ঠাকুরবাড়ির লম্বা দক্ষিণের বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায় জ্ঞানদা। কতদূরে বিলেত? যার নাম ইংল্যান্ড! জ্ঞানদা ভেবে কোনও ঠাওর পায় না সেই দূরত্বর। সে শুধু জানে, বিয়ের পরেই তো তার বর সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে ফেলে বিলেত চলে গেল আই.সি.এস, না কি একটা হতে! বরের মুখটা যেন আকাশের গায়ে ভেসে উঠল। জ্ঞানদা দুধে-দাঁতটা তার বরকে দেখাল, দুধে-দাঁত ধরা হাতটা আকাশের দিকে বাড়িয়ে। লিখছেন রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়।
১.
অনেক দিন ধরেই পড়ো-পড়ো করছিল। কিন্তু এইমাত্র পড়ল। আরও একটি দুধে-দাঁত। সাত বছরের ঘোমটা-টানা জ্ঞানদানন্দিনীর। আর সবে পড়া দাঁত হাতে নিয়ে জ্ঞানদার চোখ জলে ঝাপসা হল। মা নিস্তারিণীর কথা ভেবে।
জ্ঞানদানন্দিনীর বাবা অভয়াচরণ মুখোপাধ্যায়, মা নিস্তারিণী দেবী এখন অনেক দূরের মানুষ। তাঁরা থাকেন পুব বাংলার যশোরের নরেন্দ্রপুর গ্রামে। ডাকলেই তাঁদের সাড়া পাওয়ার আর জো নেই। আগের দাঁতটা যখন পড়েছিল, মা-র কাছেই ছুটে গিয়েছিল জ্ঞানদা দাঁত হাতে। এখন কার কাছে যাবে? বরের কাছে?
ঠাকুরবাড়ির লম্বা দক্ষিণের বারান্দার এককোণে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকায় জ্ঞানদা। কতদূরে বিলেত? যার নাম ইংল্যান্ড! জ্ঞানদা ভেবে কোনও ঠাওর পায় না সেই দূরত্বর। সে শুধু জানে, বিয়ের পরেই তো তার বর সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাকে ফেলে বিলেত চলে গেল আই.সি.এস, না কি একটা হতে! বরের মুখটা যেন আকাশের গায়ে ভেসে উঠল। জ্ঞানদা দুধে-দাঁতটা তার বরকে দেখাল, দুধে-দাঁত ধরা হাতটা আকাশের দিকে বাড়িয়ে।
আর তখুনি মনে পড়ল তার শাশুড়িমা সারদাসুন্দরীকে। সারদাসুন্দরী খুব ভালবাসেন জ্ঞানদাকে। তিনিই তো ছোট্ট জ্ঞানদাকে পছন্দ করে মেজ ছেলে সত্যেন্দ্রর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছেন। বিকেলবেলা ছাদে কিছুক্ষণ কোলের ওপর বসিয়ে আদর করেন। কিন্তু সে তো শুধু বিকেলবেলা। যখন-তখন শাশুড়িমা-র কাছে যাওয়া যায় না। এখন দুপুর।
এখন সারদাসুন্দরী ঘুমচ্ছেন। এখন তো তাঁর কাছে যাওয়াই যায় না। জ্ঞানদা ছলছল চোখে তাকায় আকাশের দিকে। সবে পড়া দুধে-দাঁত আরও একবার তুলে ধরে আকাশপানে। আলতো স্বরে বলে, তোমার জ্ঞানুর আরও একটা দাঁত পড়ল গো। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে কোথায় ইঁদুরের গর্ত আছে, তুমি জানো? তুমি তো আমার বর, তুমি আমাকে বলে দাও, তোমাদের এই মস্ত বড় পাকা ইটচুনের বাড়িতে আমি কোথায় খুঁজে পাব ইঁদুরের গর্ত?
মা নিস্তারিণী অবিশ্যি মন্তরটা শিখিয়ে দিয়েছেন মেয়ে জ্ঞানদাকে। পই পই করে বলে দিয়েছেন, দাঁত পড়লেই ইঁদুরের গর্তে দাঁতটা ফেলে বলবি, ‘ওগো ইঁদুর, পড়া দাঁত তুমি নাও, তোমার দাঁত আমায় দাও।’ তাহলে দেখবি তোর নতুন দাঁত গজাবে, ইদুঁরের মতো ছোট-ছোট সুন্দর দাঁত। জোড়াসাঁকোর বাড়িতে ইঁদুরের অভাব নেই। কিন্তু ইঁদুরের একটিও গর্ত সারা বাড়িতে খুঁজে পাচ্ছে না জ্ঞানদা। মা কাছে থাকলে ঠিক ইঁদুরের গর্ত খুঁজে দিত। জ্ঞানদার চোখ কান্নায় আবার ঝাপসা হয়ে যায়। এই অবস্থায় খোঁজা যায় ইঁদুরের গর্ত? কেউ পারে? অসহায় কান্নাভেজা মনে প্রশ্নটা জ্ঞানদা করে তার দুই ভালবাসার মানুষকে– মা নিস্তারিণী, বর সত্যেন্দ্রনাথকে! তারপর ইঁদুরের গর্ত খুঁজতে-খুঁজতে দক্ষিণের বারান্দার অন্য প্রান্তের দিকে এগিয়ে যায়।
আর তক্ষুনি সে দেখতে পায় হেমেন্দ্রকে। হেমেন্দ্র একইসঙ্গে জ্ঞানদার দেওর, বন্ধু, মাস্টারমশাই। বছর ১৪-এর হেমেন্দ্র জ্ঞানদার থেকে ৭ বছরের বড়। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের বড় ছেলে দ্বিজেন্দ্রনাথ। মেজছেলে সত্যেন্দ্র, জ্ঞানদার স্বামী। আর সেজছেলে হেমেন্দ্র। হেমেন্দ্রকে দেখেই ধড়ে প্রাণ এল জ্ঞানদার। হেমেন্দ্রই তাকে তার সামনে ঘোমটা দিতে বারণ করেছে। বলেছে, ঘোমটা দিয়ে বসলে জ্ঞানদাকে পড়ানো ছেড়ে দেবে সে। কিন্তু হেমেন্দ্রর ওপরেই জ্ঞানদার লেখাপড়ার ভার দিয়ে গিয়েছে জ্ঞানদার বর! অতএব মাথা থেকে ঘোমটা সরিয়ে উদ্ভ্রান্তভাবে জ্ঞানদা ছুটে যায় হেমেন্দ্রর কাছে। হেমেন্দ্র দ্যাখে, একটি খুদে দাঁত ঝকমক করছে জ্ঞানদার দুই আঙুলের ডগায়।
–ঠাকুরপো, একটা ইঁদুরের গর্ত দেখাতে পারো? আমার দুধে-দাঁত ইঁদুরের গর্তে দিতে বলেছে মা। না দিতে পারলে সর্বনাশ। মুলোর মতো দাঁত হবে আমার!
–ওই তো নেংটির গর্ত। চৌকাঠের কোণে। ওখানেই থাকে একটা নেংটি। আমি জানি! বলে, হেমেন্দ্র।
তুমি কত কী জানো ঠাকুরপো! পরম বন্ধু এবং অসাধারণ গল্প-বলিয়ে মাস্টারমশাইকে জড়িয়ে ধরে জ্ঞানদা। তারপর খুব যত্নে দুধে-দাঁতটি নেংটির গর্তে গলিয়ে দিয়ে বলে, ‘ওগো নেংটি, তুমি আমার দুধে-দাঁত নাও, তোমার খুদে দাঁত দাও’। মায়ের দেওয়া মন্ত্র আরও জব্বর করে বলে জ্ঞানদা। হেমেন্দ্র হেসে বলে, মেজবউঠাকরুণ, এসব মেয়েলি সংস্কার এক্কেবারে ভুলতে হবে। মেজদাদা কিন্তু বিলেত থেকে পাক্কা সাহেব হয়ে ফিরছে। সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর আই.সি.এস– বুঝলে! এবং প্রথম ভারতীয় আই.সি.এস। ব্যাপারটা বোঝো? তোমাকে তো বুঝতে হবে বউঠাকরুণ, কার বউ তুমি!
তথ্যসূত্র: রবীন্দ্রনাথের আত্মীয়স্বজন। সমীর সেনগুপ্ত। সাহিত্য সংসদ