ছেলেদের হাত সবসময়ই দু’খানা। কিন্তু মেয়েদের দশভুজা হতেই হবে। দরকারে-অদরকারে-খামখেয়ালিপনায় মেয়েদের মানুষি ক্ষমতার থেকে বাড়িয়ে দেখার আজব প্রবণতা এই সমাজেরই। সে যে আর পাঁচটা মানুষের মতোই সাধারণ, আটপৌরে– এ ব্যাপারটাতে থিতু হতে দেবে না কেউই। তাকে বাড়ির-বাইরের সমস্তরকম কাজে হতে হবে পারদর্শী, হয়েই উঠতে হবে দশভুজা। ওহে মেয়েরা, সমাজের প্রশংসাচ্ছলে এই যে আটখানা হাত গুঁজে দিল আপনাকে, এই ২৯ ফেব্রুয়ারি, বাড়তি দিনে ছেঁটে ফেলুন তো দেখি!
সে এক হুলস্থুল ব্যাপার। মেয়েরা সব হুটোপুটি করে এগিয়ে চলেছে। ধাক্কা খাচ্ছে, পিছলে পড়ছে, সারা শরীরে ক্ষতচিহ্ন, সেসব দিকে হুঁশ নেই। দু’দণ্ড যে থমকেও দাঁড়াতে হয়, কোমরে হাত দিয়ে আশপাশ একবার দেখে নিতে হয়, দু’চোখ ভরে তাকাতে হয়, দু’চোখ বুজে একটু অনুভবে স্থির হতে হয়, অবসরকে গুছিয়ে রাখতে হয়– সেসব একেবারে ভুলে মেরে দিয়েছে। সারাক্ষণ দৌড়, এক পা এগিয়ে দাঁড়ানোর সে এক অতিপ্রাকৃত বাধ্যবাধকতা। এটুকু পড়ে মনে হতেই পারে, এ কী অলুক্ষুণে কথা বলছে এই প্রতিবেদনের লেখক! মেয়েদের এগিয়ে যাওয়া নিয়ে বাঁকা মন্তব্য করছে কেন!
সবুর করুন। গুছিয়ে বলছি।
কর্মক্ষেত্র হোক কি, বাড়িতে, নিভৃতে, একলা ঘরে বা ভরা সংসারে– মেয়েদের একটু বেশিই প্রমাণ করতে হয়। প্রমাণ করতে হয়, সে পারে। অনেকের থেকে ভালোই পারে। সে পারদর্শী, সে পটু, সে ক্ষমতাশালী। নিজে না প্রমাণ করলে, তাকে কেউ দাঁড়ানোর জায়গাটুকুই দেবে না। ঠেলে দেবে পিছনের দিকে, অতীতে, অন্দর মহলে। আঙুল তুলে দেখাবে আর খ্যা-খ্যা করে হাসতে হাসতে বলবে, ঘরের ভেতর ছিলে, অন্যের কৃপায় ছিলে, কর্তার ছায়ায় ছিলে– সহ্য হল না, মেয়েরা একাই পারবে বলে বেরিয়ে পড়লে, অধিকার চাই বলে চ্যাঁচালে, সুযোগ নেই বলে হাহুতাশ করলে, এবার নাও, ঠ্যালা সামলাও। বাইরের পৃথিবীতে পা দিয়ে দেখলে তো যে এ তোমার জায়গা নয়?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সে দশভুজা অন্যের চোখে। একগাদা চোখ তার দিকে তাকিয়ে। এবার তাকে পালন করতে হবে কর্তব্য। এই কর্তব্য সে নিজেকে সঁপেনি। তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির বাইরে একটি মেয়ে নিজেই নিজেকে দশভুজা বানিয়ে রাখে, বাড়ির ভেতরে অন্যেরা। কাঁপা হাতে তুলে নেয় পড়ে থাকা সংসার, থমকে থাকা গেরস্থালি। যত্নের দায়িত্ব তার একার। প্রতিপালনের আকাঙ্ক্ষা শুধু তারই কাছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
তাই মেয়েরা সবার থেকে বেশি কাজ করে। যে কাজ একার নয়, সেই ভারই সে তুলে নেয়। যতটা পরিশ্রম করে একটা ছেলে নামডাক পায়, মেয়েটিকে সেটুকু পেতেই অনেকটা বেশি খাটতে হয় একটি ছেলের থেকে। নয়তো মেয়েটিকে কেউ লক্ষই করবে না। তার কখনও ডাক পড়বে না। তার মতামত কেউ জানতে চাইবে না। তার কাজ অলক্ষ্যে পড়ে থাকবে। তাই সে জোরে জোরে পা ফেলে, সশব্দে বিরাজ করে, তিন কদম বেশি হাঁটে, সে নিজের ওপর এতই কাজ সঁপে দেয়, যা কারও পক্ষেই করা সম্ভব নয়। কিন্তু তবুও সে অসম্ভবকেই সম্ভব করবে, করবেই, যাতে তাকে কেউ অতীতে ফিরিয়ে না দেয়, দ্বিতীয় স্থানে না বসায়।
একটি মেয়ে তাই সর্বক্ষণ উদ্বিগ্ন, সে কর্মচঞ্চল, সে দশভুজা হয়েই ছাড়বে। কারণ তাকে এই পৃথিবীতে, এই সমাজে তার অবদানের জন্য, তার কাজের জন্য, তার সৃষ্টির জন্য, তার চিন্তার জন্য, তার ক্ষমতার জন্য পরিচিত হতে চায়। সে পরিচিত হতে চায় নিজের পরিচয়ে। যে সম্মান সে নিজে অধিকার করেছে, কারও দয়ায় নয়। তাই তাকে বাড়তি কাজ করতে হয়। বাড়তি সময় ব্যয় করতে হয়, বাড়তি পরিশ্রম করতে হয়, বাড়তি লড়াই করতে হয়, বাড়তি হাতের প্রয়োজন পড়ে।
কিন্তু সে তো দশভুজা নয়, সে মানুষি ক্ষমতায় বলীয়ান। সে ক্ষমতা সীমিত, সে কিছু কাজ পারে, কিছু কাজ পারে না। সে কিছু কাজে পটু, কিছু কাজ সে মোটামুটি পারে, কিছু কাজে একদম পারদর্শী নয়, কিছু কাজ সে করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, কিছু কাজে তার মন বসে না, কিছু কাজ সে শুধু অন্যের জন্য করে, কিছু কাজ শুধুই নিজের জন্য। কিন্তু তার প্রতি অসীম চাহিদায় সে নিজেকে দশভুজায় পরিণত করেছে। সে আর বলতে পারে না সে ক্লান্ত, সে বিধ্বস্ত। সে বলতে পারে না আর কাজ করবে না সে। এলিয়ে পড়তে চায় নিজের নিশ্চিন্ত আশ্রয়ে। উল্টে সে ক্ষতচিহ্ন আড়াল করে নেয়। এক অনন্ত শক্তি সংগ্রহ করে সে লড়তে থাকে। সে জিততে চায়, তাকে জিততে হবেই। এদিকে সন্ধে গড়িয়ে আসে, সবাই ঘরে ফেরে। মেয়েটিকে লড়তে লড়তেই বাড়ির পথে হাঁটা দেয়। রাস্তা যে সবচেয়ে বড় যুদ্ধক্ষেত্র। ক্লান্ত শরীর বাড়ির দরজায় এসে দাঁড়ালে আবারও সে কোনও এক অজানা উৎস থেকে শক্তি সংগ্রহ করে। এখন সামনে অনেক কাজ।
এখন সে দশভুজা অন্যের চোখে। একগাদা চোখ তার দিকে তাকিয়ে। এবার তাকে পালন করতে হবে কর্তব্য। এই কর্তব্য সে নিজেকে সঁপেনি। তার ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাড়ির বাইরে একটি মেয়ে নিজেই নিজেকে দশভুজা বানিয়ে রাখে, বাড়ির ভেতরে অন্যেরা। কাঁপা হাতে তুলে নেয় পড়ে থাকা সংসার, থমকে থাকা গেরস্থালি। যত্নের দায়িত্ব তার একার। প্রতিপালনের আকাঙ্ক্ষা শুধু তারই কাছে। সে এসে গেলে যে যার আরামে ফিরে যায়, অবসরে পা দোলায়। কিন্তু মেয়েটি, যত্নের প্রতিপালক, এক কর্মক্ষেত্র থেকে অন্য কর্মক্ষেত্রে উপস্থিত হয়। সে দশভুজা, প্রতিটি মুহূর্তে।
অন্যদিকে ছেলেটি কর্মক্ষেত্র থেকে ফিরে এলে, তাকে যত্ন করতে আলাদা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। তার পরিশ্রম কারও চোখ এড়ায় না। তার সামনে এসে যায় পরিশ্রমের মূল্য– আরাম, অবসর, সেবা, যত্ন, জলের গ্লাস, থালায় বেড়ে দেওয়া গরম ভাত। আয়োজন করে মেয়েটি।
একটি মেয়ে তাই একপৃথিবী কাজে ডুবে থাকে, ডুবতে থাকে, তল পায় না, শ্বাস বন্ধ হয়ে আসে।
অবসরের ধারণা মেয়েটি পায়নি, আরামের চাহিদা তার নেই। মনের দিকে নজর দেওয়ার সময় নেই, শরীর যেন শুধুই যন্ত্র। সে বাড়তির দিকে এগোয়, সে কিছু বেশির দিকে নজর দেয়। কিন্তু ক্ষয়ে যেতে থাকে তার ভেতরটা, তলানিতে এসে ঠেকে অন্তরপ্রবাহ।
যে মেয়ে নিজের জন্য পরিশ্রমী, যে মেয়ে আহ্লাদী, যে মেয়ে সব কাজ ছেড়ে নিজের দিকে তাকিয়ে বসে আছে, যে মেয়ে নিশ্চিন্তে আলো হয়ে বসে আছে, যে মেয়ে একা অবসর পোহায়, যে মেয়ে সকলের সঙ্গে অবসর পালন করে, সেই মেয়েদের সঙ্গ পাক বিশ্রামহীন মেয়েরা। এই বন্ধুত্বের সাহচর্যে দশভুজা মেয়েদের একটা একটা করে হাত খসে পড়ুক।
পরিশ্রম নয়, ‘বাড়তি’ হোক অবসর।