কেন্দ্রের হিসেবে, বছরে ২৭,০০০ টাকা (মাসে ২,২৫০ টাকা) আয় করলেই কেউ আর গরিব নন। এই টাকায় একটা সংসার কতটা চলে, আদৌ চলে কি না, জনগণের টাকায় দিনে ৬০,১৮৫ টাকার জল-খাবার ওড়ানো নেতারা তা কি বোঝার ক্ষমতা রাখেন? ক্ষমতার দম্ভ, অহঙ্কারের ঠুলি চোখ থেকে সরালে তবেই না দেখবেন। দেশের মানুষকে দারিদ্রের অভিশাপ থেকে বের করে আনার দাবিও করতে হয়।
সুকুমার রায় তাঁর ‘হযবরল’-তে ৪১ নং গেছোবাজার, কাগেয়াপট্টির বাসিন্দা শ্রী কাক্কেশ্বর কুচকুচে-র মাধ্যমে ‘জটিল পাটিগণিত’-এর হিসেব দেখিয়েছিলেন। তাতে সবসময় সাত দু’গুণে চোদ্দো হয় না। ‘সময়ের দাম’ও ধরতে হয়। না হলে তেরো টাকা চোদ্দো আনা তিন পাই হিসেবের ভুলে চোদ্দো টাকা আনা নয় পাই হয়ে যেতে পারে! আমরা মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, অত জটিল অঙ্ক বুঝি না। আমাদের ভরসা ‘সরল পাটিগণিত’। সেই হিসেব বলছে– সাড়ে ৬ কোটিকে ১২ দিয়ে ভাগ করলে হয় প্রায় ৫৪ লক্ষ ১৭ হাজার। অর্থাৎ, মাসিক খরচ। তাকে ৩০ দিয়ে ভাগ করলে হয় প্রায় ১ লক্ষ ৮০ হাজার। অর্থাৎ, দৈনিক ব্যয়। আর সেটিকে ৩ দিয়ে ভাগ করলে দিনপিছু ৬০,১৮৫ টাকা!
অঙ্ক মাথায় ঢুকল না তো! আসুন, বুঝিয়ে দিই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সরকারি পদাধিকারী যখন, তখন সাক্ষাৎপ্রার্থী আসবেনই। হয়তো বা কিঞ্চিৎ অধিক পরিমাণেই। তাঁদের কি শুধু চা-সরবত দিলে অভদ্রতা হত? মুখ্যমন্ত্রী-উপমুখ্যমন্ত্রীদের সরকারি আবাসে নিশ্চিত কেউ খেতে আসেন না। আসেন প্রয়োজনের তাগিদে। নামী-অনামী যে-ই হোন না কেন, তাঁদের আপ্যায়নে এত বিপুল ব্যয় তবে কীসের জন্য? কচুড়ি, বড়া, দহিবড়া, অমলেট, মশলা ধোসা, স্যান্ডউইচ, বিশেষ দিনে আলাদা খাবারের থালি– এগুলি কি সত্যিই খুব প্রয়োজন ছিল? লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন, অর্থাৎ জনগণ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
ত্রেতা যুগে রামরাজ্যে ‘ঘরশত্রু’ বিভীষণ, স্বর্ণলঙ্কার সিংহাসন লাভ করেছিলেন। আর কী কী লাভ করেছিলেন, সে ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়োজন। আধুনিক রামরাজ্যেও বিভীষণের অভাব নেই। আর বিভীষণ যখন, তখন ‘পুরস্কার তো বনতা হ্যায়’। তাই দল ভেঙে সরকার ফেলে দিয়ে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছেন একনাথ শিন্ডে। আর একজন অজিত পাওয়ার, কাকার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে পেয়েছেন উপমুখ্যমন্ত্রীর পদ। রাজ্যে আরও একজন উপমুখ্যমন্ত্রী রয়েছেন– দেবেন্দ্র ফড়নবিশ। তো, এই তিনজনের তিন সরকারি বাসভবন– ‘বর্ষা’, ‘সাগর’ ও ‘দেবগিরি’তে খাবার ও পানীয় সরবরাহে রাজ্য সরকারের কোষাগার থেকে বছরে ৬.৫ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। অর্থাৎ, সরল পাটিগাণিতিক হিসেবে দৈনিক অতিথি সৎকার ও বাড়িগুলির বাসিন্দাদের খানাপিনার জন্য বরাদ্দ প্রায় ৬০,১৮৫ টাকা!
সরকারি পদাধিকারী যখন, তখন সাক্ষাৎপ্রার্থী আসবেনই। হয়তো বা কিঞ্চিৎ অধিক পরিমাণেই। তাঁদের কি শুধু চা-সরবত দিলে অভদ্রতা হত? মুখ্যমন্ত্রী-উপমুখ্যমন্ত্রীদের সরকারি আবাসে নিশ্চিত কেউ খেতে আসেন না। আসেন প্রয়োজনের তাগিদে। নামী-অনামী যে-ই হোন না কেন, তাঁদের আপ্যায়নে এত বিপুল ব্যয় তবে কীসের জন্য? কচুড়ি, বড়া, দহিবড়া, অমলেট, মশলা ধোসা, স্যান্ডউইচ, বিশেষ দিনে আলাদা খাবারের থালি– এগুলি কি সত্যিই খুব প্রয়োজন ছিল? লাগে টাকা, দেবে গৌরী সেন, অর্থাৎ জনগণ। বস্তুত আমাদের দেশের অধিকাংশ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি এই নীতিতেই বিশ্বাসী। জনগণের করের টাকায় এই বিলাসিতা, বৈভবের কুৎসিত প্রদর্শন কতটা গ্রহণযোগ্য, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা তা ভেবেও দেখেন না। অথচ বিরোধী আসনে থাকলেই তাঁদের বিবেক জাগ্রত হয়ে ওঠে। তখন এই ধরনের ‘অপচয়’ নিয়ে হাজার গণ্ডা বাইট, বিবৃতি দিতে তাঁদের কালক্ষেপ হয় না। আর গদিতে বসলেই আচরণ আমূল পাল্টে যায়। যে যায় লঙ্কায়, সে-ই হয় রাবণ!
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: ভোটের আগে আবার সিএএ ঘিরে চর্চা, মেরুকরণের রাজনীতি আজও ভোটের তুরুপের তাস
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও একটু অঙ্ক কষা যাক। ভারতে দরিদ্র কারা? দারিদ্রসীমার নীচে যাঁরা আছেন, তাঁদের চিহ্নিত করতে ২০০৯ সালে সুরেশ তেন্ডুলকরের নেতৃত্বে কমিটি গঠিত হয়েছিল। সেই কমিটির সুপারিশ মেনে ২০১৩ সালে প্ল্যানিং কমিশন দারিদ্রের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। শহরাঞ্চলে মাসিক হাজার টাকার বেশি আয় থাকলেই তিনি আর দরিদ্র নন! আর গ্রামাঞ্চলে সেটা মাসিক ৮১৬ টাকা! ২০১৪-য় রঙ্গরাজন কমিটির হিসেবে সেটা বেড়ে হয় যথাক্রমে ১,৪০৭ টাকা (দিনে ৪৭ টাকা) ও ৯৭২ টাকা (দিনে ৩২ টাকা)! কেন্দ্রের হিসেবে, বছরে ২৭,০০০ টাকা (মাসে ২,২৫০ টাকা) আয় করলেই কেউ আর গরিব নন। এই টাকায় একটা সংসার কতটা চলে, আদৌ চলে কি না, জনগণের টাকায় দিনে ৬০,১৮৫ টাকার জল-খাবার ওড়ানো নেতারা তা কি বোঝার ক্ষমতা রাখেন? ক্ষমতার দম্ভ, অহঙ্কারের ঠুলি চোখ থেকে সরালে তবেই না দেখবেন। দেশের মানুষকে দারিদ্রের অভিশাপ থেকে বের করে আনার দাবিও করতে হয়। একই সঙ্গে দেশের ৮০ কোটি মানুষকে আগামী পাঁচ বছর বিনামূল্যে রেশন দেওয়ার কথাও বড় গলা করে ঘোষণাও করতে হয়। সরকার বলছে, ভারতে বহুমাত্রিক দারিদ্রের কবলে থাকা মানুষের সংখ্যা কমছে। তাহলে, দেশের ৬০ শতাংশ মানুষকে বিনামূল্যে খাবার দেওয়ার প্রয়োজন হচ্ছে কেন?
অসংগঠিত ক্ষেত্রের কথা ছেড়ে দেওয়া যাক। সংগঠিত ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, ই-শ্রম পোর্টালে নথিভুক্ত প্রায় ২৮ কোটি শ্রমিকের ৯৪ শতাংশের মাসিক আয় ১০,০০০ টাকারও কম। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ‘হ্যান্ডবুক অফ স্ট্যাটিসটিকস অফ ইন্ডিয়ান স্টেট’-এর তথ্য বলছে, দেশে সর্বোচ্চ মাথাপিছু আয় গোয়ায় (বছরে ৪,৩১,৩৫১ টাকা)। জনসংখ্যা কম, বিদেশি পর্যটনে এগিয়ে। মহারাষ্ট্রের দিকে তাকালে দেখা যাবে, সে রাজ্যে মাথাপিছু গড় আয়, বছরে ১ লক্ষ ৯৩ হাজার ১২১ টাকা। আর মুখ্যমন্ত্রী, দুই উপমুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে এক মাসে জল-খাবারের খরচ প্রায় ৫৪ লক্ষ ১৭ হাজার টাকা! আমার-আপনার বৃহত্তর পরিধিতে কতজন মাসে ৫০ হাজারের বেশি উপার্জন করেন? হাতে গুণে বলা যায়।
শ্রীযুক্ত কাক্কেশ্বর কুচকুচে হিসেবে, ‘সময়ের দাম’ ধরেছিলেন। আমরাও না হয় ভ্যালু অ্যাডেড ট্যাক্স হিসেবে, ওই মহামহিমদের ‘শাসনের দাম’ যোগ করে নিই। না হলে অঙ্ক আরও জটিল হয়ে যাবে। লজ্জার আর শেষ থাকবে না।