একবার রাগ করে দুপুরবেলায় টিকিট কেটে শিলিগুড়ির বাসে চড়ে বসলাম। জানুয়ারি মাস, কিন্তু কিছুই গরম জামাকাপড় নিয়ে যাইনি। কৃষ্ণনগরের রাস্তার দুলুনি আর পিছনের সিটে যুগলের প্রেমালাপের আলিঙ্গনে মন নরম হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ফলে ঠান্ডাও লাগছে বেশি। এমন সময় আমার আলাপ আমিনের সঙ্গে। আমিন ট্রেক করায়। আমিনের তত্ত্বাবধানে ধার করা জ্যাকেট, কিছু চকোলেট এবং বেঁচে থাকা অভিমানের ওপর নির্ভর করে মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফুর রাস্তায় হাঁটা দিলাম।
এই বুড়িয়ে যাওয়ার সময়ে, অবহেলার শহরে যখন প্রেম আসে, অসময়ে, তখনই পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনাকে কোন সিন্দুকে সবার আড়ালে গুছিয়ে পরিপাটি করে রাখব? অযত্নের ধুলো ঝাড়ব ডায়েরির ভাঁজে রাখা শুকনো পাতা দিয়ে। মনে হয় সব চিঠি জড়ো করে উপন্যাস তৈরি করে ফেলব একদিন। আর ফাগুনের হাওয়ায় মেঘের গন্ধ পেলে বইয়ের পাতা উল্টে রঙ্গন আনার দিন মনে করিয়ে দেব তোমায়। বসন্তের নিস্তব্ধ দুপুরে পাতা ঝরার আওয়াজ শীতের ভোরবেলার গন্ধের মতো প্রেম নিয়ে আর পাঁচটা বাঙালি ছেলেমেয়ের মতোই আমিও অলিখিত কবিতা লিখেছি বহুবার। নিকোনো উঠোনে শিউলি-জামগাছের নীচে তোমার জন্য রান্না করেছি বহুদিন। স্নান করে ভেজা চুলে মাদুর পেতে শীতের দুপুরে কমলালেবু খাওয়ার আরামের লোভে জীবনের দিকে তাকিয়ে থেকেছি অপলক দৃষ্টিতে। প্রেম আমাকে সুন্দর করেছে। মায়া বাড়িয়েছে, হিংসুটে করেছে। নিজের মধ্যে যা কিছু গোপন, তা স্বীকার করতে শিখিয়েছে। আর রেগে গিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতেও শিখিয়েছে।
একবার প্রচণ্ড রাগ করে দুপুরবেলায় টিকিট কেটে শিলিগুড়ির বাসে চড়ে বসলাম। চলে গেলাম দার্জিলিং। জানুয়ারি মাস অত ঠান্ডা, কিন্তু কিছুই গরম জামাকাপড় নিয়ে যাইনি। কৃষ্ণনগরের রাস্তার দুলুনি আর পিছনের সিটে যুগলের প্রেমালাপের আলিঙ্গনে মন নরম হয়ে গেছে অনেকক্ষণ। ফলে ঠান্ডাও লাগছে বেশি। এমন সময় আমার আলাপ আমিনের সঙ্গে। আমিন ট্রেক করায়। বন্ধুত্ব হয়ে গেল খুব অল্প সময়ে। আমি এর আগে কোনও দিন ট্রেকিং করিনি। আমিনের তত্ত্বাবধানে ধার করা জ্যাকেট, কিছু চকোলেট এবং বেঁচে থাকা অভিমানের ওপর নির্ভর করে মানেভঞ্জন থেকে সান্দাকফুর রাস্তায় হাঁটা দিলাম। সান্দাকফু পৌঁছলাম রাতের দিকে। পরের দিন ভোরবেলা স্লিপিং বুদ্ধ দেখতে দেখতে মনে হয়েছিল ‘দাগ আচ্ছে হে’-র মতোই কখনও কখনও একা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়াও ‘আচ্ছে হে’। নামের ভার নেই, ভিড় নেই, এমন অনেক হলুদ, নীল জংলা ফুল চোখে পড়ে। আমার একা ঘুরতে যাওয়া শুরু তখন থেকেই। আমিন, আমিনের বউ, দুই মেয়ে, অরুণাচল ঘুরতে গিয়ে রাজুদা, থেম্বাং, থেম্বাংয়ের আঙ্কেল-আন্টি– এরকম কত মানুষ আমাকে আপন করেছে। অরুণাচলের থেম্বাং গ্রামের একটা বাচ্চা মেয়ে দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর পাহাড়ের জঙ্গলে আমাকে ঘুরতে নিয়ে গিয়েছিল। ওই পাহাড়ে নাকি একটা গুহা আছে! যারা পাপী মানুষ, তারা গুহায় ঢুকলে আর বেরতে পারে না, আটকে যায়। উৎসবের দিনে তাই গ্রামের মানুষেরা গুহায় ঢোকে পাপ-পুণ্যের হিসেব-নিকেশ করার জন্য। এসব শুনে মুচকি হেসে ফিরে আসি জংলা ফুল খুঁজব বলে। আর নিজের শহরেই আটকে থাকব বলে।
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে রাগ কমে গেছে, রাগ দেখানোর মানুষও। জানি হারিয়ে ফেলাই জীবনের নিয়ম। তা মেনে নিয়েও ভয় পাই একা থাকার। একা একা ঘুরতে যাব, কিন্তু ফিরে আসব মুখোমুখি বসে কথা বলার জন্য। আসলে প্রেম আমাকে সারারাত জেগে থাকতে শিখিয়েছে। রূপম ইসলামের ফ্যান হতে শিখিয়েছে। রান্না করে মায়ের মতো বেড়ে দিতেও শিখিয়েছে। প্রেম আমাকে অ্যাকাডেমি মুখো করেছে। প্রেম আমাকে চোখের দিকে তাকিয়ে বেসুরো গান গাইতে শিখিয়েছে। প্রেম আমাকে একা থাকা শিখিয়েছে, আবার ফিরে আসাও। তিরতিরে নদীর ধারে বসে ঝরা পাতার আওয়াজে জানান দিয়েছে, হাত ধরে চুপ করে বসে থাকতে ভাল লাগে, আমারও, তোমারও।
গত রবিবার (১৬ মার্চ) ডোনাল্ড ট্রাম্পের সরকার ভয়েস অফ আমেরিকা এবং অন্যান্য সরকারপোষিত সংবাদমাধ্যমগুলোতে গণ ছাঁটাই আরম্ভ করেছে। আজকাল সারা পৃথিবীর কর্পোরেট চাকরিতে ইদানীং যা দস্তুর, সেই অনুযায়ী রাতারাতি ইমেল করে কর্মরত সাংবাদিক ও অন্যান্য কর্মীদের জানানো হয়েছে– কেটে পড়ো। যে সাংবাদিক চাটুকার নয়, তাকে নিয়ে ট্রাম্প কী করবেন?
যদি দাগই মুছে ফেলো, স্মৃতিও মুছে ফেলা দস্তুর। পারবে পুরাতন প্রেম ছাড়া বেঁচে থাকতে? পারবে সেই আদিম ডাককে অস্বীকার করতে? বারবার জিতে যাওয়াগুলো ভুলে যেতে? সেইসব অপ্রেমের ভেতর নিজেকে খুঁজে পাওয়ার ওই আনন্দ ভুলে যেতে? কাটাগাছে হাত কেটে রক্তাক্ত, তবুও রাতের শেষে সেদিন বাঁকা চাঁদ উঠলে তুমিই তো আলোয় ভরে উঠেছিলে, আরও কিছুদূর এগিয়ে গিয়েছিলে। ফেরার রাস্তা ভুলতে চেয়েছিলে। আধেক আলো আর গোটা জীবন নিয়ে ফিরে এসেছিল সকাল হতে।