জ্যোতি তাকিয়ে জ্ঞানদার আলুথালু রূপের দিকে। জ্ঞানদার হুঁশ নেই সে কতটা আলগা। কতখানি খোলামেলা। জ্যোতির ইচ্ছে করে, দু’চোখ ভরে শুষে নিতে মেজবউঠানের এই রূপ। তারপর তাকে নিবিড়ভাবে টেনে নিতে নিজের মধ্যে। কিন্তু সে সেসব কিছুই করে না। শুধু বলে, তুমি এখনও আমার বিয়ে নিয়ে ভাবছ? এ-বিয়ে কিন্তু হবেই মেজবউঠান।
২১.
তোমাকে ছাড়া বাঁচব না নতুন!
এইমাত্র জ্ঞানদা বেরিয়ে গেল জ্যোতিরিন্দ্রর ঘর থেকে। সে জানে, না না, সে নিশ্চিত, তার শেষ বাক্যটি নতুনের বুকে বেজেছে। ‘কে আবার, তোমার বেপাত্তা শাশুড়ি’– এ বড় সহজ বাক্য নয়। নতুন গিলতে এবং হজম করতে কষ্ট পাবে আজীবন। জ্ঞানদা বুঝে গেছে, জ্যোতিরিন্দ্র এই প্রথম শুনল ত্রৈলোক্যসুন্দরীর নাম! যে-মেয়েকে বিয়ে করতে চলেছে জ্যোতি, তার মাতৃপরিচয় সে জানে না! সে কেন? ঠাকুরবাড়ির কেউ কি জানে? সেই মেয়েমানুষের মেয়েরা, বরোদা, মনোরমা, কাদম্বরী, শ্বেতাম্বরী– এই বাড়িতেই চোখের সামনে দিনে-দিনে ধিঙ্গি হয়ে উঠছে। তাদের বাপ-ঠাকুরদাকে সবাই চেনে। অথচ তাদের মা-টা গেল কোথায়? কাদম্বরীর সঙ্গে বিয়ের আগে ত্রৈলোক্যসুন্দরীকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব কি উড়িয়ে দেওয়া যায়?
জ্ঞানদা নিজের ঘরে ঢুকে পালঙ্কে নিজেকে বিছিয়ে দেয়। এবং বালিশে মাথা দিয়ে প্রথম যে ভাবনাটি তাকে নিশ্চিত করে, তা হল, তার শেষ তুরুপের তাসটি এখনও হাতেই আছে। সেটি সে খেলবে সন্ধেবেলা, ছাদে, কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারে।
জ্ঞানদা ঘর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরেই জ্যোতিরিন্দ্রর মুখে ফুটে ওঠে বাঁকা হাসি। মেজবউঠান ইজ ডেসপারেটলি ইন লাভ উইথ মি! তার এই অনিবার্য সত্যটুকু বুঝতে আর এতটুকু সংশয় নেই। এবং মেজবউঠান যে তার বিয়ে ঠেকাতে যতদূর যাওয়া যায়, যাবেই, তাতেও সন্দেহ নেই। মেয়েরা প্রেমে পড়লে কতদূর ডেসপারেট হতে পারে, বিশেষ করে বিবাহিত নারী যদি মনে মনে বিয়ের বাইরে পা ফেলে, সেই অবৈধ প্রেম যে কোন তুফানকে ডাক দিতে পারে, তা বিশ্বসাহিত্য থেকে হাড়ে হাড়ে জেনেছে জ্য়োতিরিন্দ্র। এই কারণেই তো নারীর মন তাকে টানে। আবার এই কারণেই নারীর মনকে সে ভয়ও পায়। হঠাৎ তার মনে আসে লর্ড বায়রনের অবিস্মরণীয় লাইন প্রেমে-পড়া নারীর টান ও সাড়া প্রসঙ্গে : ‘She walks in beauty like the night/One shade the more, one ray the less,/Had half impaired the nameless grace.’ এই মুহূর্তে জ্যোতির মনে হয়, বায়রন তাঁর এই লাইনগুলি লিখেছেন অবৈধ প্রেমে ভেসে-যাওয়া নারীর সৌন্দর্য প্রসঙ্গেই। রাতের অন্ধকারের সৌন্দর্যই এই নারীর প্রেমে প্রকাশিত হয়! সেই প্রকাশে এক চুল এদিক-ওদিক হওয়ার জো নেই! তাহলেই নষ্ট হবে সেই মেয়ের অনির্বচনীয় মাধুরী! মেজবউঠানের মধ্যে ফুটে উঠেছে তীব্র ঈর্ষা! কিন্তু কী অপার মাধুর্য সেই ঈর্ষাতেও! আমি কী ভাগ্যবান, এই ঈর্ষা-আলোকিত প্রেম ও নারী পেয়েছি, মনে হয় জ্যোতির।
মেজবউঠানের মতোই সে-ও নিজেকে বিছিয়ে দেয় পালঙ্কে! চোখ বুজে ভাবতে চেষ্টা করে। সে ক্রমশ নিশ্চিত বোধ করে একটি বিষয়ে। তার বিয়ে হচ্ছেই আগামী ৫ জুলাই। এই নিয়তিকে ঠেকানোর ক্ষমতা কারও নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্যোতির মনে হয়, এই বিয়ে শুধু হবেই না, হওয়া উচিত। যদি সত্যিই ‘কাদম্বরী’ নামের ওই একরত্তি মেয়েটার তেমন যুৎসই মাতৃপরিচয় না-ও পাওয়া যায়, তাতে কী? ত্রৈলোক্যসুন্দরী শুধু নাম হয়েই থাক না! ভারতের কোন শাস্ত্রে, কোন সাহিত্যে বিবাহের জন্য প্রয়োজন হয়েছে মাতৃপরিচয়ের গৌরব-স্বাক্ষর? বাবামশায় তোয়াক্কাতেই আনবেন না ত্রৈলোক্যসুন্দরী এই বিয়েতে উপস্থিত থাকলেন কি থাকলেন না! যিনি এই বাড়ির বিয়ে থেকে নারায়ণ শিলাকে উড়িয়ে দিয়েছেন, তিনি কাদম্বরীর মায়ের পরিচয় নিয়ে মাথা ঘামাবেন? অসম্ভব! বরং খুশিই হবেন ত্রৈলোক্যসুন্দরীর অনুপস্থিতিতে। সেই মালিন্যের লজ্জা বাবামশায় চাইবেন না! সুতরাং ত্রৈলোক্যসুন্দরী যে থেকেও নেই, ঠাকুরবাড়ির পক্ষে এ বরং শাপে বর!
এইসব ভাবনায় মশগুল জ্যোতিরিন্দ্র পালঙ্কে বিশ্রান্ত অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা তন্দ্রাচ্ছন্ন। নিজের ঘরে পালঙ্কাশ্রিত জ্ঞানদার ভেতরে কিন্তু ক্রমেই বাড়ছে ছটফটানি। তার শেষ তুরুপের তাস আর হাতে ধরে রাখতে পারছে না। কোমরে চাবির তোড়া আর পায়ে নুপুরের শব্দ তুলে আরও একবার জ্যোতির ঘরে ঢুকল ঝড়ের মতো। আর রাত্রে কৃষ্ণপক্ষের অন্ধকারের জন্য অপেক্ষা নয়। বরং দিনের আলোতেই যা হওয়ার হয়ে যাক। অন্তত জুলাইয়ের পাঁচ তারিখে এ-বিয়ে হতে পারে না। এ বাড়ির বউ আমি। এতবড় অনাচার এ-বাড়িতে ঘটতে দিতে পারি না।
জ্ঞানদা ভেবেছিল, জ্যোতি এখনও তার লেখার টেবিলে বসে তার শেষ বাক্যের ধাক্কাটা সামলানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু জ্যোতিরিন্দ্র। মেজবউঠানের এই রূপ সে বেশি দেখেনি।
জ্ঞানদার সারা শরীরে যেন ঝড় উঠেছে। তার চুল, আঁচল, সারা দেহ আলুথালু। জ্ঞানদা ঘরে ঢুকে ছুটে এল জ্যোতির কাছে। তার দু’-কাঁধ ধরে ঝাকুনি দিয়ে বলল, নতুন, তোমার এত বড় সর্বনাশ হতে যাচ্ছে, আর তুমি দিব্য ঘুমিয়ে আছ!
জ্যোতি তাকিয়ে জ্ঞানদার আলুথালু রূপের দিকে। জ্ঞানদার হুঁশ নেই সে কতটা আলগা। কতখানি খোলামেলা। জ্যোতির ইচ্ছে করে, দু’চোখ ভরে শুষে নিতে মেজবউঠানের এই রূপ। তারপর তাকে নিবিড়ভাবে টেনে নিতে নিজের মধ্যে। কিন্তু সে সেসব কিছুই করে না। শুধু বলে, তুমি এখনও আমার বিয়ে নিয়ে ভাবছ? এ-বিয়ে কিন্তু হবেই মেজবউঠান।
–এ-বিয়ে হবে না। কিছুতেই হবে না। অন্তত ৫ জুলাই তো নয়ই।
–কেন?
–জন্মদিন!
–কার জন্মদিন?
–কার আবার। ওই মেয়ের!
–কোন মেয়ের?
–ও, বারবার ওই নামটা শুনতে চাও, কানে মধু ঢালে! কার আবার! কাদম্বরীর জন্মদিন!
–তাতে কী?
–জন্মদিনে হিন্দু বিয়ে হয় না নতুন। এবং এই অনাচার আমি এ-বাড়িতে হতে দেব না, দেব না, দেব না!
–মেজবউঠান, আমরা হিন্দু নই। বাবামশায় তেত্তিরিশ কোটি হিন্দু দেবদেবীর একটিকেও তাঁর জীবনে এবং আমাদের সংসারে স্থান দেননি। তিনি এবং আমরা প্রত্যেকে একেশ্বরবাদী ব্রাহ্ম।
–তা’বলে জন্মদিনে বিয়ে? সম্ভব?
–জন্মদিনে বিয়ে হলে কী হয়?
–সর্বনাশ হয়। সংসারে অমঙ্গল আসে। বিয়ে সুখের হয় না নতুন।
–কোন বিয়ে কবে কোথায় সুখের হয়েছে বলতে পার? বিয়ে তো সংসার এবং সমাজের জন্য। সুখের জন্য নয়।
–তুমি বুঝতে পারছ না নতুন, জন্মদিনে বিয়ে সর্বনাশ ডেকে আনে।
–বিয়ের চেয়ে বড় সর্বনাশ আর কী থাকতে পারে?
জ্যোতিরিন্দ্রর এই আকস্মিক, অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন কিছুক্ষণের জন্য থামিয়ে দেয় জ্ঞানদাকে।
–কাদম্বরীর জন্মদিন যে ৫ জুলাই তুমি জানলে কী করে মেজবউঠান?
–সেদিন উঠোনে বোনেদের সঙ্গে খেলা করতে করতে ওই মেয়ে নিজেই খুশি হয়ে বারবার বলছিল, কী মজা, কী মজা, আমার জন্মদিনে আমার বিয়ে, আমার বিয়ে! আমি নিজের কাছে শুনেছি।
–ব্যস, তাতেই বিশ্বাস করলে?
–না, ওর বাপ সেদিন এল বাজার নিয়ে কুটনোর ঘরে। আমি সেদিন কুটনো কুটছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, কাদম্বরীর জন্মদিন কবে জানো? বলল, ১৮৫৯-এর ৫ জুলাই। আমি বললুম, তাহলে কোন আক্কেলে ওইদিন মেয়ের বিয়ে দিচ্ছ! বাবামশায়কে জানাওনি ওইদিন তোমার মেয়ের জন্মদিন, বিয়ে হতে পারে না।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
মেজবউঠানের মতোই সে-ও নিজেকে বিছিয়ে দেয় পালঙ্কে! চোখ বুজে ভাবতে চেষ্টা করে। সে ক্রমশ নিশ্চিত বোধ করে একটি বিষয়ে। তার বিয়ে হচ্ছেই আগামী ৫ জুলাই। এই নিয়তিকে ঠেকানোর ক্ষমতা কারও নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই জ্যোতির মনে হয়, এই বিয়ে শুধু হবেই না, হওয়া উচিত। যদি সত্যিই ‘কাদম্বরী’ নামের ওই একরত্তি মেয়েটার তেমন যুৎসই মাতৃপরিচয় না-ও পাওয়া যায়, তাতে কী?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
–জানিয়েছি। বলেওছি, আপনি দয়া করে দিনটা আগুপিছু করুন কর্তামশায়। কিন্তু উনি বললেন, ওইসব হিন্দু কুসংস্কার উনি মানেন না। এই বিয়ে ওই দিনই হবে।
–তারপরেও তুমি যেরকম করে হোক, এ-বিয়ে রুখতে চাইছ!
–হ্যাঁ তা-ই! তোমাকে ছাড়া বাঁচব না নতুন! তাই এই বিয়ে হবে না!
(চলবে)
…মেজবউঠাকরুণ-এর অন্যান্য পর্ব…
মেজবউঠাকরুণ ২০: স্বামী সম্বন্ধে জ্ঞানদার মনের ভিতর থেকে উঠে এল একটি শব্দ: অপদার্থ
মেজবউঠাকরুণ ১৯: কাদম্বরী ঠাকুরবাড়িতে তোলপাড় নিয়ে আসছে
মেজবউঠাকরুণ ১৮: নতুনকে কি বিলেত পাঠানো হচ্ছে?
মেজবউঠাকরুণ ১৭: চাঁদের আলো ছাড়া পরনে পোশাক নেই কোনও
মেজবউঠাকরুণ ১৬: সত্যেন্দ্র ভাবছে জ্ঞানদার মনটি এ-বাড়ির কোন কারিগর তৈরি করছে
মেজবউঠাকরুণ ১৫: জ্ঞানদার কাছে ‘নতুন’ শব্দটা নতুন ঠাকুরপোর জন্যই পুরনো হবে না
মেজবউঠাকরুণ ১৪: জ্যোতিরিন্দ্রর মোম-শরীরের আলোয় মিশেছে বুদ্ধির দীপ্তি, নতুন ঠাকুরপোর আবছা প্রেমে আচ্ছন্ন জ্ঞানদা
মেজবউঠাকরুণ ১৩: বিলেতে মেয়েদের গায়ে কী মাখিয়ে দিতে, জ্ঞানদার প্রশ্ন সত্যেন্দ্রকে
মেজবউঠাকরুণ ১২: ঠাকুরবাড়ির দেওয়ালেরও কান আছে
মেজবউঠাকরুণ ১১: ঠাকুর পরিবারে গাঢ় হবে একমাত্র যাঁর দ্রোহের কণ্ঠ, তিনি জ্ঞানদানন্দিনী
মেজবউঠাকরুণ ১০: অসুস্থ হলেই এই ঠাকুরবাড়িতে নিজেকে একা লাগে জ্ঞানদানন্দিনীর
মেজবউঠাকরুণ ৯: রোজ সকালে বেহালা বাজিয়ে জ্ঞানদার ঘুম ভাঙান জ্যোতিঠাকুর
মেজবউঠাকরুণ ৮: অপ্রত্যাশিত অথচ অমোঘ পরিবর্তনের সে নিশ্চিত নায়িকা
মেজবউঠাকরুণ ৭: রবীন্দ্রনাথের মায়ের নিষ্ঠুরতা টের পেয়েছিলেন জ্ঞানদানন্দিনী
মেজবউঠাকরুণ ৬: পেশোয়াজ অন্দরমহল আর বারমহলের মাঝখানের পাঁচিলটা ভেঙে দিল
মেজবউঠাকরুণ ৫: বাঙালি নারীশরীর যেন এই প্রথম পেল তার যোগ্য সম্মান
মেজবউঠাকরুণ ৪: বৈঠকখানায় দেখে এলেম নবজাগরণ
মেজবউঠাকরুণ ৩: চোদ্দোতম সন্তানকে কি ভুল আশীর্বাদ করলেন দেবেন্দ্রনাথ?
মেজবউঠাকরুণ ২: তোমার পিঠটা কি বিচ্ছিরি যে তুমি দেখাবে না বউঠান?
মেজবউঠাকরুণ ১: ঠাকুরবাড়ির বউ জ্ঞানদাকে ঘোমটা দিতে বারণ দেওর হেমেন্দ্রর