না রাত্রি, জানি না/ শুধু জানি/ দুপায়ের রাস্তা ঠেলে ঠেলে তুমি আসছ…’। পেপারব্যাক চৌষট্টি পাতার রোগা বইয়ের অন্যতম ‘বিপুল’ কবিতা ‘গোধূলি’। পড়তে হবে সম্পূর্ণ– ‘গুঞ্জা/ সন্ধ্যামণি/ করবী/ নয়নতারা/ মাথানিচু, সার সার/ দাঁড়িয়ে রয়েছে’। পরের স্তবকে চমকে ওঠা পাঠ– ‘তাদের স্তনের বোঁটা থেকে/ ফোঁটা ফোঁটা/ তখনও/ চুঁইয়ে নামছে/ চুঁইয়ে নামছে দুধ’। তৃতীয় স্তবকে কবি লেখেন– ‘বুকে দুধ, দেখে/ বুজেছে জওয়ানেরা–/ তারা সংসারী/ বুকে দুধ, চেখে/ বলেছে জওয়ানেরা/ তারা নকশাল নয়’। ভয়াবহ এক সমাজচিত্রের কবিতাটি শেষ হয়– ‘ফৌজি ক্যাম্প থেকে/ ছাড় পেয়ে/ গোধূলির ফণীমনসার বনে/ মাথানিচু/ তারা ভাবছে, তারা/ কী করবে’।
কবি হিসেবে বিপুলের সবচেয়ে ভালো দিক হল সিধেসাধা মানবিক বয়ানে নির্যাতিত, শোষিতের পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছে। অযথা স্মার্ট হতে গিয়ে উদ্দেশ্য গুলিয়ে ফেলেননি তিনি। ধর্মীয় রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে দলিতের গান কবিতায় লেখেন– ‘সরে যায় মেঘ, ভয়ে ঝরে যায় পাখি/ ভূ-ভারতে জুড়ে হাঁটে গেরুয়া ও খাকি/ দূর থেকে শুনি তবু দলিতের গান–/ কারা হেঁটে যায়, বুকে ভৈঁরো-আজান’। তেমনই ভোট-রাজনীতির বিরুদ্ধে ঘৃণা উগড়ে লেখেন– ‘‘লোকসভা লোকসভা/ গর গর গরজায়/ ম্যাটাডোর ভ’রে ভ’রে/ কিল যায়, চড় যায়/ পক্ষে, বিপক্ষে/ থাকে তক-তক্কে/ সকলেরই লক্ষ্য/ ধনরাশি যক্ষের।’’
……………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: পৃথিবীর খাদ্যচক্রে সক্কলে একে অন্যের খাবার
……………………………………………………………………………………………………………………………………
কোনও কোনও পাঠকের এই লেখাকে কবিতা কম, ছড়া বেশি মনে হতে পারে। তাতে সম্ভবত আপত্তি নেই কবিরও। কারণ তাঁর টার্গেট ‘দুর্নীতি’ শব্দের সমার্থক হয়ে ওঠা ‘রাজনীতি’। এই যুদ্ধ মেঘের আড়াল থেকে করা সম্ভব নয়। ফলে ভাব, শব্দ ও ছন্দ নিয়ে সম্মুখসমরে নেমেছেন বিপুল। সময়, সমাজ ও সভ্যতার যা কিছুকে ভাওতা মনে হয়েছে কবির, সোজাসাপটা সমালোচনা করেছেন। ভেঙে পড়েও আশাহত হননি। ‘ভালো জায়গার’ স্বপ্ন দেখেন। ‘যাত্রাপালা’ নামের চমৎকার কবিতায় সেই ইঙ্গিত রয়েছে। এবং বইটির অন্তিম কবিতা ‘শেষ দেখে যেত চাই’। যেখানে বিপুল লেখেন– ‘কে তুমি কবিতা লেখো/ গান বাঁধো কে তুমি/ হাঁক পাড়ে সিধু-কানু—/ হাঁক পাড়ে তিতুমীর’। অন্তিম দুই স্তবকে লেখা হয়– ‘পথ ডাকে, এসো তুমি/ কথা লেখো এ পথের/ এসো তুমি, সুর দাও–/ গান বাঁধো শপথের/ কথা লিখি, গান গাই/ আজ পথনাটকের/ শেষ দেখে যেতে চাই/ শেষ এই ঘাতকের।’
গত এক দশকে গেরুয়া রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে যে সংকীর্ণতার অন্ধকার নেমেছে দেশে। অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের প্রয়োজনকে অবহেলা করে ধর্ম, জাত, মন্দির-মসজিদে সরে গিয়েছে যে সময়, এইসঙ্গে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ইতিহাস বদলের চেষ্টা। এমনকী স্কুলপাঠ্যে বদল। সেই ভারতে বিপুল চক্রবর্তীর ‘হে দেশ হে আমার জননী’ গুরুত্বপূর্ণ কাব্যগ্রন্থ। এও সত্যি যে কবির মুখ্য উদ্দেশ্য– প্রতিবাদ, সামাজিক বার্তার জেরে কাব্যগুণ ক্ষুণ্ণ হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই পড়তে হবে বিপুলের বই। এবং সেই প্রশ্ন– শিল্প-সাহিত্যের কি সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকতে নেই? এসে দাঁড়ায় কবি ও পাঠকের সামনে।
হে দেশ হে আমার জননী
বিপুল চক্রবর্তী
ওয়াচ-টাওয়ার, আনাড়িমাইন্ডস। মূল্য ১২০