অরণ্যের শহরে পরিণত হওয়ার পট। ভেঙে-পড়া গুঁড়ির ভিতেই নগরায়ন– এই নগর যে কলকাতা, তারও বিভিন্ন ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন অরুণ। ‘ট্রামবাস নিয়ন হাফগেরস্ত/ ডাস্টবিন শীতলাগা ন্যাংটো ছেলে’– এ দৃশ্য অবশ্য শুধু কলকাতা নয়, অনেক শহরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু তারপরই যে ‘হাড়কাটা’-র উল্লেখ, তা কলকাতারই। বন কেটে বসত—কবির আঙুল, স্পষ্টতই, তিলোত্তমার অতীতে। আজ অরুণ মিত্রর মৃত্যুদিন।
গাছের রাজ্যে পৌঁছে উত্তুরে ঝড় পেলাম,
পাতাগুলো ছিঁড়েছুটে উড়ছে
গুঁড়িগুলো মড়মড় ভাঙছে;
কী কাণ্ড, তখুনি সামনে গজিয়ে উঠল শহর:
ট্রামবাস নিয়ন হাফগেরস্ত
ডাস্টবিন শীতলাগা ন্যাংটো ছেলে
হাড়কাটার পাশে শীতলা—বন কেটে বসত।
আমার যে-হৃদয়টা আছে সে এক বাউণ্ডুলে,
গলির পর গলি ঘুরল আঁস্তাকুড় ছুঁয়ে বেড়াল,
মরা পাতায় ভর দিয়ে সেই যে উড়ছিল আশা
পচে নিশ্চয় তা সার হয়েছে
আর রসে টইটম্বুর করে উঠিয়ে দিয়েছে
বিশপঁচিশ তলার ঝাড়,
লকলকে ডগায় ফুটিয়ে রেখেছে
উড়োজাহাজ মজাবার ইশারা।
(বন কেটে বসত / অরুণ মিত্র)
টুকরো-টাকরা খবর ভেসে আসে প্রায়ই। নদীতে অপরিকল্পিত বাঁধ, ‘উন্নয়ন’-এর জন্য বৃক্ষচ্ছেদন, পাহাড়ে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ– আরও কত! ভুক্তভোগী পরিবেশ, সঙ্গে স্থানীয় জনজাতি। উচ্ছেদ ও খাতায়-কলমে পুনর্বাসন। সাম্প্রতিক যোশীমঠের ধস কিংবা যমুনার বন্যায় দিল্লি প্লাবিত হওয়া ভুলিনি কেউ-ই। খবর আসে, খবর যায়। আমরা বিচলিত হই, আলোচনা করি। আলোচনা থিতিয়েও যায়। নাগরিক দৈনন্দিনতায় ছাপ পড়ে না বিশেষ। সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে এসব ‘তথ্য’মাত্র। মিডিয়াকর্মীদের কাছে ‘কন্টেন্ট’। ব্যক্তিগত ঝুটঝামেলা পেরিয়ে, আলাদা করে ভাবার সময় কই!
এসবই মনে হচ্ছিল সাম্প্রতিক একটি ওয়েব সিরিজ, ‘দ্য জেঙ্গাবুরু কার্স’ দেখতে দেখতে। ওড়িশার কেওনঝড়ের একটি আদিবাসী গ্রাম রাতারাতি উচ্ছেদ করা হল, কেননা সে-গ্রামের মাটির নিচে নাকি বক্সাইটের হদিশ মিলেছে। প্রতিবাদী গ্রামবাসীদের দাগিয়ে দেওয়া হল ‘নকশাল’ পরিচয়ে। ইউএপিএ আইনে জেলবন্দি কেউ-কেউ। এদিকে, নবনির্মিত খনিতে বক্সাইটের নামে ইউরেনিয়াম উত্তোলন, আদিবাসীদের গ্রাম ফিরে পাওয়ার লড়াই, প্রশাসন বনাম মানবাধিকার– ওয়েব সিরিজের কাহিনিসূত্রের মধ্যে লুকিয়ে দর্শকের প্রতি অজস্র প্রশ্নও। যে আত্মতুষ্টির মধ্যে আমাদের বসবাস, তা কতটা স্থায়ী? কে বলতে পারে, আমার-আপনার বাসস্থানও আক্রান্ত হবে না কোনও দিন?
এইসব ভাবনাবৃত্তে ঘুরপাক খাওয়ার দিনকালেই পড়া গেল অরুণ মিত্রের কবিতাটি। অরণ্যের শহরে পরিণত হওয়ার পট। ভেঙে-পড়া গুঁড়ির ভিতেই নগরায়ন– এই নগর যে কলকাতা, তারও বিভিন্ন ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন অরুণ। ‘ট্রামবাস নিয়ন হাফগেরস্ত/ ডাস্টবিন শীতলাগা ন্যাংটো ছেলে’– এ দৃশ্য অবশ্য শুধু কলকাতা নয়, অনেক শহরের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। কিন্তু তারপরই যে ‘হাড়কাটা’-র উল্লেখ, তা কলকাতারই। বন কেটে বসত—কবির আঙুল, স্পষ্টতই, তিলোত্তমার অতীতে।
কী সেই অতীত? বিস্তারে না-গিয়েও বলা যায়, সুন্দরবনের অন্তর্গত ছিল একসময় এ-অঞ্চল। কলকাতার বিভিন্ন স্থানে মাটি খুঁড়তে গিয়ে, ২০-২৫ ফুট গভীরে হদিশ মিলেছে সুন্দরী গাছের গুঁড়ির। এককালে কলকাতার অরণ্যসংকুলতার কথা তো সর্বজনবিদিত! সেইসব অরণ্য কাটা হল দিনে দিনে, গড়ে উঠল জনবসতি। শুধু তাই নয়, বিপর্যস্ত হল জলাভূমিও। নাব্যতা হারাল খাল-বিল-নদী, লবণহ্রদ একটেরে হতে হতে আজ অতীতের ছায়ামাত্র। এসবের প্রভাব প্রকৃতি জানান নেয় প্রায়ই। কিন্তু সে-কথা অন্য। এই যে ‘মহানগর’ হয়ে ওঠা পরিবেশকে খুন করে, তাতে অরণ্যের অনুমতি কতখানি? ভূমিপুত্রদের? পরিচিত সেক্টর ফাইভ-নিউটাউনের কথাই ধরুন-না কেন! যে-সমস্ত মৎস্যজীবী জলাভূমির ওপর নির্ভরশীল ছিলেন, নগরবিস্তৃতির খপ্পরে পড়ে তাঁরা অনেকেই পূর্বজীবিকা হারিয়েছেন। কেউ-কেউ পেটের দায়ে নিজের ভূমিতেই খাঁই মেটাচ্ছেন কর্পোরেট বাবুদের। অরুণ পুবপানে কলকাতার থাবাবিস্তার দেখেননি। কিন্তু ‘শীতলাগা ন্যাংটো ছেলে’টি কলকাতার বস্তির পাশাপাশি নিউটাউনের বাস্তুহারা পিতার সন্তানও নয় তো?
‘কবি বলেছেন’– গতে-বাঁধা লবজের আড়াল সরিয়ে উঁকি দিই। ‘মরা পাতায় ভর দিয়ে সেই যে উড়ছিল আশা/ পচে নিশ্চয় তা সার হয়েছে/ আর রসে টইটম্বুর করে উঠিয়ে দিয়েছে/ বিশপঁচিশ তলার ঝাড়।’ যে ভূমি একদিন ‘গাছের রাজ্য’ ছিল, আজ তা ‘উত্তুরে ঝড়’-এ বিপর্যস্ত। এই ঝড় প্রাকৃতিক নয়, মনুষ্যকৃত উন্নয়ন– উত্তুরে ঝড়ের দাপটে ছারখার অতীত। শহর তৈরি তো হল, সেইসঙ্গে গাছের অবশেষ—পাতাও ছড়িয়ে পড়ল এদিক-সেদিক। সেইসব পাতা, শহরের পাশাপাশিই এগিয়েছে পচনের দিকে। তবে মৃতেরও নিজস্ব বিদ্রোহ থাকে, দেয় থাকে। নগর সভ্যতাকে ‘সার’ উপহার দিচ্ছে পাতা। সারের সুবাদে শহর লকলকিয়ে বাড়ছে আরও, ২০-২৫ তলার ঝাড় গজিয়ে উঠছে ইতিউতি। গাছগুলোও, মৃত্যুর পরে চিহ্ন রেখে গেল যেন-বা। এখানে ‘ঝাড়’ শব্দটি লক্ষ্যনীয়। বিল্ডিং নয়– ঝাড়। গাছই যেন ইট-কাঠের মধ্যে দিয়ে অনেকটা পথ পেরিয়ে, প্রাণহীন আবর্জনা হয়ে ফিরে এল আবার। একদিন যা ছিল অরণ্য, আজ শুকনো কাঠামো। উন্নয়ন অবশ্য সেই ঝাড়কেই বাহবা জোগায়। আনাগোনা বাড়ে উড়োজাহাজের। পোক্ত হয় অর্থনীতি। আর সেই ঝাড়ের দশটা-পাঁচটার কীট হয়ে উঠি, হ্যাঁ, আমরাই।
ফিরে যাওয়া যাক আগের একটি পঙ্ক্তিতে। ‘হাড়কাটার পাশে শীতলা’ শুধুই কি দৃশ্যবর্ণনা? যখন অরণ্য ছিল, ছিল অরণ্য-ঘেঁষা জনবসতি, ভূমিপুত্ররা মারী-মড়কের হাত থেকে বাঁচতে আরাধনা করত শীতলার। নগরায়নের বহু আগের চিহ্ন এই লোকদেবী– আর-সব উচ্ছেদ হলেও, তিনি থেকে গিয়েছেন, অতীতের স্মৃতি নিয়ে। হাড়ের গুঁড়ো ঢেকে দিতে পারেনি তাঁর অস্তিত্বকে। যেভাবে নগর, প্রবল বলীয়ান হয়েও, গ্রাস করতে পারে না সবকিছু। ফাঁকফোকর দিয়ে বেড়ে ওঠে পাতার অভিশাপ; নগর-সম্ভাবনা পরিণতি পায় অজস্র ঝাড়ের স্কাইলাইনে।
অরুণ মিত্র যে রূপান্তরের কথা লিখে গেলেন কবিতায়, তা একইসঙ্গে সত্য ও অসহায়। পাঠকও, এ-লেখা পড়ার পর দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠিকই এগিয়ে যাবেন অন্য কোনও কাজে। বাতিল হবে না ঠুরগার তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প। কারখানার বর্জ্যে অসুস্থতা বাড়বে হুগলির গ্রামবাসীদের। মালদহে আরও একটা স্কুল তলিয়ে যাবে গঙ্গার ভাঙনে। বর্ষায় হাবুডুবু খাবে কলকাতাও। আর, মেট্রোরেলের থামে মাথা কুটতে কুটতে নিজের মৃত্যুর দিকে অনুভূতিহীন তাকিয়ে থাকবে আদিগঙ্গা। মনে পড়ে, ১৮৫০-এর দশকে যখন বাংলায় রেলপথ স্থাপনের কাজ শুরু হয়, আপত্তি জানিয়েছিলেন নদী-বিশেষজ্ঞরা। কারণও উল্লিখিত ছিল স্পষ্টভাবেই– স্রোত হারিয়ে ফেলবে অনেক ক্ষুদ্র নদী ও খাল। বিঘ্নিত হবে স্থানিক চরিত্র। সেদিন সে-প্রতিবাদে কান দেয়নি কেউ-ই। রেলপথ নির্মিত হল, শাসকের স্বার্থের কথা মাথায় রেখেই। একইসঙ্গে, সম্পূর্ণ বদলে গেল জনজীবনও। ‘খড়গ হাতে উন্নয়নের দাঁড়িয়ে থাকা’-রও বোধ করি সেই শুরু। প্রায় পৌনে দু’-শতক পর সেদিকে ফিরে তাকালে, ধাঁধা লাগে। বৃহত্তর স্বার্থ ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য তথাকথিত ‘গৌণ’ ক্ষতিগুলিকে মেনে নেওয়ার প্রবণতা আজকের নয়। আবার, রেললাইন না-পাতলে কোথায় থমকে থাকত দেশ– এ-চিন্তাও অযৌক্তিক কি? আসলে সবই সত্য, আবার দিনযাপনের দৌড়ে মিথ্যা সকলই। অরুণ সে-কথা জানতেন। বিপরীত কোনও কবিতা লিখে যেতে পারেননি তাই…