খন সবে প্রথম শ্রেণিতে পড়ি, আমার বয়স ৫-৬, কে যেন বলেছিল চারকোল দিয়ে ছবি আঁকা যায়। একথা আমার মাথায় রয়ে গিয়েছিল। কাশী মিত্র ঘাটের শ্মশানে মড়া পোড়ানোর পর চারকোল ভেসে আসত। সেই চারকোল আমি তুলে নিতাম ছবি আঁকব বলে। শ্মশানের দেওয়ালে হয়তো ফুল-লতা-পাতা আঁকতাম, কিছু একটা লিখতাম। কোনও দিন হয়তো নিজের নামও লিখেছি সেখানে!
৩.
আবার ফিরে এলাম। সেই আমাকে নিয়ে। যার গায়ে এসে পড়েছিল উড়ো খই। ফুটে উঠেছিল নক্ষত্রমালা। আমি, এই পৃথিবীতে এসে খুঁজে বেরিয়েছি সেই নক্ষত্রদের, যাদের মানুষ তেমনভাবে চেনেনি। চিনতে চায়নি। আমি খুঁজতে খুঁজতে হারিয়েছি। হারিয়েছি কারণ আমি আসলে জীবনানন্দ-বিভূতিভূষণের সন্তান– রতি মুড়িওয়ালার ছেলে। না হারালে আমার খোঁজ শুরু হবে কী করে? যে পথে হেঁটে গিয়েছে সকলে, সেই পথে হেঁটে আমি খুঁজতে চাইনি আমাকে। আমি যাদের খুঁজছি, তারাও ওই পূর্ব-নির্ধারিত পথে আমার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে না, একথা আমি জানি।
পথেই আমি খুঁজে পেয়েছিলাম আমার ছবির পদ্ধতি। খুব ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে আমি যেতাম গঙ্গায়। বাবা গঙ্গাস্নান করতে যেতেন রোজ। প্রথমে নুন-তেল দিয়ে দাঁত মাজতেন। আমার মুখের মধ্যেও এসে পড়ত সেই নুন-তেল মাখা আঙুল। আমাদের বাড়ির সামনে, যেখানে দুর্গাপুজো হয়, দুর্গাচরণ ব্যানার্জী স্ট্রিটের একটা দেওয়াল ছিল। ওই বাড়ির পাঁচিলের দেওয়ালে অনেক ক্ষত ছিল। বাবার সঙ্গে এই পথ দিয়েই যেতাম গঙ্গায়। পাড়ার কোনও বাড়ির দেওয়ালেই তো ওরকম ক্ষতর দাগ নেই! তবে ওই বাড়িতে কেন? একসময় অনন্ত কৌতূহলে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছি, ‘বাবা, এই ক্ষতগুলো কীসের?’ বাবা কখনও এ প্রশ্নের কোনও উত্তর আমাকে ফেরত দেননি। বরং, প্রশ্ন করামাত্র হিড়হিড় করে টানতে টানতে সেখান থেকে নিয়ে গিয়েছেন। আমি বুঝে উঠতে পারিনি, ওই ক্ষতগুলোকে। শুধু দীর্ঘদিন এই প্রশ্ন আমার মাথার ভেতর ঝুলেছিল অপরিসীম আগ্রহে।
আমাদের জ্যাঠামশাই, অনিলচন্দ্র দেব রায়ের পানের দোকান ছিল আমাদের মুড়ি-মুড়কির দোকানের পাশেই। খানিক বড় হয়ে আমি এই প্রশ্ন নিয়ে ওঁর কাছে পৌঁছই। ছোটবেলার সেই প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিয়েছিলেন তিনি। সে উত্তরে চমকেও গিয়েছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, কেন আমার বাবা এতদিন আমাকে এই উত্তরের থেকে দূরে, বহু দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। জ্যাঠামশাই বলেছিলেন, নকশাল আমলে নকশালদের সেই পাঁচিলের সামনে উল্টো করে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হত। ওই ক্ষতগুলো সেই গুলির দাগ! জ্যাঠা এ-ও বলেছিলেন, কাশী মিত্র শ্মশান ঘাটেই সেই নকশালদের মৃতদেহ আধপোড়া করে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হত।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
আমাদের জ্যাঠামশাই, অনিলচন্দ্র দেব রায়ের পানের দোকান ছিল কাছেই। খানিক বড় হয়ে আমি এই প্রশ্ন নিয়ে ওঁর কাছে পৌঁছই। ছোটবেলার সেই প্রশ্নের উত্তর আমাকে দিয়েছিলেন তিনি। সে উত্তরে চমকে গিয়েছিলাম। বুঝতে পেরেছিলাম, কেন আমার বাবা এতদিন আমাকে এই উত্তরের থেকে দূরে, বহু দূরে সরিয়ে রেখেছিলেন। জ্যাঠামশাই বলেছিলেন, নকশাল আমলে নকশালদের সেই পাঁচিলের সামনে উল্টো করে দাঁড় করিয়ে গুলি করা হত। ওই গর্তগুলো সেই গুলির দাগ!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
হে পাঠক, দেখবেন, ওই ক্ষতবিক্ষত দেওয়াল আমার ছবিতে বারবার করে এসেছে। সব ছবিতে নয়, কিছু কিছু ছবিতে। ওটা আমার অভিজ্ঞতায় মিশে গিয়েছে। আমি চাই বা না-চাই ওই ক্ষত আমার ছবিতে এসে পড়বে স্বাভাবিকভাবেই। এগুলো আসলে ইতিহাস– আমার ব্যক্তিগত দেখার ইতিহাস। যা দিয়ে আমি বলে ফেলতে চাই সমাজের চাপা ইতিহাসকে।
আরেকটু হাঁটি আসুন। ওই গুলি লাগা বাড়ি থেকে বেরিয়ে গঙ্গার দিকে। এই গঙ্গা থেকেই নৌকা করে মাটি উঠত। সেই মাটি পড়ে যেত অনেক সময়ই। একটু একটু মাটি, প্রতিবারই। সেই মাটি নিয়ে কিছু একটা বানাতাম তখন। যখন সবে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি, আমার বয়স ৫-৬, কে যেন বলেছিল কাঠকয়লা (চারকোল) দিয়ে ছবি আঁকা যায়। একথা আমার মাথায় রয়ে গিয়েছিল। কাশী মিত্র ঘাটের শ্মশানে মড়া পোড়ানোর পর কাঠকয়লারা ভেসে আসত। সেই পোড়া কাঠ তুলে নিতাম ছবি আঁকব বলে। শ্মশানের দেওয়ালে হয়তো ফুল-লতা-পাতা আঁকতাম, কিছু একটা লিখতাম। কোনও দিন হয়তো নিজের নামও লিখেছি সেখানে!
একদিন, এসব করছি যখন, একজন লোক এসে বললেন, ‘একটা নাম লিখে দিবি?’ আমার কোনও আপত্তি নেই। এই প্রথম আর কারও নাম লেখার সুযোগ পাচ্ছি। নতুন বিষয় পাচ্ছি আসলে। কেন লিখব না! বললাম, ‘হ্যাঁ।’ তিনি নাম বললেন সেই মানুষটির। তবে, সেই প্রথম, শুরুতে ঈশ্বর-চিহ্ন লিখতে হল আমাকে। কারণ মানুষটি মারা গিয়েছিলেন। আমি এই কাজের জন্য পেয়েছিলাম চার আনা। আমার জীবনের প্রথম ইনকাম ওই মৃত মানুষের নাম লিখে।
কিন্তু এ চাকরি বেশিদিন বহাল থাকল না। দু’-চারদিন পরেই দেখলাম দূর থেকে একজন হেঁটো লুঙ্গি পরা লোক আসছে। আমি হাতের কাঠকয়লা তড়িঘড়ি ফেলে, উল্টো রাস্তা দিয়ে দৌড় দিলাম বাড়ির দিকে। সেই লোক– আমার বাবা।
কিন্তু সেই দেওয়াল আজও খুঁজে বেড়াচ্ছি আমি চারকোল হাতে। আমার ছবি আঁকা, নাম লেখা এখনও ফুরোয়নি।
(চলবে)
…আরও পড়ুন ত্রিনয়ন ও ত্রিনয়ন…
পর্ব ২: আমার শরীরে যেদিন নক্ষত্র এসে পড়েছিল
পর্ব ১: ছোট থেকেই মাটি আমার আঙুলের কথা শুনত