গণহত্যার শুরুর দিনগুলির অভিঘাত বড় তীব্র হয়। হাজার হাজার শিশুর লাশ গোটা পৃথিবীর বুকের উপর চেপে বসে যেন। দমবন্ধ হয়ে আসে আমাদের৷ আমরা ফেটে পড়ি বিক্ষোভে। অসহায় চিৎকার। তারপর একসময় ধীরে ধীরে গণহত্যার স্বাভাবিকীকরণ হয়ে যায় যেন। খবরের কাগজের ভিতরের পাতায় চলে যায় সেই খবর। গণহত্যা হয়ে ওঠে এক চলমান, অস্বস্তিকর বাস্তবতা, যাকে খানিকটা উপেক্ষা করা যায় গরিব আত্মীয়ের মতো। সত্যিই তো, জীবন কি আর থেমে থাকে কোথাও?
ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের বেথলেহেম শহরের চার্চ অফ নেটিভিটিতে বছরের এই সময়টায় ভিড় উপচে পড়ে। গোটা পৃথিবী থেকে লক্ষ লক্ষ মানুষ ভিড় জমান সেখানে। হবে না-ই বা কেন! এই গির্জা তো আক্ষরিক অর্থেই যিশুখ্রিস্টের আঁতুড়ঘর। চার্চ অফ নেটিভিটি-র মধ্যে রয়েছে একটি গুহা। মনে করা হয় সেখানেই যিশুর জন্ম। এই গুহার উপরেই ৩৩০ থেকে ৩৩৩ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে চার্চ তৈরি করেন সম্রাট কনস্ট্যানটাইন৷ দুই শতাব্দী পরে সামারিটান বিদ্রোহের আগুনে পুড়ে ধ্বংস হয়ে যায় চার্চ অফ নেটিভিটি। সেটিকে নতুন করে গড়ে তোলেন সম্রাট জাস্টিনিয়ান।
লন্ডনের প্যালেস্তাইন সলিডারিটি ক্যাম্পেনের প্রধান সংগঠন বেন জামাল বলছিলেন, প্রতি বছর বড়দিন এবং নিউ ইয়ার উপলক্ষে ১৫ থেকে ২০ লক্ষ মানুষের সমাগম হয় যিশুর আঁতুড়ঘরে। চার্চ অফ নেটিভিটির বাইরে রয়েছে ম্যাঙ্গাস স্কোয়ার৷ সেই চত্ত্বর সেজে ওঠে আলোকসজ্জায়, ক্রিসমাস ট্রি-তে। বেথলেহেমের ৭০ শতাংশ বাসিন্দার রুটিরুজি নির্ভর করে পর্যটন ব্যবসার উপর। আর্ন্তজাতিক দর্শনার্থীরা এলে তাঁদের সংসার চলে। এই বছরটা একদম অন্যরকম। গাজার গণহত্যার বিরাম নেই। গোটা ওয়েস্ট ব্যাঙ্ক জুড়ে শ্মশানের স্তব্ধতা। গাজাকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করার পরে ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেও তল্লাশির নামে নিয়মিত হামলা চালাচ্ছে ইজরায়েলি সেনা। বেথলেহেমের বাসিন্দা হাজার হাজার ফিলিস্তিনিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এখনও পর্যন্ত কেবলমাত্র ওয়েস্ট ব্যাঙ্কেই মারা গিয়েছেন কয়েকশো ফিলিস্তিনি। যিশুর জন্মস্থানে তাই এই বছরের ক্রিসমাস এবং নিউ ইয়ারে উৎসবের আলো জ্বলেনি৷ বিষাদপ্রতিমার মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে চার্চ অফ নেটিভিটি, বহু শতাব্দী আগে যেখানে ঈশ্বরের সন্তান জন্ম নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়, সেখানে এই বছর কেবলই শূন্যতা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বেথলেহেমের এভানজেলিক্যাল লুথারিয়ান চার্চে বড়দিনের প্রাক্কালে যিশুর জন্মদৃশ্যের নির্মাণ ইতিমধ্যেই আলোচিত হচ্ছে গোটা বিশ্বে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অবহেলায় পড়ে রয়েছেন ‘কেফিয়া’ জড়ানো শিশু জিসাস। ধ্বংসস্তূপ হাতড়ে তাঁকে খুঁজছেন তিন ম্যাজাই এবং মেষপালকেরা৷ পাদ্রী মুন্থার ইসাক বলেছেন, যিশু একজন ফিলিস্তিনি ছিলেন। আজ যদি তিনি জন্মাতেন, তাহলে তাঁকে ধ্বংসস্তূপেই জন্মাতে হত।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কেবল প্যালেস্তাইন নয়, গোটা আরব বিশ্বই গাজার গণহত্যার প্রতিবাদে এই বছর উৎসব বয়কট করছে। ওয়েস্ট ব্যাঙ্কের সবক’টি গির্জার যাজকরা মিলিতভাবে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ক্রিসমাস এবং নিউ ইয়ারে কোনও উৎসব হবে না৷ জর্ডনের অ্যাসেম্বলিজ অফ গড চার্চের সভাপতি ডেভিড রিহানির কথায়, ‘.. খ্রিস্টধর্ম কেবল পশ্চিমী বিশ্বের সম্পত্তি নয়৷ আমরা গোটা পৃথিবীকে জানাতে চাই, খ্রিস্টধর্ম পক্ষপাতিত্ব সমর্থন করে না। গাজায় যাঁরা প্রাণ হারাচ্ছেন, তাঁরাও ঈশ্বরের পুত্র কন্যা। অথচ পশ্চিমী দুনিয়া তাঁদের নিয়ে নির্লিপ্ত।’ জর্ডনের গির্জাগুলির কর্তৃপক্ষ সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইব্রাহিম দাব্বুর দীর্ঘ ভিডিও সাক্ষাৎকার দিয়েছেন লন্ডন-সহ গোটা বিশ্বের ফিলিস্তিন সংহতি আন্দোলনের কর্মীদের। তিনি বলছিলেন, ‘‘আমরা, খ্রিস্টানরা দু’হাজার বছর ধরে এই মধ্যপ্রাচ্যে রয়েছি। এই মাটিতে আমার শিকড় গাঁথা রয়েছে। আরব মুসলিমরা যেমন এই মাটির সন্তান, আরব খ্রিস্টানরাও তাই। আমরা জায়নবাদীদের মতে বহিরাগত নই। গাজায় যখন নির্মম এথনিক ক্লিনজিং চলছে, তখন আমরা কোনও উৎসবে অংশ নিতে পারি না। এই বছরের নিউ ইয়ারে তাই কোনও উৎসব হবে না।’’
বেথলেহেমের এভানজেলিক্যাল লুথারিয়ান চার্চে বড়দিনের প্রাক্কালে যিশুর জন্মদৃশ্যের নির্মাণ ইতিমধ্যেই আলোচিত হচ্ছে গোটা বিশ্বে। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে অবহেলায় পড়ে রয়েছেন ‘কেফিয়া’ জড়ানো শিশু জিসাস। ধ্বংসস্তূপ হাতড়ে তাঁকে খুঁজছেন তিন ম্যাজাই এবং মেষপালকেরা৷ পাদ্রী মুন্থার ইসাক বলেছেন, যিশু একজন ফিলিস্তিনি ছিলেন। আজ যদি তিনি জন্মাতেন, তাহলে তাঁকে ধ্বংসস্তূপেই জন্মাতে হত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: নিহত মিছিল থেকে পরের হত্যাযজ্ঞ শুরুর মাঝের অবসরে ফিলিস্তিনিরা দেশ এঁকে নেন
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্যালেস্তাইন যুব সংগঠনের নেত্রী এলিসার গবেষণা করে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে। যুদ্ধের শুরু থেকেই তিনি আমার সহকর্মী। আমরা একসঙ্গে কাজ করি প্যালেস্তাইন সলিডারিটি ক্যাম্পেনে৷ ডকুমেন্টেশন করি গাজা এবং ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে আটকে পড়া মানুষের বর্ণনাতীত অভিজ্ঞতার। এলিসার বলছিলেন, প্রতি বছর এই সময়টা তিনি দেশে ফিরতেন। খান ইউনুসে তাঁর বাড়ি৷ বাবা, মা, দুই ভাই, এক বোনের ভরা সংসার৷ বাবার ছিল ছোট মুদি দোকান৷ এক ভাই ওয়েস্ট ব্যাঙ্কে ফলের ব্যবসা করত। বোন আমেরিকায় পড়াশোনা করে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এলিসারের বাবা চেষ্টা করেছিলেন গোটা পরিবারকে নিয়ে জর্ডনে পালিয়ে যেতে। পারেননি। এলিসারের মা এবং বড় ভাই মারা গিয়েছেন। বাকি দু’জন এখন কোনওমতে আছেন ত্রাণ শিবিরে। এলিসার বলছিলেন, তাঁরা আরব খ্রিস্টান। গোটা পৃথিবীর খ্রিস্টানদের মতো তাঁদের কাছেও বছরের এই সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ, ভীষণ স্পেশাল। অথচ এই বছরটা ধ্বংস আর মৃত্যু ছাড়া তাঁদের জন্য আর কিছু রাখেনি।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আরও পড়ুন: শিল্পে প্রতিরোধের প্রকাশ ঘটে, স্পেক্টাকেল তৈরি হয়, সবাই তাকায়
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
গণহত্যার শুরুর দিনগুলির অভিঘাত বড় তীব্র হয়। হাজার হাজার শিশুর লাশ গোটা পৃথিবীর বুকের উপর চেপে বসে যেন। দমবন্ধ হয়ে আসে আমাদের৷ আমরা ফেটে পড়ি বিক্ষোভে। অসহায় চিৎকার। তারপর একসময় ধীরে ধীরে গণহত্যার স্বাভাবিকীকরণ হয়ে যায় যেন। খবরের কাগজের ভিতরের পাতায় চলে যায় সেই খবর। গণহত্যা হয়ে ওঠে এক চলমান, অস্বস্তিকর বাস্তবতা, যাকে খানিকটা উপেক্ষা করা যায় গরিব আত্মীয়ের মতো। সত্যিই তো, জীবন কি আর থেমে থাকে কোথাও? প্রাত্যহিকতার সহস্র উচাটন, আশা, আশঙ্কা, উদ্বেগ নিয়েই আসছে পয়লা জানুয়ারি, যেমন আসে প্রত্যেক বছর। শুধু বিশ্বের বৃহত্তম উন্মুক্ত কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আটকে পড়া লক্ষ লক্ষ ফিলিস্তিনির তিলে তিলে মৃত্যুর বাস্তবতা বদলায় না। গাজার ছোট্ট মেয়ে মিশক জৌদা মারা গিয়েছে নভেম্বরের শুরুতে। তার মায়ের চেহারা শুকিয়ে গিয়েছে গত দু’মাসে। খেতে না পেয়ে। অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনালে কর্মরত ডেভিড বলছিলেন, গোটা গাজা দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে। যাঁরা বোমায় মরবেন না, তাঁরা শুকিয়ে মরতে চলেছেন। খিদে যদি সন্তানের মৃত্যুশোক ভুলিয়ে দেয়, তাকে কি আর্শীবাদ বলে ভাবা যাবে নতুন বছরে?