ছবিঠাকুরের প্রথম মুদ্রিত ছবি, তার খবর? হ্যাঁ, তার খবর অবশ্যে অজানা নয়। কবির অনুমোদন সাপেক্ষে তাঁর আঁকা ছবি কবে এবং কোথায় প্রথম ছাপা হয়েছিল, তার খোঁজ মিলেছে। সে ছবি মুদ্রিত হয়েছে ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ পত্রিকায়। পত্রিকার ১৩৩৫ অগ্রহায়ণ সংখ্যাতে (১৯২৮) প্রকাশ পেয়েছে রবিঠাকুরের আঁকা ছবি। ঘন নীল কালিতে আঁকা নারীপ্রতিমা। ছবির নিচে মুদ্রিত শিরোনাম ‘গ্রামের মেয়ে’– সে নাম কবির দেওয়া না সম্পাদকের, বলা শক্ত। ছবিটি ছাপার পরে কী হল, খানিক বাদে বলছি সে কথা।
না। আমাদের ছবিঠাকুরের একেবারে প্রথম দিকের আঁকা ছবির হদিশ পাওয়া সহজ নয়। সে খোঁজ পাওয়া বড় দুষ্কর! তবে ১৮৭৫ নাগাদ ‘হিন্দুমেলা’ উপলক্ষে আয়োজিত কৃষি শিল্প ও ছবির প্রদর্শনীর জন্য ঠাকুরবাড়ির হিসেবের খাতার একটা খবরে চমকে উঠতে হয়! সেখানে দেখি ‘রবীবাবুর কৃত’ একখানা ছবি ‘বাঁধাইবার ব্যয়’ অর্থাৎ বাঁধাই খরচের হিসেব। ছবি-ফ্রেমিং বাবদ টাকাপয়সার কথা সরিয়ে রেখে বলি, এই খবরে রবীন্দ্রনাথের আঁকা ছবি প্রদর্শনীর ইতিহাসকে বুঝি অনেকটা পিছনের দিকে টেনে নেওয়া চলে। যা তাঁর কিশোরকালে অর্থাৎ বছর ১৩-১৪ বয়সেই ঘটে গিয়েছে। যদিও সে ছবির বিষয় বা বিবরণ কোনওটিই আমাদের কাছে পৌঁছয়নি। হিসেবের খাতার তথ্যই শুধু চিত্রপ্রদর্শনীর পাথুরে প্রমাণ। ছবির প্রসঙ্গে আরেকটি কথা মনে পড়বে, সে হচ্ছে ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’ বা ‘হেঁয়ালি-চিত্র’ নামের খাতা। যেখানে পরিবারের সদস্যরা নানারকম নকশা, চিহ্ন সংখ্যা বা প্রতীকের সাহায্যে পরস্পরের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান করতেন। খাতায় আঁকা সেইসব সাংকেতিক ছবি একেকখান মস্ত ধাঁধা– যার মর্মোদ্ধার করতে গিয়ে আজও আমাদের কপাল ঘেমে উঠবে, কর্ণমূল উঠবে রাঙা হয়ে। সাধারণ মোটা দাগের ঠাট্টা রসিকতার ঠাঁই ছিল না খাতায়। সে যাকে বলে এক অভিজাত মেধাদীপ্ত বিনোদনের আসর। ঠাকুরবাড়ির হরেক উদ্ভাবনী শক্তির এ এক অত্যাশ্চর্য নমুনা বললেও কম বলা হয়। এখন প্রশ্ন, বুদ্ধিদীপ্ত খেলার সেই আসরে কি পরিবারের সবাই যোগ দিয়েছিলেন?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ছবির প্রসঙ্গে আরেকটি কথা মনে পড়বে, সে হচ্ছে ঠাকুরবাড়ির ‘হেঁয়ালি খাতা’ বা ‘হেঁয়ালি-চিত্র’ নামের খাতা। যেখানে পরিবারের সদস্যরা নানারকম নকশা, চিহ্ন সংখ্যা বা প্রতীকের সাহায্যে পরস্পরের মধ্যে ভাবের আদানপ্রদান করতেন। খাতায় আঁকা সেইসব সাংকেতিক ছবি একেকখান মস্ত ধাঁধা– যার মর্মোদ্ধার করতে গিয়ে আজও আমাদের কপাল ঘেমে উঠবে,
কর্ণমূল উঠবে রাঙা হয়ে। সাধারণ মোটা দাগের ঠাট্টা রসিকতার ঠাঁই ছিল না খাতায়। সে যাকে বলে এক অভিজাত মেধাদীপ্ত বিনোদনের আসর।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
খোঁজ নিলে দেখি, ‘হেঁয়ালি খাতা’র অর্থবহ চিহ্ন আর ছবির লড়াইতে নাম লিখিয়েছিলেন পরিবারের বাঘা বাঘা সদস্য। তার মধ্যে অন্যতম কবির জ্যোতিদাদা, স্নেহের ভাইপো অবন, প্রিয় ভাইঝি বিবি বা ইন্দিরা-সহ ভাগনে সত্যপ্রসাদের দল পর্যন্ত। পাশাপাশি রবি ঠাকুর নিজে তো ছিলেনই। ‘হেঁয়ালি খাতা’র পাতায় পাতায় ছড়ানো আছে অজস্র সংকেত, সংখ্যা আর চিত্রমালা। রবীন্দ্রনাথের একাধিক ছবি এখানে থাকা বিচিত্র নয়, তবে নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। কারণ, ছবিতে শিল্পীর স্টাইল ফুটে ওঠার অবকাশ নেই। এ জাতীয় ছবিতে রেখা বা আকারের বৈশিষ্টের বদলে সামগ্রিকভাবে তার সাংকেতিক দিকটিই প্রধান। যদিও খাতার একটি পাতায় ‘ধন প্রহার’ শিরোনামের একটি ছবি, রবি ঠাকুরের আঁকা বলে জানা যায়। সময়টা ১৮৯২-’৯৩ নাগাদ, অর্থাৎ কি না ‘ছিন্নপত্রাবলী’র সময়পর্ব। কী আছে সেই ছবিতে? সেখানে আঁকা হয়েছে পর পর পাশফেরা তিনটি মূর্তি। প্রথম জনের চেহারা পোশাক আর চুলবাঁধার ধরনে একটু যেন বিলেতি মেমসাহেবি স্টাইল। পরেরটায় দেখি, আদুড় গায়ে প্রায় কৌপীন পরিহিত এক পুরুষ– যে মাটিতে বসে পড়ে দু’হাত দিয়ে নিজেকে সামলে নিয়েছে। আর তৃতীয় জন ঘোমটা দেওয়া বাঙালি মেয়ে, পিঠে কাঠকুটোর বোঝা নিয়ে ঝুঁকে পড়েছে খানিক সামনের দিকে। তাদের সবার মাথায় আর পায়ের কাছে বিচিত্র ভঙ্গিতে লেখা কিছু অক্ষর। তিন জনেরই ঝুঁকে পড়া শরীরের ধরন, মাথা ও পায়ের কাছে লেগে থাকা অক্ষর মিলে এবং ওপরের শিরোনাম জড়িয়ে এই ধাঁধার হয়তো একটা মানে দাঁড়ায়। চিত্রিত ধাঁধার অন্তর্নিহিত উত্তর হিসেবে এর অর্থ হতে পারে ‘হুহু উহু উহু’, একটু চাপা আর্তনাদের ইশারা যেন। যদিও ছবি যে ঠিক কী বার্তা বহন করছে, তা বলা সহজ নয়। একটু খতিয়ে দেখলে, চেহারা বা বেশভূষায় ফিগারগুলির শ্রেণিবিন্যাস আলাদা। অর্থাৎ ক্লাস বা শিক্ষাদীক্ষা, টাকাপয়সার দিক থেকে এরা ভিন্ন গোত্রের। তবে কি ‘ধন প্রহার’-এর শিকার এরা প্রত্যেকেই, ছবির ভেতরের ভাব এটাই? যে অর্থসম্পদে বলীয়ান সে যেমন, তেমনি উল্টোদিকের সম্পদশূন্য মানুষ, তারা ধনহীনতায় লাঞ্ছিত– ছবির মানে কি তাই? কে বলবে সেকথা! তবে ছবির অন্দরে যে অর্থই লুকিয়ে থাক না কেন, এইটে রবিঠাকুরের গোড়ার দিকের আঁকা একটি ছবি বলে চিহ্নিত। ধাঁধার খোলস ছাড়িয়ে এখানে ছবির দিকে চোখ মেললে দেখা যাবে রেখার টান একটু আড়ষ্ট লাগলেও শারীরিক গঠনের অনুপাত মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই গড়ে উঠেছে।
এ তো গেল তাঁর প্রথম দিকে আঁকা ছবির সম্ভাব্য হদিশ। কিন্তু ছবিঠাকুরের প্রথম মুদ্রিত ছবি, তার খবর? হ্যাঁ, তার খবর অবশ্যে অজানা নয়। কবির অনুমোদন সাপেক্ষে তাঁর আঁকা ছবি কবে এবং কোথায় প্রথম ছাপা হয়েছিল, তার খোঁজ মিলেছে। সে ছবি মুদ্রিত হয়েছে ‘বঙ্গলক্ষ্মী’ পত্রিকায়। পত্রিকার ১৩৩৫ অগ্রহায়ণ সংখ্যাতে (১৯২৮) প্রকাশ পেয়েছে রবিঠাকুরের আঁকা ছবি। ঘন নীল কালিতে আঁকা নারীপ্রতিমা। ছবির নিচে মুদ্রিত শিরোনাম ‘গ্রামের মেয়ে’– সে নাম কবির দেওয়া না সম্পাদকের, বলা শক্ত। ছবিটি ছাপার পরে কী হল, খানিক বাদে বলছি সে কথা। তার আগে বলি, ১৯২৭-’২৮ নাগাদ রবীন্দ্রনাথ পুরোদমে ছবির দিকে ঢলে পড়েছেন। এই সময়ের অজস্র চিঠিতে তার সাক্ষ্য মিলবে।
সুধীন দত্ত, নির্মলকুমারী মহলানবিশ, মুকুল দে প্রমুখের কাছে লেখা চিঠিতে পাই চিত্রচর্চার নানা খবরাখবর। যেমন, ১৯২৮-এর অক্টোবরে সুধীন দত্তকে বেশ রসিয়ে লিখেছেন, “আমি মাঝে মাঝে দুটো একটা কবিতা লিখেছি। কিন্তু ছবির নেশায় আমার কাব্যের উপর কিছু উৎপাত বাধিয়াছে। অধিক বয়সে তরুণী ভার্যায় মানুষকে অভিভূত করে এমন একটা প্রবাদ আছে। আমার প্রাচীনটি এই তরুণীর সঙ্গে পেরে উঠচেনা। এ’কে পরকীয়া প্রেমও বলা যেতে পারে, আমার স্বকীয়া কবিতার চেয়ে এর যেন জোর বেশি দেখতে পাচ্চি, এমনকি গানকেও শ্রীমতী চিত্রকলা দুয়োরাণীর মহলে পাঠিয়েছেন। অথচ প্রসাদ বিতরণের বেলায় অন্য দুটি কন্যার চেয়ে এঁর কৃপণতা অনেক বেশি। এক কন্যা রাঁধেন বাড়েন এক কন্যা খান,/ এক কন্যা না পেয়ে বাপের বাড়ি যান। যে কন্যাটি খান তিনিই চিত্রকলা, যিনি বাপের বাড়িতে পলাতক, তিনি গান, কবিতাটি পূর্বস্নেহে এখনো রাঁধাবাড়া করেন”। এই তবে তখনকার ছবিঠাকুরের অন্দরমহলের উপাখ্যান।
(চলবে)
…পড়ুন ছবিঠাকুর-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ২: রবীন্দ্রনাথের আঁকা প্রথম ছবিটি আমরা কি পেয়েছি?
পর্ব ১: অতি সাধারণ কাগজ আর লেখার কলমের ধাক্কাধাক্কিতে গড়ে উঠতে লাগল রবিঠাকুরের ছবি