রবীন্দ্রনাথ বলছেন, রাবণের ঘরে বন্দি সীতার কাছে দূত এসেছিল রামচন্দ্রের আংটি নিয়ে। সংসারের সোনার লঙ্কায় নির্বাসিত আমাদের কাছে প্রিয়তমের দূত হয়ে, সুন্দরের দূত হয়ে আসে ফুল। আনন্দময়ের আনন্দস্পর্শে আমরা বুঝতে পারি এই সোনার লঙ্কাপুরীই আমার সব নয়। এর বাইরে আমার মুক্তি, আমার প্রেমের সাফল্য, আমার জীবনের সার্থকতা।
২২.
‘অন্ধকারকে ঠিকমতো তার উপযুক্ত ভাষায় যদি কেউ কথা কওয়াতে পারে, তবে সে এই শ্রাবণের ধারাপতনধ্বনি।’ এ কথা রবীন্দ্রনাথ বলছেন উপাসনা-গৃহে এক সান্ধ্য উপাসনায়। বলছেন ‘বৃষ্টিপতনের এই অবিরাম শব্দ, এ যেন শব্দের অন্ধকার।’ অভিভাষণের শিরোনাম ‘শ্রাবণসন্ধ্যা’।
রবীন্দ্রনাথের মনে হয়েছে অন্ধকারের নিবিড় এই কণ্ঠস্বরে আমাদের মনও সাড়া দিয়ে উঠতে চায়। ওইরকম জল-স্থল-আকাশ ভরে দিয়ে খুব বড় করে কিছু বলতে চায়। কেবলমাত্র কথা দিয়ে সে কথা বলা যায় না বুঝতে পেরে সে একটা সুরকে খোঁজে। কথা জিনিসটা মানুষেরই, আর গান হল প্রকৃতির। কথা জিনিসটা প্রয়োজনের, স্পষ্ট কিন্তু সীমাবদ্ধ। গান সীমাহীনের ব্যাকুলতায় উৎকণ্ঠিত, অস্পষ্ট। বিশ্বপ্রকৃতির যা কিছু কথা, জলের কল্লোলে, বনের মর্মরে, বসন্তের উচ্ছ্বাসে কিংবা শরতের আলোয়, সবই তো আভাসে ইঙ্গিতে, ছবিতে গানে। প্রকৃতি তার সমস্ত আলাপে আমাদের প্রাণের ভিতরে অনির্বচনীয়ের আভাসে ভরা গানকেই জাগিয়ে তোলে। মুখের কথা সেখানে নিরস্ত হয়। মানুষ তাই প্রকৃতির কাছ থেকে রং আর রেখা নিয়ে নিজের চিন্তাকে ছবি করে তোলে, সুর আর ছন্দ নিয়ে করে তোলে কাব্যসঙ্গীত। মনের যা কিছু বলার, তার সবটুকু উজাড় করে প্রয়োজনের সংকীর্ণ গণ্ডি পার হয়ে চিরন্তনের সঙ্গে মিলে নবীন হয়ে উঠতে চায়।
রবীন্দ্রনাথ তাই বলছেন, ‘আজ এই ঘনবর্ষার সন্ধ্যার প্রকৃতির শ্রাবণ-অন্ধকারের ভাষা আমাদের ভাষার সঙ্গে মিলতে চাচ্ছে। অব্যক্ত আজ ব্যক্তের সঙ্গে লীলা করবে বলে আমাদের দ্বারে এসে আঘাত করছে। আজ যুক্তি তর্ক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ খাটবে না। আজ গান ছাড়া আর-কোনো কথা নেই।
তাই আমি বলছি, আমার কথা আজ থাক। সংসারের কাজকর্মের সীমাকে, মনুষ্যলোকালয়ের বেড়াকে একটুখানি সরিয়ে দাও, আজ এই আকাশভরা শ্রাবণের ধারাবর্ষণকে অবারিত অন্তরের মধ্যে আহ্বান করে নেও।’
প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের অন্তরের সম্পর্কটি বোঝানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ গাছের ফুলের দৃষ্টান্ত দেখিয়েছেন। গাছের ফুল কাজের দায় নিয়ে পৃথিবীতে আসে। ফল ফলানোর দায়। তরুবংশ টিকিয়ে রাখার দায়। এইজন্যেই তার বর্ণ-গন্ধের যত আয়োজন। তার পুষ্পজন্মের সাফল্যের প্রয়োজনে মৌমাছির কাছ থেকে রেণু পাওয়া হয়ে গেলেই রঙিন পাপড়ি খসিয়ে ফেলে, মধুগন্ধ ঝেড়ে ফেলে তার কাজে সে পুরোপুরি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মানুষের বিজ্ঞান প্রকৃতির এই কাজের জগতটাকেই স্বীকার করে। যে জগতে কাজের কথা ছাড়া আর অন্য কোনও কথা নেই। কুঁড়ি ফুলের দিকে, ফুল ফলের দিকে, ফল বীজের দিকে, বীজ গাছের দিকে হনহনিয়ে ছুটে চলে। ফুলটিও সেই কাজের জগতে রোদে জলে মজুরি করতেই আসে। গায়ে হাওয়া লাগিয়ে দোল খেয়ে নষ্ট করার সময় তার নেই। কিন্তু এই ফুলটিই যখন আমাদের অন্তরে আসে, তখন তার কোনও তাড়া থাকে না, তখন তার পূর্ণ অবকাশ। বাইরের ‘প্র্যাক্টিকাল’ জগতে সে যতই কাজের অবতার হোক, মানুষের অন্তরের মধ্যে সে শান্তি ও সৌন্দর্যের পূর্ণ প্রকাশ।
………………………………………………………………………..
‘আমাদের অন্তরের সন্ধ্যাকাশেও এই শ্রাবণ অত্যন্ত ঘন হয়ে নেমেছে কিন্তু সেখানে তার আপিসের বেশ নেই, সেখানে কেবল গানের আসর জমাতে, কেবল লীলার আয়োজন করতে তার আগমন।’
………………………………………………………………………
বিজ্ঞান যতই বলুক ফুলের সঙ্গে এই সৌন্দর্যমাধুর্যের সম্পর্কটা অহেতুক বানিয়ে তোলা পাতানো সম্পর্ক, আমাদের হৃদয় জানে এ সম্পর্ক মোটেই মিথ্যা নয়, এও সত্য। প্রকৃতির মধ্যে কাজের পরিচয়পত্র নিয়ে আসে ফুল বন্দির মতো। আমাদের দ্বারে এসে সেই ফুল ডাক দেয় মুক্তস্বরূপে। মৌমাছিকে ফুল বলে তোমার জন্যেই সেজেছি প্রয়োজনের ক্ষেত্রে তোমাকে টেনে আনব বলে, সে কথাও সত্যি। আবার আমাদের মনকে যখন সে বলে আনন্দের ক্ষেত্রে তোমাকে আহ্বান করে আনব বলে তোমার জন্যেই সেজেছি, সে কথাও সমান সত্য। ফুলের কাজ কেবল বনের মধ্যে নয়, মানুষের মনের মধ্যেও তার যেটুকু কাজ, তা সে বরাবর করে আসছে। কার্যকারণসূত্রে ফুলের ফুটে ওঠা বাইরের সত্য। অন্তরের সত্য হচ্ছে, আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে।
রবীন্দ্রনাথ বলছেন, রাবণের ঘরে বন্দি সীতার কাছে দূত এসেছিল রামচন্দ্রের আংটি নিয়ে। সংসারের সোনার লঙ্কায় নির্বাসিত আমাদের কাছে প্রিয়তমের দূত হয়ে, সুন্দরের দূত হয়ে আসে ফুল। আনন্দময়ের আনন্দস্পর্শে আমরা বুঝতে পারি এই সোনার লঙ্কাপুরীই আমার সব নয়। এর বাইরে আমার মুক্তি, আমার প্রেমের সাফল্য, আমার জীবনের সার্থকতা। ‘প্রকৃতির মধ্যে মধুকরের কাছে যা কেবলমাত্র রঙ, কেবলমাত্র গন্ধ, কেবলমাত্র ক্ষুধানিবৃত্তির পথ চেনার উপায়চিহ্ন, মানুষের হৃদয়ের কাছে তাই সৌন্দর্য, তাই বিনা প্রয়োজনের আনন্দ। মানুষের মনের মধ্যে সে রঙিন কালিতে লেখা প্রেমের চিঠি নিয়ে আসে।’
উপাসক কবি অনুভব করছেন শ্রাবণসন্ধ্যার ধারাপতনের যে ব্যস্ততা ঘাসেদের গাছেদের অন্নপানের ব্যবস্থা করার জন্য, আমাদের কাছে কিন্তু তার আভাসটুকুও সে দিচ্ছে না। ‘আমাদের অন্তরের সন্ধ্যাকাশেও এই শ্রাবণ অত্যন্ত ঘন হয়ে নেমেছে কিন্তু সেখানে তার আপিসের বেশ নেই, সেখানে কেবল গানের আসর জমাতে, কেবল লীলার আয়োজন করতে তার আগমন।’
‘প্রহরের পর প্রহর ধরে এই বার্তাই সে জানাচ্ছে, ওরে তুই যে বিরহিনী–’
যেসব খবরকে কোনও ভাষা দিয়ে বলা যায় না, সেসব খবরকে এরাই তো চুপি চুপি বলে যায় এবং মানুষ কবি সেইসব খবরকেই গানের মধ্যে কতকটা কথায়, কতকটা সুরে বেঁধে গাইতে থাকে: ‘ভরা বাদর, মাহ ভাদর, শূন্য মন্দির মোর।’
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২১। আত্মার স্বরূপ শূন্যতা নয়, নিখিলের প্রতি প্রেম
পর্ব ২০। ভিতরের সাধনা আরম্ভ হলে বাইরে তার কিছু লক্ষণ টের পাওয়া যায়
পর্ব ১৯। মানুষের পক্ষে মানুষ হয়ে ওঠা সব থেকে কঠিন
পর্ব ১৮। যে হৃদয় প্রীতিতে কোমল, দুঃখের আগুন তাকেই আগে দগ্ধ করে
পর্ব ১৭। সাধনায় সাফল্যের আভাস মিললে সেই পথচলা সহজ হয়
পর্ব ১৬। প্রকৃতি ব্যক্তিবিশেষ মানে না, তার কাছে সকলে সমান
পর্ব ১৫। যিনি অসীম তিনি সীমার আকর হয়ে উঠেছেন ইচ্ছার দ্বারা, আনন্দের দ্বারা
পর্ব ১৪। সংসার যেন স্যাকরা গাড়ির গাড়োয়ান আর আমরা ঘোড়া
পর্ব ১৩। জন্মোৎসবের ভিতরকার সার্থকতা খুঁজেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১২। বিশ্বপ্রকৃতির কাছে সামঞ্জস্যের সৌন্দর্য শিখেছিলেন রবীন্দ্রনাথ
পর্ব ১১। মানুষের নববর্ষ আত্মসংবরণের, দুঃখস্বীকারের নববর্ষ
পর্ব ১০। যে পাওয়ার স্বাদ পেলে মৃত্যুভয় চলে যায়
পর্ব ৯। আমাদের অবস্থা অনেকটা পৃথিবীর গোড়াকার অবস্থার মতো
পর্ব ৮। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি, মানুষকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম নয়
পর্ব ৭। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ
পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব