‘ক্যাপসুলা মুন্ডি’– এই প্রকল্পটি মৃত্যু-পরবর্তী বিষয়ে চিন্তাভাবনার ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতির কল্পনা ও প্রয়োগ করে। পাশ্চাত্যের চিরাচরিত নিয়ম ‘কফিন’ ভাবনা পালটে তৈরি হল বেশ অন্য ধরনের একটি সমাধি। সমাধি দেওয়ার ক্ষেত্রে মূলত একটি আধারের প্রয়োজন। আর এখানে সেই আধারটি হল ডিম্বাকৃতি বায়োডিগ্রেডেবল একটি পড। যা নির্মিত মাটি, জৈব সমন্বয় দিয়ে। তবে, আপনারা হয়তো ভাবছেন, এতে আর অভিনব কী হল! সেটাই বলছি এইবার। এই পডের মধ্যে মৃতদেহের কিংবা দেহাবশেষের ছাই স্থাপন করা হলে ওর ওপরে রোপন করা হবে ছোট্ট একটি গাছের চারা।
আচ্ছা! হারকিউলিসের কথা তো আমরা প্রায় প্রত্যেকেই জানি– অর্ধেক ঈশ্বর অর্ধেক মানুষ। কিংবা, রিক রিওরড্যানের বিখ্যাত ‘পারসি জ্যাকসন’ শীর্ষক উপন্যাসের থ্যালিয়া গ্রেসের কথাও বোধহয় কেউ কেউ পড়েছি। দৈত্যদের হাতে মারা যাওয়ার পরে যে গাছ হয়ে গিয়েছিল। এবং পরে গাছদের এক দুর্ভেদ্য পরিখা তৈরি করে তার নিজের গ্রাম ‘ক্যাম্প অফ হাফব্লাডে’র রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়িয়েছিল সে!
এসব শুনলে অদ্ভুত মনে হয়, তাই না! কিন্তু বাস্তবে আমরা কি এমন কিছু ভাবি আদৌ! একুশ শতকের উন্নত কালরেখায় যেখানে চারপাশ দূষিত হচ্ছে নিত্যদিন, বিঘ্ন ঘটছে জীবকুলের ভারসাম্য, সেখানে আমরা কি এখনও পরিবেশ নিয়ে খানিক সিরিয়াস চিন্তা করব না?
মানুষের মৃত্যুর পরে বিভিন্ন ধর্মীয় নিয়ম মেনে তার প্রাণহীন শরীরটার শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়, এমনটাই তো রীতি। এবং তা মূলত কখনও আগুনে ভস্ম করে, কখনও-বা ভূগর্ভে কবর দিয়ে। কিন্তু, যিনি খানিক আগে এই নশ্বর দেহটি ছেড়ে না-ফেরার দেশে পাড়ি দিলেন চিরতরে, তার মাধ্যমে যদি একটু একটু করে বেড়ে ওঠে আরও একটি প্রাণ, যা শুধুমাত্র আমাদের প্রিয়জনদের কথা মনে করাবে, তা-ই নয়, আজীবন শেখাবে জীবনপাঠ, রক্ষা করবে পরিবেশের ভারসাম্য, তবে কেমন হয়!
এমনই এক চাঞ্চল্যকর, অভিনব ভাবনার কথা শোনাব এই লেখাটির মাধ্যমে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে মাটির নিচে প্রোথিত করা হবে এই ‘ক্যাপসুলা’টি, এমনভাবে, যেন ওপরের ছোট্ট গাছটি মাথা তুলে উঠে থাকে মাটির ওপরে, এবং অন্যান্য সম্পূর্ণ ডিম্বাকৃতি পডটি মাটির নিচে। ব্যস্, এটুকুই। এরপর ধীর প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় একটু একটু সেই মৃতদেহখানা নষ্ট হবে সময়ের ব্যবধানে, আর, ওই জৈব সারের মাধ্যমে পুষ্টি সংগ্রহ করে বেড়ে উঠবে গাছটি। একদিন যা পরিণত হবে মহীরুহে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
‘ক্যাপসুলা মুন্ডি’ (Capsula Mundi), নিউ ইয়র্কে সাড়া ফেলে দেওয়া একটি প্রকল্প, যার কর্ণধার পাওলো অ্যান্তনেলি। ‘মানুষের মৃত্যুর পরে তাঁর দেহটি পরিণত হবে গাছে’, এই অভিনব পরিকল্পনাটির ওপর নির্ভর করে সাজানো হয় ‘ক্যাপসুলা মুন্ডি’র ভাবনা। এইবার বরং দেখি, কী সেই ভাবনা–
এই প্রকল্পটি মৃত্যু-পরবর্তী বিষয়ে চিন্তাভাবনার ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতির কল্পনা ও প্রয়োগ করে। পাশ্চাত্যের চিরাচরিত নিয়ম ‘কফিন’ ভাবনা পালটে তৈরি হল বেশ অন্য ধরনের একটি সমাধি। সমাধি দেওয়ার ক্ষেত্রে মূলত একটি আধারের প্রয়োজন। আর এখানে সেই আধারটি হল ডিম্বাকৃতি বায়োডিগ্রেডেবল একটি পড। যা নির্মিত মাটি, জৈব সমন্বয় দিয়ে। তবে আপনারা হয়তো ভাবছেন, এতে আর অভিনব কী হল! সেটাই বলছি এইবার। এই পডের মধ্যে মৃতদেহের কিংবা দেহাবশেষের ছাই স্থাপন করা হলে ওর ওপরে রোপন করা হবে ছোট্ট একটি গাছের চারা। তখন এই ‘ক্যাপসুলা মুন্ডি’ পরিবর্তিত হবে একটি প্রাণের বৃহত্তর বীজ হিসেবে।
তবে এখানেই শেষ নয়। এরপর একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে মাটির নিচে প্রোথিত করা হবে এই ‘ক্যাপসুলা’টি, এমনভাবে, যেন ওপরের ছোট্ট গাছটি মাথা তুলে উঠে থাকে মাটির ওপরে, এবং অন্যান্য সম্পূর্ণ ডিম্বাকৃতি পডটি মাটির নিচে। ব্যস, এটুকুই। এরপর ধীর প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় একটু একটু সেই মৃতদেহখানা নষ্ট হবে সময়ের ব্যবধানে, আর, ওই জৈব সারের মাধ্যমে পুষ্টি সংগ্রহ করে বেড়ে উঠবে গাছটি। একদিন যা পরিণত হবে মহীরুহে।
এই প্রকল্পটিতে বেশ কয়েকটি উন্নত ভাবনা রয়েছে। যেমন–
প্রথমত, এই প্রক্রিয়াটি সম্পূর্ণরূপে পরিবেশবান্ধব। যা দীর্ঘকালের ছাপ রাখবে পরিবেশের ভারসাম্যের ওপর। খুব কম সময়ে উন্নত আবহাওয়াও ফিরে পাব আমরা।
দ্বিতীয়ত, আর কখনও ‘ফিরে না-পাওয়া’ প্রিয়জনের দীর্ঘকালীন স্মৃতি সংরক্ষণ। যখন যখন আপনি, আমি গিয়ে দাঁড়াব ওই গাছটির তলায়, তখনই আমরা অনুভব করতে পারব প্রিয়জনের স্পর্শ।
তৃতীয়ত, গ্রাম ও শহরের ধুলো-ধূসর প্রান্তগুলো রাতারাতি পরিবর্তিত হবে প্রাণবন্ত অরণ্যে। যা দৃষ্টিনন্দনও বটে। এছাড়া ছোট শিশুরাও মাঝেমধ্যে ওই স্থানে ঘুরে ঘুরে দেখতে পারবে বিভিন্ন প্রকার গাছগাছালি। বংশের পূর্ববর্তী সদস্যের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন অর্থে খানিক জল দিয়ে আরও বড় করে তুলবে গাছগুলিকে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: দেশ সেকুলার তবু শেষকৃত্য সেকুলার নয়
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
তবে, এতে যে চমৎকার কাজটি হবে তা হল, শিশুদের মনে আপনা থেকেই গড়ে উঠবে বিভিন্ন প্রাণের প্রতি মায়া, মমতা। তারা নিবেদিত হবে পরিবেশ রক্ষার্থে, এবং পরবর্তীকালে ‘পরিবেশ রক্ষা সমিতি’র আর কোনও প্রয়োজন থাকবে না এই বিশ্বে। আমরাও উপহার পাব এক গঠনমূলক সুষ্ঠু সমাজ, যারা পরিবেশবান্ধবও বটে। এবং একে অপরের প্রতি দায়বদ্ধও।
পরিশেষে, আমরা কি এখনও ভাবব না এই বিষয়ে? মান্ধাতার আমলের ফোন, গাড়ি কিংবা বাড়িটি যদি আমরা পালটে ফেলতে পারি নিমেষে, তবে এই শতকে এসেও কেন চিরাচরিত ভাবনাগুলি আঁকড়ে বসে থাকব বলতে পারেন?
রবীন্দ্রগানের একটি পঙক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করব–
‘তবু মনে রেখো যদি দূরে যাই চলে।
যদি পুরাতন প্রেম ঢাকা পড়ে যায় নবপ্রেমজালে।…’