মফস্সল থেকে আসা একটি নিরপরাধ কিশোরকে মর্মান্তিক মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল একদল অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধরনের মানুষ– ভাবতে লজ্জা হয় আমাদেরই ঘরের সন্তান তারা। অনেকে মিলে, বেশ কিছু প্রত্যক্ষদর্শী রেখে। এরা যেমন নীরবে দেখেছে ওই হত্যাকাণ্ড, সিসিটিভি কি ওইভাবে দেখত, নির্বিকার চিত্তে? ধরে রাখত পুরো ঘটনাটা, সমস্ত প্রেক্ষাপট-সহ, আরম্ভ থেকে যবনিকা পর্যন্ত?
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেদের মেন হোস্টেলে বীভৎস রিচুয়ালের এক বীভৎসতম এবং চূড়ান্ততম মর্মান্তিক পরিণামের পর সিসিটিভি বসানো নিয়ে মহা হট্টগোল শুরু হয়েছে। মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ‘এটাই হবে’ বনাম ‘কস্মিনকালে হতে দেব না’-র সূত্র ধরে একদল বলছে সব জায়গায় সিসিটিভি লাগাও, অন্য দল বলছে, কোত্থাও লাগাতে দেব না। স্লোগান উঠেছে, নজর রাখো, নজর রাখো ছেলেদের প্রত্যেকটা কাজকর্মের উপর, সিসিটিভি দিয়ে নজর রাখা ছাড়া এই কলিযুগে নাস্তৈব গতিরন্যথা– মানে আর কোনও গতি নেই। এর মধ্যে এক মারাত্মক ও কৌতুককর স্ব-বিরোধী বিষয় হল, মেন হস্টেল আর যাদবপুরের বিশাল পুলিশ থানা একেবারে গায়ে-গায়ে। অর্থাৎ, যাঁরা সর্বশক্তিমান বা বিগ ব্রাদারের মতো আমাদের ওপর নজর রাখেন, এই কর্তব্যের জন্য সরকারি খরচে প্রশিক্ষিত, আর কর্তব্যে ত্রুটি করেন না কখনও, তাঁরা একেবারে পাশেই ছিলেন, কিন্তু তাঁরা আসল ঘটনার সময় নাকি কিছুই টের পাননি। এ-ও ঠিক যে, পুলিশের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়গুলির একটা সতীপনা আছে, অর্থাৎ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস হল একটি লক্ষ্মণের কেটে দেওয়া মহাপবিত্র গণ্ডি, কর্তৃপক্ষ না বললে পুলিশ তাতে ঢুকতে পারবে না, চোখের সামনে খুন হতে দেখলেও না।
অথচ একটা খুনের ঘটনা ঘটে গেল! মফস্সল থেকে আসা একটি নিরপরাধ কিশোরকে মর্মান্তিক মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল একদল অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধরনের মানুষ– ভাবতে লজ্জা হয় আমাদেরই ঘরের সন্তান তারা। অনেকে মিলে, বেশ কিছু প্রত্যক্ষদর্শী রেখে। এরা যেমন নীরবে দেখেছে ওই হত্যাকাণ্ড, সিসিটিভি কি ওইভাবে দেখত, নির্বিকার চিত্তে? ধরে রাখত পুরো ঘটনাটা, সমস্ত প্রেক্ষাপট-সহ, আরম্ভ থেকে যবনিকা পর্যন্ত? আমি এসব বিষয়ে নিতান্তই অজ্ঞ বা অগা, আমি জানি না কোনও সিসিটিভির স্থান-কালের সেই পরিসর ধরার ক্ষমতা আছে কি না।
সিসিটিভি কোথায় কতটা লাগানো হবে, তার নিশ্চয়ই একটা আইনি নির্দেশিকা আছে, বা থাকা উচিত। গণতন্ত্রে ব্যক্তি-পরিসরের পবিত্রতা ও অধিকারের একটা ব্যাপার আছে, রাষ্ট্র বা প্রতিষ্ঠানের নজরদারি সেটাকে লঙ্ঘন করতে পারে না। আমাদের সংবিধান রচনার সময় সিসিটিভি হয়েছিল কি না, আমি জানি না, কিন্তু নিশ্চয়ই ভারতীয় আইনি-সংহিতাতে এ সম্বন্ধে কোনও পথরেখা তৈরি হয়েছে। যতদূর জানি, অধিকাংশ সময়ে তা বসানো হয় ব্যক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সম্পত্তি রক্ষার জন্য। ব্যাঙ্কের এটিএম-এ বসে, গ্যারেজে বসে, শপিং মলে বা তার বাইরেও বড় দোকানের নানা জায়গায় বসে। তা বসানোর আর-একটা যুক্তি জনজীবনে শান্তিরক্ষা, তার ফলে বড় বড় সমাবেশে শুধু নয়, যেখানে অল্পবিস্তর জনসমাগম হয় সেখানেও, যেমন রেস্তোরাঁ, সভাঘর ইত্যাদিতেও সিসিটিভি বসে। আমি জানি না, আর কোথায় কোথায় বসে: ধরা যাক, চিড়িয়াখানায় বাঘ বা হনুমানের খাঁচার সামনে বসে কি না তাদের সঙ্গে দর্শকদের দুর্ব্যবহার ধরার জন্য, বা এরোপ্লেনে যাত্রীদের নানা কু-কাণ্ড ধরার জন্য– যা ইদানীংকালে খবরে শুনছি খুব।
কিন্তু হস্টেলে র্যাগিং নিবারণের জন্য কোথায় সিসিটিভি বসানো হবে? আবাসিকদের ঘরে? সেটা সম্ভব, নৈতিক আর অর্থনৈতিক দিক থেকে? আবাসিকের ঘর তার ব্যক্তিগত পরিসর, সেখানে সিসিটিভি লাগানো তার ব্যক্তিগত পরিসরের ওপর হস্তক্ষেপ, এক ধরনের অবাঞ্ছিত নজরদারি বা গোয়েন্দাগিরি। তা গণতন্ত্রে ‘অবৈধ’ বলে গণ্য হওয়া উচিত, জানি না ভারতে গণতন্ত্রের নতুন কোনও সংজ্ঞা তৈরি হয়েছে কি না, যাতে শাসকরা এই Big Brother is watching you!– ব্যবস্থাকে সমর্থন করবেন আর রূপায়িত করতে লাফিয়ে এগিয়ে আসবেন? যদি র্যাগিং কোনও আবাসিকের ঘরে হয়, তার কী ব্যবস্থা? হ্যাঁ, হস্টেলের গেটে বা কমন রুমে বা ক্যান্টিনে বসানো যাবে কি না, তা ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঠিক করা যেতেই পারে।
যাই হোক, সিসিটিভি সব রোগের নিদান বা সব সমস্যার সমাধান নয়, তা আমরা প্রতি মুহূর্তেই দেখি। নির্বাচনী বুথে বা ভোটগণনা কেন্দ্রে তা বিকল হয়ে যায়, কোথাও তা আসল কাজের সময় খারাপ থাকে, কোথাও তার ছবির রিল মুছে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। প্রযুক্তি যত এগোয়, তাকে বিকল করার প্রযুক্তিও তত এগোয়।
আমাদের আত্মশুদ্ধির শিক্ষা ছাড়া এ রোগের কোনও নিদান নেই। প্রশাসনিক ব্যবস্থাকেও কোমরে কষি বেঁধে, সবাইকে (দল ও গোষ্ঠীকে) খুশি রাখার ভালমানুষি সংকল্প ছেড়ে কড়া হতে হবে। সমাজের সর্বস্তরে, সেই মান্ধাতার আমল থেকে নানা রকমের র্যাগিং চলে আসছে। সব হয়তো হত্যা বা মৃত্যু পর্যন্ত গড়ায় না, কিন্তু মনুষ্যত্ব বা মানবসম্পদের অপচয় প্রচুর হয়েছে। সিসিটিভিতে তার নিবারণের সমস্ত উপায় নিয়ে আমাদের কাছে মুক্তিদূতের মতো হাজির– এমন কথা বলা যাবে না। সারা দেশে র্যাগিং-এর ফলে মৃত্যু তো ঘটেই চলেছে। এই মৃত্যুগুলি আমাদের শুধু প্রযুক্তির দিকে যেন ঠেলে না দেয়।