জমিগুলো আগামী বহু বছরের জন্য ফসল ধারণের ক্ষমতা ফেলছিল হারিয়ে। সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হারাচ্ছিল এলাকায় থেকে রুটিরুজি উপার্জনের পথ। নানা পেশার মানুষগুলো হয়ে চলেছিল বেকার। ঠিক তার কিছু মাস পরেই প্রবীর মণ্ডল এবং আরও এরকম অনেক অনেক দলের, এই দ্বীপগুলো ছেড়ে আরও বেশি করে যাত্রা শুরু।
পোড়া গন্ধ আসছে নাকে। দু’-চার রকমের পোড়া গন্ধ। হালকা হালকা ধোঁয়া। টুকরো টুকরো মুরগির ঠ্যাং, বুক-পাঁজর পুড়ছে গনগনে আগুনে। কাবাবের তিন-চারটে আইটেম হচ্ছে। সবুজে, সাদা। টসটসে লাল। পোড়া পোড়া দাগ বাড়ছে শরীরের নানা মাংসে। সোনালি রঙের ঢাকা দেওয়া লাল-সবুজ সাদা সাদা ডিশ। আগুনের শিখা, ডানে-বাঁয়ে উঁকি মারছে।
লাল-হলুদ, নীল-সাদা আলো আড়াল থেকে জ্বলছে-নিভছে। ফ্যাকাসে মরা ফুল দিয়ে সাজানো দেওয়াল। বুফে সার্ভিসের টেবিলের পিছনে ফটফটে সাদা পোশাকের ছেলেরা হাঁ করে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। পার্টি চলছে সামনে। কিছু দূরেই সমুদ্র। পাথর। বাঁধানো রাস্তা। হাই রাইজ বিল্ডিং। রঙিন রঙিন লাইট। ঘিঞ্জি ঘিঞ্জি বস্তি। ভিড়ে ঠাসা লোকাল ট্রেন। মুম্বই শহর। বড় হোটেলের এই ঘরটাতে রং-বেরঙের তরল, গ্লাসে গ্লাসে সার্ভ হচ্ছে। চেয়ারে চেয়ারে সাদা আবরণ। টেবিলের জ্বলন্ত আগুনের পাত্রগুলোর তলায়, দুধ-সাদা চাদর ঝুলছে অনেক নিচ অবধি। হাই হিল, পেনসিল-হিল চামড়ার বুট, নকল চামড়ার বুট ডান থেকে বাঁয়ে সামনে পিছনে এগিয়ে চলেছে। কখনও ধাক্কা খাচ্ছে এ-ওর সঙ্গে। হালকা চালে। কখনও জোরে। খুব কাছে এসে পড়ছে, একটা অন্যটার। টেবিলের একেবারে নিচে মেঝের সাদা মার্বেল পাথর ছুঁয়ে আছে সাদা টেবিলক্লথ। না, না, পুরোটা নয়। একটুখানি ফাঁক। সেই ফাঁকা দিয়ে কী একটা উঁকি মারছে! ময়লা, ময়লা! ফস করে যখন সাদা আলোটা জ্বলে উঠছে, এক ঝলক যেন চোখে পড়ে যাচ্ছে ওই জায়গাটা। আবার লাল-সবুজ আলোয় অন্ধকার হয়ে গিয়ে আবার রঙিন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
স্টার্টার দেওয়া হয়ে গেল তারপর মেইন কোর্স। মেইন কোর্সে বুফে টেবিলের পেছনে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, যতক্ষণ না খাওয়া-দাওয়া সবার শেষ হয়। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সামনে গান হচ্ছে। ডিসকো নাচ করছে। পার্টি চলছে । ড্রিংক্স সার্ভ হচ্ছে। আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের ট্রেনিং-এ বলে দিয়েছিল, দু’পায়ে কখনই দাঁড়াবি না।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ফ্লোরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর দৃষ্টি ওপরের দিকে। কারওর চোখ, কারওর বুক, কারওর ঠোঁট, কারওর ঘাড়, কারওর গলার হার, কানের দুল, পিঠ পেটের দিকে। বিদেশি মিউজিকের চড়া সুর। সঙ্গে নাচ। গল্প। হাসি। ইয়ার্কি। ফাজলামি। হাতগুলো অন্য হাতে, কোমরে পিঠে চামচে কাঁটায়। ঝপ করে সাদা আলো জ্বলে উঠল। আবার সেই অন্ধকার জায়গাটা। টেবিলের নিচে ময়লা, ময়লা আবার কী একটা সামান্য চোখে পড়ে গেল। কী ওগুলো? ওগুলো বুট জুতো। পালিশ করা কালো কালো চকচকে বুট। বুটের তলায় কাদা ধুলো-মাটি-ময়লা । ডানে হেলানো বুট। উপুড় হয়ে আছে আরেকখানা। তার ডানে-বাঁয়ে দূরে আরও বুটজোড়া। বুটের ওপর থেকে পায়ের থাই-হাঁটু-কোমর-বুক। শ্বাস ফেলার শব্দ হচ্ছে ওখানে। বিদেশি মিউজিকের শব্দের সঙ্গে টেবিলের তলায় নাক ডাকার শব্দ মিলেমিশে যাচ্ছে। সাদা জামা, কালো প্যান্টে গোঁজা। বেল্টের বগলেসের ওপর থেকে সাদা জামার একটা কোনা খুলে বেরিয়ে এসেছে বাইরে। ঘুমোচ্ছে ওখানে কে কে? সুন্দরবনের লাক্সবাগানের প্রবীর মণ্ডল । বিনয় মণ্ডল। আরও কতগুলো নামের মানুষ। যাদের বাড়ি সাতজেলিয়া দ্বীপের লাহিড়িপুর মৌজার, এ-পাড়া সে-পাড়ায়।
এ-কথাগুলো বলেছিল প্রবীর মণ্ডল নিজেই।
‘স্টার্টার দেওয়া হয়ে গেল, তারপর মেইন কোর্স। মেইন কোর্সে, বুফে টেবিলের পেছনে আমাদের দাঁড়িয়ে থাকতে হবে, যতক্ষণ না খাওয়া দাওয়া সবার শেষ হয়। ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হবে। সামনে গান হচ্ছে। ডিসকো নাচ করছে। পার্টি চলছে । ড্রিংক্স সার্ভ হচ্ছে। আমরা ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। আমাদের ট্রেনিং-এ বলে দিয়েছিল, দু’পায়ে কখনই দাঁড়াবি না। দু’পায়ে দাঁড়ালে ডিউটি করতে পারবি না। ডান পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াবি একটু সময়। তারপর আবার আরেক পায়ে। এইভাবে পা পালটে পালটে দাঁড়াবি।’
পা দু’টোকে জড়ো করে, মুখে একগাল কাঁচা-পাকা দাড়ি নিয়ে বসে আছে আমার সামনে। লাহিড়িপুরের ধান-মাঠের মাঝে বাড়িখানা। বাড়িখানা প্রবীর মণ্ডলের নয়। অন্য লোকের বাড়িতে ওরা এসে জমা হয়েছে, আমার কাছে বলতে। নোনা মাটির এক ফসলি জমিতে কাজ করে, বেলা শেষে আমাকে বলতে বসেছিল। দরজার বাইরে কচি সবুজ ধানের ওপর তখন শেষ বিকেলের হালকা রোদ, সেদিনের মতো শেষবার ছুঁয়ে যাচ্ছে। সেদিকে পিঠ দিয়ে প্রবীর মণ্ডল আমার দিকে তাকিয়ে বসা। ডানে-বাঁয়ে আরও কয়েকজন মাইগ্র্যান্ট লেবার। কেউ এসেছে ছুটিতে। কেউ এসেছে কাজ ছেড়ে দিয়ে।
প্রবীর মণ্ডল আবার এখন উত্তরপ্রদেশের চাষের কাজের লেবার। যাওয়া শুরু হয়েছিল ২০০৯-এ। সে-বছর আয়লায় এই লাহিড়িপুর সাতজেলিয়া দ্বীপ, অন্যান্য দ্বীপের ধান জোয়ারের জলে প্রতিদিন ডুবে চলেছিল। সমুদ্রের নোনাজল, মাথাভাঙা, বিদ্যাধরী, মাতলা, দুর্গাদুয়ানী, দয়াল, গোমর নদীর জলে মিলেমিশে একাকার হয়ে চলেছিল। জমিগুলো আগামী বহু বছরের জন্য ফসল ধারণের ক্ষমতা ফেলছিল হারিয়ে। সুন্দরবনের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম হারাচ্ছিল এলাকায় থেকে রুটিরুজি উপার্জনের পথ। নানা পেশার মানুষগুলো হয়ে চলেছিল বেকার। ঠিক তার কিছু মাস পরেই প্রবীর মণ্ডল এবং আরও এরকম অনেক অনেক দলের, এই দ্বীপগুলো ছেড়ে আরও বেশি করে যাত্রা শুরু। যখন মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোনোর পর এগারো ক্লাসে ভর্তির লাইনে দাঁড়ানোর কথা ছিল। ওরা দাঁড়াল এক্সপ্রেস ট্রেনের জেনারেল বগির গেটের বাইরের লাইনে, সপ্তাহ শেষে খড়চি পাওয়ার লাইনে, থালা হাতে ভাতের ওপর ডাল-সবজির ঝোল পাওয়ার লাইনে, আর দশটা লেবারের সঙ্গে। প্রবীর মণ্ডল গিয়েছিল আন্দামান। তারপর বদলাতে থাকে গন্তব্য। কাজ। কখনও হোটেল-বয়। কখনও রাজমিস্ত্রির জোগাড়ে। কখনও ধানচাষের লেবার।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: হারিয়ে যাওয়া শহরটাকে, আবার খুঁজে পেতে খুব ইচ্ছে করে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
হোটেলের সার্ভিস-বয়ের কাজ তো ভালো। সেটা ছেড়ে আবার ধান মাঠের লেবার হলেন কেন? রোদ, ঝড়-জলে মাঠে কাজ করাটা অনেক বেশি কষ্টের না?
আমার এ প্রশ্ন শুনে মুচকি হেসেছিল প্রবীর মণ্ডল। ‘সব কাজের মধ্যে হোটেলের কাজ সবচেয়ে খাটনির দিদি। বড় খাটনি দিদি, ও কাজে। মাঠের লেবারি করা তার চেয়ে ভালো। আমি তো অনেকগুলো শহরে হোটেলের কাজ করেছি, জানি। বোম্বে, পুণা আরও গিয়ে আপনার নয়ডা।’
হাতের কড় গুনতে গুনতে, অন্য হাতে মাথা চুলকে নিয়ে শহরগুলোর নাম মনে করে বলে চলেছিল বছর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশের প্রবীর। এরই মাঝে কখনও একটা হোটেল ম্যানেজমেন্টের ট্রেনিং নিয়েছিল।
‘আমাদের ট্রেনিং-এ বলেছিল, পা বদলে বদলে দাঁড়াবি। সেই রকমই দাঁড়াতাম। বিকাল থেকে সেই টেবিল সাজানোর পর থেকে শুরু। তার আগেও অনেক কাজ। কোনও কাজ হোটেলে বাদ যেত না। চাদর বিছিয়ে ঝাড়া-মোছা করে, সব রেডি করে গিয়ে দাঁড়ানো। বুফে টেবিলে খাওয়া, নাচ-গান, সব চলত। সামনে কত বড় বড় মানুষ দেখেছি। হিরো-হিরোইন তারা নাচছে গাইছে। ডিস্কো নাচ। কী সব, কী সব নাচ! ড্রিংক করত। সেই কী টলত সব। তাদের ঘাড়ে করে নিয়ে যেত আবার লোক। সব খাওয়া-দাওয়া শেষ হবে, সে কত রাত! সেই অবধি ওই রকম।’
আপনাদের খাওয়া দাওয়া ! ওই একই খাবার আপনাদেরও?
‘না না সে কি হয়? আমাদের খাওয়া সব শেষে। পার্টির শেষে, গুছিয়ে বাগিয়ে বাসনপত্র তুলে। ডাল-রুটি দিত আমাদের। আমরা সেই ঠায় দাঁড়িয়ে ততক্ষণ। ডান পায়ে, বাঁ পায়ে। খালি বদলাই, খালি পা বদলাই। তাও আর পারতাম না দাঁড়াতে। সে কী পা টনটন টনটন করত! শেষে লুকিয়ে, টুক করে ওই খাবার টেবিলের নিচে শুয়ে পড়তাম।’
শুয়ে পড়তেন? জায়গা পেতেন শোয়ার?
‘সে কি বাড়ির বিছানায় শোয়ার মতো শোয়া? বেঁকিয়ে তেড়িয়ে ওই একটু হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তাম। এ-ওর ঘাড়ে পা তুলে ঘাড় মাথা ঠেসাঠেসি করে শুতাম। ওপরে খাওয়া-দাওয়া চলত, আমোদ-আহ্লাদ চলত। সব ব্যস্ত। সেই সুযোগে, আমরা আড়াল করে টেবিলের তলায় ঘুমিয়ে থাকতাম। আধা আধা জেগে ঘুমাতাম। ভয়ে থাকতাম। তাও ঘুমাতাম। চোখ ঠেলে ঘুম এসে যেত, সারাদিন ওই হাড়ভাঙা খাটুনির পর।’
প্রবীর মণ্ডলের পিঠের পেছন দিয়ে, কচি ধানের শরীরের রোদ ততক্ষণে সেখান থেকে হাওয়া হয়ে গিয়ে জমাটবাঁধা অন্ধকার নেমে এসেছে মাঠের ওপর। অন্ধকারের সঙ্গে সঙ্গে দু’-চারটে পোকার কীরকম একটা শব্দ, ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো প্রবীর মণ্ডলের কথার সঙ্গে সঙ্গে কানে আসছে।
অন্ধকার বাড়ছে। এই ধানমাঠ, কাঁঠাল সুন্দরী, হেতাল জঙ্গল ছাড়িয়ে, কাদা মাটি ছাড়িয়ে মাতলা-বিদ্যা-গমর ছাড়িয়ে, সমুদ্র ছাড়িয়ে দূরে কোনও হাইরাইজ বিল্ডিং-এর রুমে রুমে আলো জ্বলে উঠেছে। বাজছে মিউজিক। পা দুটোর হাড় টনটন করছে। ব্যথাটা পায়ের আঙুল, গোড়ালি থেকে উঠতে উঠতে, হাঁটু থেকে একবারে কোমরে উঠে আসতে শুরু করেছে। হাড়, শিরা, মাংস-মজ্জার ব্যথাটা বুঝিয়ে দিচ্ছে পা দু’টো আছে। পা দু’টো নড়ছে-চড়ছে, কাঁপছে। জ্বলছে পায়ের তলার চামড়া। মোজার ভেতর আঙুলগুলো বেঁকে-তেড়ে যাচ্ছে। বুটগুলো বেঁকে-তেড়ে যাচ্ছে। কালো চামড়ায় ভাঁজ পড়ছে। শ্বাস পড়ছে জোরে জোরে। চোখগুলো ভারী হয়ে লেগে আসছে। পেট-বুক-পায়ের ওপর অন্যান্য মাথা এলিয়ে পড়ছে। মাথার ওপর সাদা চাদরে ফোঁটা ফোঁটা গড়িয়ে পড়েছে লাল লাল ঝোল…।