বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে জ্যোতিরিন্দ্র। তারপর পিছন থেকে জ্ঞানদাকে সামনে টেনে নিয়ে আসে। তার দু’টি হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে। তারপর বলে, ‘মেজবউঠান, আমাদের বাজার সরকারের মেয়ে কাদম্বরী আমার নিয়তি। এই বিয়ে আমার জীবনে অনিবার্য। ঘটবেই। তারপর আমার এই বিয়ের সূত্রধরে তোমার-আমার, আরও অনেকের জীবনে, আরও অনেক ঘটনা ঘটবে মেজবউঠান, এমনকী, আমাদের সংসারের চেহারাটাই হয়তো আমূল বদলে যাবে, যার কোনও সংকেত আজ আমরা দেখছি না, কিন্তু আমার মন বলছে, ওই একরত্তি মেয়ে একটা তোলপাড় নিয়ে আসছে।’
১৯.
সারারাত ছেঁড়া ছেঁড়া ঘুম হয়েছে জ্ঞানদার। সে নিজেকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে, নতুনের ১৯ বছর বয়স, আজ না হয় কাল, তার তো বিয়ে হবেই। কিন্তু পরক্ষণেই তার মন হু হু করছে। নতুনের জীবনে উড়ে এসে জুড়ে বসবে তার নতুন বউ, তখন নতুনের পিয়ানো, বেহালা কি তার ঘুম ভাঙাবে? নতুন কি তাকে আর পড়াবে কালিদাস, শেক্সপিয়র, ফরাসি দেশের প্রেমের কবিতা আর গল্প? আর সন্ধেবেলার ছাদের এক কোণে তার জন্য নতুনের অপেক্ষা, আর কখন নতুনের সঙ্গে দেখা হবে, কথা হবে, একা হওয়া যাবে,– সেই অপেক্ষা, এসব কি কিছুই থাকবে না জ্ঞানদার জীবনে? তাহলে থাকবে কী?
এখন অনেক রাত। কিছুতেই ঘুম আসছে না জ্ঞানদার চোখে। বুকের মধ্যে স্বপ্নের বাড়িটার সব আলো নিভে গেছে, মনে হয় জ্ঞানদার। তবুও সে আলো জ্বালানোর চেষ্টা করে, তার ভাবনার মোড় ঘুরিয়ে। ওই রোগা টিংটিংয়ে, কালো একরত্তি মেয়ে, যার বাপ জোড়াসাঁকোর বাড়ির বাজার সরকার, যার ঠাকুরদা এ-বাড়ির দারোয়ান, যে-মেয়ের না আছে রূপ, না আছে গুণ, সে নতুনের বউ হল তো কী হল? নতুনের জীবনে সে তলানির ওপরে উঠতে পারবে কোনও দিন? এ-বাড়িতে, ঠাকুরবাড়ির সংসারে, তার কোনও দিনই কোনও জায়গা হবে না। এই ভাবনাটা বেশ কয়েকটা আলো যেন আবার জ্বালিয়ে দেয় জ্ঞানদার বুকের অন্ধকার হয়ে যাওয়া স্বপ্নের বাড়িতে। ওই এক চিলতে মেয়ে, তার আবার নাম কাদম্বরী! মাঝরাতে হঠাৎ মনে মনে হেসে ফেলে জ্ঞানদা। চোখ চেয়ে দেখে, সত্যেন্দ্র অঘোরে ঘুমচ্ছেন। হঠাৎ সে নিঃশব্দ থ্যাঙ্কস জানায় তার বরকে, ভাগ্যিস সে ওই বিচ্ছিরি মেয়েটার সঙ্গে নতুনের বিয়েটা বন্ধ করেনি। নতুনের উপযুক্ত কোনও সুন্দরী গুণী মেয়ের সঙ্গে নতুনের বিয়ে হলে, জ্ঞানদা কি আরও একা হয়ে যেত না? জ্ঞানদার কাছ থেকে নতুনকে কেড়ে নিতে সেই মেয়ের তেমন অসুবিধে হত কি? এই প্রশ্ন আরও যেন দু’-একটা আলো জ্বালিয়ে দেয় জ্ঞানদার বুকের স্বপ্নের বাড়িটার ঘরে-ঘরে।
সারারাত প্রায় নিদ্রাহীন জ্ঞানদা ভোররাতে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাঙতে দেখল, পাশে সত্যেন্দ্র নেই। জ্ঞানদার মনে হয়, মর্নিং ওয়াকে সত্যেন্দ্রর এই বেরিয়ে যাওয়াটা তার ভালই লাগল। জ্ঞানদা কিছুক্ষণ বিছানায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকে। তার কানে আসে পিয়ানোয় নতুন গানের সুর। কোনও গানে সুর বসাচ্ছে নতুন? না কি, তাকেই ডাকছে? জ্ঞানদা কেমন যেন ঘোরের মধ্যে। চলতে শুরু করে নতুনের ঘরের দিকে।
জ্ঞানদা নিঃশব্দে জ্যোতিরিন্দ্রর ঘরে ঢোকে। জ্যোতিরিন্দ্র পিয়ানো বাজাচ্ছে। জ্ঞানদা পিছন থেকে জ্যোতিরিন্দ্রর কাঁধে হাত রাখে। জ্যোতিরিন্দ্র বাজনা থামায়।
–তোমার এ-বিয়েতে মত আছে? খুব মৃদু কণ্ঠে, প্রায় চুপি চুপি, জানতে চায় জ্ঞানদা।
–আমি ‘হ্যাঁ’, ‘না’ কিছুই বলিনি।
–তাহলে?
–মেজদাদাকে তো তুমি জানো বউঠান। অলওয়েজ ট্যাক্টফুল। জানতে চাইল, আমার মত আছে কি না। আমি ওর চোখের ওপর চোখ রাখলাম। কিন্তু কিচ্ছু বললাম না। মেজদাদা চোখ সরিয়ে জানলার বাইরে তাকিয়ে বলল, তুই যখন কিছু বলছিস না, ধরেই নিচ্ছি, তোর আপত্তি নেই। তোর অবস্থায় বাবামশাইয়ের আজ্ঞা, মেনে নিয়ে ভুল করিসনি। তোর বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে জুলাই মাসের পাঁচ তারিখে। এই কথাটুকু জানলার বাইরে ভাসিয়ে দিয়ে মেজদাদা মুহূর্তে অদৃশ্য, কাল সন্ধেবেলা।
–কাল সন্ধেবেলা আমি ছাদে তোমার জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেছি। তুমি আসোনি। দেখলাম তোমার ঘর অন্ধকার।
–আমি জানি বউঠান, তুমি আমার অন্ধকার ঘরের বন্ধ দরজায় টোকা দিয়েছিলে। আমি দরজা খুলিনি।
–কাল সারারাত ঘুম হয়নি। আমার কী হবে,– সারারাত পাগলের মতো লেগেছে।
–আমি একইরকম থাকব। ভেবো না বউঠান।
–তাতে একটা মেয়ের জীবন নষ্ট হবে। ওর তো কোনও দোষ নেই। এখনও সময় আছে, বাবামশাইকে বলে দাও এই অসম বিয়ে হতে পারে না। ওই মেয়ে কোনওদিক থেকে তোমার যোগ্য নয়। তোমার মেজদাদা কিন্তু তোমার পাশে দাঁড়াবে নতুন। তুমি শুধু বলো, তোমার এই বিয়েতে মত নেই। ব্যস!
–এই আপাত সামান্য কাজটি আমার পক্ষে করা অসম্ভব।
–তুমি পুরুষ মানুষ নতুন। এইটুকু মেরুদণ্ড নেই তোমার?
–না, নেই মেজবউঠান।
–কেন নেই? কেন? জ্ঞানদার ভিতরটা চিৎকার করে ওঠে।
–এই যে কাঁড়িকাঁড়ি বই কিনছি, বেহালা, এস্রাজ, পিয়ানো বাজাচ্ছি, কখনও কালিদাসে ডুবে আছি, কখনও পৃথিবীর রোম্যান্টিক সাহিত্যে বুঁদ, নাটক লিখছি, নাটকে অভিনয় করছি, আর তোমার সঙ্গে অলস মাধুর্যে দিন কাটাচ্ছি, এইসব কিছু সম্ভব হচ্ছে বাবামশায়ের কাছে থেকে পাওয়া জমিদারির টাকায়। বাবামশাইয়ের আদেশ না পালন করলে, মাসে মাসে তাঁর কাছ থেকে টাকা নেওয়ার আর মুখ থাকবে কি? পেটের দায়ে চাকরি জোগাড় করতে হবে। সবাই তো আর মেজদাদা নয়, যে আইসিএস হয়ে বাবামশায়ের নাকের ডগায় রাজার মতো ঘুরবে।
–রাজা না হাতি! আমি তোমার মেজদাদাকে বলেছিলেম, তুমি বাবামশায়কে বোঝাও, এ-বিয়ে হতে পারে না। ও বলেও ছিল, ওই পাত্রী কোনওদিক থেকেই তোমার যোগ্য নয়, এবং এই বিয়েতে তোমার মেজদাদারও মত নেই। বাবামশায় সটান বলে দিলেন, তোমার মতামতে কিছু এসে যায় না। যার বিয়ে, তাকে রাজি করো। ব্যস। তোমার মেজদাদাও অমনি কেঁচো!
বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে জ্যোতিরিন্দ্র। তারপর পিছন থেকে জ্ঞানদাকে সামনে টেনে নিয়ে আসে। তার দু’টি হাত নিজের হাতের মধ্যে ধরে। তারপর বলে, ‘মেজবউঠান, আমাদের বাজার সরকারের মেয়ে কাদম্বরী আমার নিয়তি। এই বিয়ে আমার জীবনে অনিবার্য। ঘটবেই। তারপর আমার এই বিয়ের সূত্রধরে তোমার-আমার, আরও অনেকের জীবনে, আরও অনেক ঘটনা ঘটবে মেজবউঠান, এমনকী, আমাদের সংসারের চেহারাটাই হয়তো আমূল বদলে যাবে, যার কোনও সংকেত আজ আমরা দেখছি না, কিন্তু আমার মন বলছে, ওই একরত্তি মেয়ে একটা তোলপাড় নিয়ে আসছে।’
–দাঁড়াও দাঁড়াও ঠাকুরপো। সত্যি তোমাদের পুরুষের মন। বলিহারি যাই। জুলাইয়ের পাঁচ তারিখ আসতে এখনও বেশ ক’দিন দেরি। এরই মধ্যে তুমি তো সোহাগে হাবুডুবু গো ঠাকুরপো! ওই একরত্তি কালো মেয়ে তোমার সুমুদ্দুর হয়ে উঠল না কি, যে তোলপাড়! এ বাড়ির তলানিতেও থাকবে না, তুমি দেখে নিও।
এক তোড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে চায় জ্ঞানদা। সেই ঝটকা সামলে জ্যোতিরিন্দ্র তাকে আটকে দেয়। তারপর বলে, ‘সোহাগ নয় বউঠান। ভয় করছে।’
জ্ঞানদা অবাক হয়ে তাকায় জ্যোতিরিন্দ্রর দিকে।
–মনে হচ্ছে সামলানোর শক্তি নেই আমার সত্যিই ভয় করছে, বলে জ্যোতি।
–কীসের ভয় নতুন? একটা ন’বছরের মেয়েকে তুমি ভয় পাচ্ছ?
–না। ভয় পাচ্ছি পরিস্থিতিকে।
–শোনো নতুন। যাকে তুমি বিয়ে করছ, তার বাবা এই বাড়ির বাজার করে, তার ঠাকুর্দা এই বাড়ির সদর দরজা পাহারা দেয়। সুতরাং তাকে বিয়ে করলে এই বাড়ির উজ্জ্বলতম যুবক জ্যোতিরিন্দ্রর পরিস্থিতির পরিবর্তন? তোমার এত লেখাপড়া, ফরাসিচর্চা, সংস্কৃত নাটক অনুবাদ, গানবাজনা, আর তোমার এমন রূপ– সব কি গঙ্গাজলে ভেসে যাবে ওই মেয়ের দাপটে?
–না, তা নয়। কিন্তু কেমন যে ছায়া পড়ছে, তবু।
জ্ঞানদা চারধার দেখে মাথা রাখে জ্যোতিরিন্দ্রর বুকে। আর মৃদু স্বরে বলে, তোমার আমার সম্পর্কে কোনও ছায়া পড়বে না। কোনও দিন।
(চলবে)