পূর্বাচলের যাত্রীরা প্রতিদিন যেমন নতুন নতুনকে পায়, অস্তাচলের যাত্রীদের তেমনি করে শুধু কি সব চলেই যায়? তাই যদি সত্যি হত, তাহলে সেই ভয়ংকর শূন্যতাকে প্রণাম জানাতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘বিষাদে আমাদের মুখ দিয়ে কথা বেরুত না, আতঙ্কে আমরা মরে যেতুম।’ তিনি উপলব্ধি করছেন, জীবনের সমস্ত যাওয়া কেবলই একটি পাওয়াতে এসে ঠেকছে। এই পাওয়াটাই আশ্চর্যতম পাওয়া।
১০.
‘আজকের বর্ষশেষের দিনাবসানের এই-যে উপাসনা, এই উপাসনায় তোমরা কি সম্পূর্ণমনে যোগ দিতে পারবে? তোমাদের মধ্যে অনেকেই আছ বালক, তোমরা জীবনের আরম্ভমুখেই রয়েছ। শেষ বলতে যে কী বোঝায় তা তোমরা ঠিক উপলব্ধি করতে পারবে না; বৎসরের পর বৎসর এসে তোমাদের পূর্ণ করছে, আর আমাদের জীবনে প্রত্যেক বৎসর নূতন করে ক্ষয় করবার কাজই করছে।’
১৩১৭ সালের ৩০ চৈত্র বর্ষশেষের সন্ধ্যার উপাসনায় রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিভাষণ আরম্ভ করেছিলেন এইভাবে। ‘বর্ষশেষ’ শিরোনামেই তা রয়েছে ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থে।
আমার কাছে এই ভাষণটি বড়ই জীবন্ত, বড়ই প্রাণবন্ত, বড়ই আপন। এই যে ‘তোমাদের মধ্যে অনেকেই আছ বালক’ বলে নির্দিষ্ট স্বীকৃতির সম্বোধনটি, সেটি যেন এক লহমায় আমাকে আমার কৈশোরের আমার মধ্যে নিয়ে যায়। সেই কিশোর মন তখন বক্তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে, অন্য দিনগুলিতে কি আপনার মনে হয় আমার মতো বালকেরা আপনার সঙ্গে উপাসনায় ‘সম্পূর্ণমনে’ যোগ দিতে পারি? প্রত্যুত্তরে পাই শুধু মুচকি হাসি। ১৩১৭ সালে বক্তার যে বয়স, সে বয়স পার হয়ে এসেও আজও নিজের বালক সত্ত্বাই প্রধান হয়ে থাকতে চায়। কিন্তু, ‘আমাদের জীবনে প্রত্যেক বৎসর নূতন করে ক্ষয় করবার কাজই করছে।’– এই ‘আমাদের’ দলেও ঢুকে পড়তে পারা সহজ হয়েছে অনেক।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
নদী তার গতিপথে দুই কূলে ক্রমাগত নতুনকে পেতে পেতে চলে। সমুদ্রে পৌঁছে তার সেই নতুন নতুন পাওয়ার পালা শেষ হয়। তখন তার দেওয়ার পালা। সেই ক্রমাগত দেওয়ার মধ্যেই তার অন্তহীন পাওয়া সত্য হয়ে ওঠে। আমরা জীবনপথের নানান সংগ্রহের থাকার মধ্যেই মনে করি সমস্ত কিছু আছে, সেসব ঘুচলেই সব বুঝি শেষ হয়ে যাবে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অভিভাষণের মূল সুরটি আমার মনের তারে অনায়াসে বাজতে থাকে। পূর্ব-পশ্চিমের মধ্যে তো ব্যবধান কোথাওই নেই। আজ যেখানে বর্ষশেষ, কাল সেখানেই বর্ষারম্ভ। পূর্ব-পশ্চিম তো একই অখণ্ড পরিমণ্ডলে সম্পূর্ণ হয়ে আছে। একই পাতার এক পৃষ্ঠায় সমাপন, অন্য পৃষ্ঠায় সমারম্ভ। একদিকে যিনি শিশুর আর একদিকে তিনিই বৃদ্ধের। বিচিত্র রূপের এই আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণে যিনি আমাদের একদিকে আশীর্বাদ করে পাঠাচ্ছেন, তিনিই আর একদিকে তাঁর এক স্বরূপের দিকে আশীর্বাদ করে ডেকে নিচ্ছেন। ভেদ নেই কোথাও। পূর্বাচলের যাত্রীরা সূর্যোদয়ের দিকে মুখ করে অভ্যুদয়ের আহ্বানকে প্রণাম করছে, আর পশ্চিম অস্তাচলের দিকে মুখ করে নমস্কার জানাচ্ছি যারা, তাদের কাছে যে আহ্বান আসছে, সেই আহ্বানও সুন্দর। সুন্দর, সুগম্ভীর, শান্তিরসে পরিপূর্ণ সে আহ্বান।
পূর্বাচলের যাত্রীরা প্রতিদিন যেমন নতুন নতুনকে পায়, অস্তাচলের যাত্রীদের তেমনি করে শুধু কি সব চলেই যায়? তাই যদি সত্যি হত, তাহলে সেই ভয়ংকর শূন্যতাকে প্রণাম জানাতে রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘বিষাদে আমাদের মুখ দিয়ে কথা বেরুত না, আতঙ্কে আমরা মরে যেতুম।’ তিনি উপলব্ধি করছেন, জীবনের সমস্ত যাওয়া কেবলই একটি পাওয়াতে এসে ঠেকছে। এই পাওয়াটাই আশ্চর্যতম পাওয়া। সব ক্ষতির শেষে অক্ষয়কে দেখতে পাওয়াই আমাদের পরম পাওয়া, যে পাওয়ার স্বাদ পেলে মৃত্যুভয় চলে যায়।
নদী তার গতিপথে দুই কূলে ক্রমাগত নতুনকে পেতে পেতে চলে। সমুদ্রে পৌঁছে তার সেই নতুন নতুন পাওয়ার পালা শেষ হয়। তখন তার দেওয়ার পালা। সেই ক্রমাগত দেওয়ার মধ্যেই তার অন্তহীন পাওয়া সত্য হয়ে ওঠে। আমরা জীবনপথের নানান সংগ্রহের থাকার মধ্যেই মনে করি সমস্ত কিছু আছে, সেসব ঘুচলেই সব বুঝি শেষ হয়ে যাবে। সেই আপনার দিকটাকে উজাড় করে দিয়ে না ফেলতে পারলে, পরিপূর্ণ পাওয়া যে হয়ে ওঠে না।
সংসারে ক্ষয়-ক্ষতি-মৃত্যু না থাকলে, অক্ষয়কে দেখার কোনও অবকাশই আমাদের থাকত না। তাহলে আমরা কেবলই বস্তুর পর বস্তু, বিষয়ের পর বিষয়কে দেখতে থাকতাম, সত্যকে দেখার সুযোগই আমরা পেতাম না। কিন্তু বিষয়বস্তুর ভার মেঘের মতো সরে সরে যায় বলেই, কুয়াশার মতো মিলিয়ে যায় বলেই, যা কখনওই সরে যায় না, মিলিয়ে যায় না, তাকে আমরা দেখতে পাই। জগতের সেই চলে যাওয়ার পথটির দিকে একবার বর্ষশেষের জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে শান্ত মনে দেখে নিতে পারি, সমস্ত যাওয়া সার্থক হচ্ছে এমন একটি ‘থাকা’ স্থির হয়ে আছে।
একদিকে অনেককে হারিয়েও আর একদিকে এককে পাওয়া যায়– এই কথাটি জানার সুযোগ আমাদের জীবনেই ঘটে। যা চাই এবং পাই না, যা পাই এবং চাই না, যা পেয়েও হারাই, সমস্তকেই যখন এক দিবাবসানের পরম মাধুর্যের মধ্যে দেখতে পাই, তেমন আনন্দ আর কিছু নেই।
‘বারে বারে খেলা শেষ হয়, কিন্তু, হে আমার জীবন-খেলার সাথি, তোমার তো শেষ হয় না। ধূলার ঘর ধূলায় মেশে, মাটির খেলনা একে একে সমস্ত ভেঙে যায়; কিন্তু যে তুমি আমাকে এই খেলা খেলিয়েছ, যে তুমি এই খেলা আমার কাছে প্রিয় করে তুলেছ, সেই তুমি খেলার আরম্ভেও যেমন ছিলে খেলার শেষেও তেমনি আছ। –এই সমস্ত ভাঙা খেলনার জোড়াতাড়া খেলা এ আর আমি পেরে উঠি নে। যা-কিছু ক্ষয় হবার দিকে যাচ্ছে সব লয় করে দাও– হে পরিপূর্ণ আনন্দ, পরিপূর্ণ নূতনের জন্যে আমাকে প্রস্তুত করো।’
…পড়ুন উপাসনাগৃহ-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৯। আমাদের অবস্থা অনেকটা পৃথিবীর গোড়াকার অবস্থার মতো
পর্ব ৮। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধি, মানুষকে ত্যাগ করা মানুষের ধর্ম নয়
পর্ব ৭। সমগ্র অখণ্ড সৃষ্টির সৌন্দর্য একটি গানের মতো পূর্ণ
পর্ব ৬। রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন উপনিষদ ভারতবর্ষের ব্রহ্মজ্ঞানের বনস্পতি
পর্ব ৫। ‘ঈশ্বর সর্বত্র আছেন’ কথাটা অভ্যাসের মতো হয়ে গেলে তার মধ্যে আর প্রাণ থাকে না
পর্ব ৪। আনন্দের ভাষা শেখাকেই রবীন্দ্রনাথ বলেছেন মুক্তির পথ
পর্ব ৩। সমগ্রের সঙ্গে যোগসাধনে আমাদের মঙ্গল
পর্ব ২। আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই
পর্ব ১। ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব
আমরা তো এদিকে হোম-ডেলিভারিকে বিদায় দিয়ে ততদিনে ভাতের হোটেলে বেঞ্চি বুক করে ফেলেছি। যে কোনও মেসতীর্থেই ধীরে জেগে ওঠে এই সব হোটেল। তাদের হোটেল বললে বড় পাঁচ-সাত তারা-রা কুপিত হতে পারে। না বললে, আমাদের সম্মানে লাগে।