রবীন্দ্রনাথ বারেবারেই এই মন্ত্রের কথা বলেছেন তাঁর ধর্ম-ব্যাখ্যানে। ‘শান্তিনেকেতন’ গ্রন্থের দু’টি ভাষণ পড়ে এই মন্ত্রটির ব্যাখ্যা বোঝার চেষ্টা করছি। দু’টি ভাষণই ১১ মাঘের ভাষণ, একটি ১৩১৮, আর একটি ১৩২০ বঙ্গাব্দে। প্রথমটির শিরোনাম ‘পিতার বোধ’, দ্বিতীয়টি ‘ছোটো ও বড়ো’। দু’টি সুভাষিত দীর্ঘ ভাষণ থেকে ছোটবেলার বাংলা পরীক্ষায় ভাবার্থ লেখার মতো দুঃসাধ্য প্রয়াস।
২.
‘‘জীবনস্মৃতি’-তে নর্মাল স্কুলের কথায় রবীন্দ্রনাথ বলছেন, ‘তখন বয়স অত্যন্ত অল্প। একটা কথা মনে পড়ে, বিদ্যালয়ের কাজ আরম্ভ হইবার প্রথমেই গ্যালারিতে সকল ছেলে বসিয়া গানের সুরে কী সমস্ত কবিতা আবৃত্তি করা হইত।… আমাদের মুখে সেই ইংরেজিটা কী ভাষায় পরিণত হইয়াছিল, তাহার আলোচনা শব্দতত্ত্ববিদ্গণের পক্ষে নিঃসন্দেহ মূল্যবান। কেবল একটা লাইন মনে পড়িতেছে– কলোকী পুলোকী সিংগিল মেলালিং মেলালিং মেলালিং। অনেক চিন্তা করিয়া ইহার কিয়দংশের মূল উদ্ধার করিতে পারিয়াছি– কিন্তু ‘কলোকী’ কথাটা যে কিসের রূপান্তর তাহা আজও ভাবিয়া পাই নাই। বাকি অংশটা আমার বোধ হয়– Full of glee, singing merrily, merrily, merrily.”
আমি কোথাও একটা পড়েছিলাম, ‘কলোকী’টা ‘call of Thee’ হতে পারে।
‘জীবনস্মৃতি’ রচনার অন্তত ১০ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে তাঁর আশ্রম বিদ্যালয় আরম্ভ করেছেন। প্রভাতের প্রাত্যহিক সমবেত উপাসনার জন্য মন্ত্র নির্বাচিত হয়েছে–
‘ওঁ পিতা নোহসি, পিতা নো বোধি,
নমস্তেহস্তু, মা মা হিংসীঃ॥
বিশ্বানি দেব সবিতর্দুরিতানি পরাসুব,
যদ্ভদ্রং তন্ন আসুব॥
তুমি আমাদের পিতা, পিতার ন্যায় আমাদিগকে জ্ঞানশিক্ষা দাও; তোমাকে নমস্কার। আমাকে মোহপাপ হইতে রক্ষা করো, আমাকে পরিত্যাগ করিও না, আমাকে বিনাশ করিও না।
নমঃ সম্ভবায় চ ময়োভবায় চ
নমঃ শংকরায় চ ময়স্করায় চ
নমঃ শিবায় চ শিবতরায় চ॥
হে দেব! হে পিতা! পাপ সকল মার্জনা করো। যাহা কল্যাণ, তাহা আমাদের মধ্যে প্রেরণ করো। তুমি যে সুখকর, কল্যাাণকর, সুখ-কল্যাণের আকর, কল্যাণ ও কল্যাণতর, তোমাকে নমস্কার।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সীমা আমাদের মৃত্যু, আরও-র পরে আরওই হচ্ছে আমাদের প্রাণ। আমাদের নিয়তিসাধনার দিক জড়তার সহজ অনুসরণের দিকে নয়, অসীমের অভিমুখে। সেই মুক্তির দিককে কল্পনার বেড়ায় ঘিরে সহজ করতে গিয়ে মানুষ নিজের শক্তিকে অবমানিত করে, দুর্বলতাকে লালন করে, নিজের বিনাশ ডেকে আনে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সাপ্তাহিক বুধবারের উপাসনায় প্রথম গানের পরে ছোটবড় সকলে উঠে দাঁড়িয়ে এই মন্ত্রটি আবৃত্তি করেন। পাঠভবন শিক্ষাসত্রে ‘বিদ্যালয়ের কাজ আরম্ভ হইবার প্রথমেই’ এই মন্ত্রটি সমবেত কণ্ঠে উচ্চারিত হয়। ছাত্রছাত্রীদের যে ‘দিনলিপি’ দেওয়া হয়, সেই দিনলিপিতে এই মন্ত্র বাংলা অনুবাদ-সহ ছাপা থাকে। সেই বাংলা অনুবাদ ছোটদের মুখস্থও থাকে অনেকের। কিন্তু, ছোটদের ‘ইয়চ্চ’ শুনলে ‘মেলালিং’ মনে পড়েই যায়।
রবীন্দ্রনাথ বারেবারেই এই মন্ত্রের কথা বলেছেন তাঁর ধর্ম-ব্যাখ্যানে। ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্থের দু’টি ভাষণ পড়ে এই মন্ত্রটির ব্যাখ্যা বোঝার চেষ্টা করছি। দু’টি ভাষণই ১১ মাঘের ভাষণ, একটি ১৩১৮, আর একটি ১৩২০ বঙ্গাব্দে। প্রথমটির শিরোনাম ‘পিতার বোধ’, দ্বিতীয়টি ‘ছোটো ও বড়ো’। দু’টি সুভাষিত দীর্ঘ ভাষণ থেকে ছোটবেলার বাংলা পরীক্ষায় ভাবার্থ লেখার মতো দুঃসাধ্য প্রয়াস।
আমাদের চাওয়ার শেষ নেই, কারণ আমরা অনন্তকে চাই। সেই চাওয়ার স্বরূপটি আমাদের কাছে স্পষ্ট নয়। প্রতিদিনের সাংসারিক চাওয়া-পাওয়ার বাইরে অনেক বড় কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় মানুষ ধর্মকে আশ্রয় করেছে, অথচ, ধর্মের দোহাই দিয়েই অকল্যাণ আর বিভীষিকার সৃষ্টি করেছে।
সীমা আমাদের মৃত্যু, আরও-র পরে আরওই হচ্ছে আমাদের প্রাণ। আমাদের নিয়তিসাধনার দিক জড়তার সহজ অনুসরণের দিকে নয়, অসীমের অভিমুখে। সেই মুক্তির দিককে কল্পনার বেড়ায় ঘিরে সহজ করতে গিয়ে মানুষ নিজের শক্তিকে অবমানিত করে, দুর্বলতাকে লালন করে, নিজের বিনাশ ডেকে আনে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: ‘অসতো মা সদ্গময়’ মন্ত্রের অর্থ কৈশোরে বুঝিনি, শব্দগুলো ভালো লেগেছিল খুব
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
‘আজ পর্যন্ত ধর্মের নামে কত নরবলি হয়েছে এবং কত নরবলি হচ্ছে তার আর সীমাসংখ্যা নেই; সে বলি কেবলমাত্র মানুষের প্রাণের বলি নয়– বুদ্ধির বলি, দয়ার বলি, প্রেমের বলি। আজ পর্যন্ত কত দেবমন্দিরে মানুষ আপনার সত্যকে ত্যাগ করেছে, আপনার মঙ্গলকে ত্যাগ করেছে এবং কুৎসিতকে বরণ করেছে! মানুষ ধর্মের নাম করেই নিজেদের কৃত্রিম গণ্ডির বাইরের মানুষকে ঘৃণা করবার নিত্য অধিকার দাবি করেছে। মানুষ যখন হিংসাকে, আপনার প্রকৃতির রক্তপায়ী কুকুরটাকে, একেবারে সম্পূর্ণ শিকল কেটে ছেড়ে দিয়েছে তখন নির্লজ্জভাবে ধর্মকে আপন সহায় বলে আহ্বান করেছে। মানুষ যখন বড়ো বড়ো দস্যুবৃত্তি করে পৃথিবীকে সন্ত্রস্ত করেছে তখন আপনার দেবতাকে পূজার লোভ দেখিয়ে দলপতির পদে নিয়োগ করেছে বলে কল্পনা করেছে! কৃপণ যেমন করে আপনার টাকার থলি লুকিয়ে রাখে তেমনি করে আজও আমরা আমাদের ভগবানকে আপনার সম্প্রদায়ের লোহার সিন্ধুকে তালা বন্ধ করে রেখেছি বলে আরাম বোধ করি এবং মনে করি যারা আমাদের দলের নামটুকু ধারণ না করেছে তারা ঈশ্বরের ত্যাজ্যপুত্ররূপে কল্যাণের অধিকার হতে বঞ্চিত।’
‘অপরাধী’ কখনওই একজন কি? প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে ধর্ষণ-সহ লিঙ্গ-হিংসাজনিত যে কোনও ঘটনায় প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ইন্ধন জোগানো, হিংসার শিকার মানুষদের পাশে দাঁড়ানোয় অনীহা, প্রতিষ্ঠানের মান বাঁচানোর জন্য অপরাধ ধামাচাপা দেওয়া, চুপ করিয়ে রাখার নরম-গরম হুমকি– এসব কি আমাদের অচেনা? অপরাধীকে আড়াল করাই কি দস্তুর নয়?