সুমনের গান বিনে আধুনিক মননের বাঙালির দিনযাপনে খামতি থেকে যায়। এমন নয় যে, তিনি প্রতিদিন এসে সকলের কানে কানে গান শোনান। তবু সুমনের মঞ্চ উপস্থাপনা তো বাংলার সাংস্কৃতিক মানচিত্রে একটি অদৃশ্যপূর্ব ঘটনা। দশকে দশকে তার বিবর্তন হয়েছে, তবে, মেজাজ-মর্জি বদলায়নি। সেখানে দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গেই থাকেন লেওনার্ড কোহেন। শ্যামল মিত্রের পাশেই থাকেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। চলতি রাজনীতির রাজনৈতিক ক্রিটিকের হাত ধরেই থাকে রাজনীতির লুপ্তপ্রায় সৌজন্য; সলিল চৌধুরীর সুরে সুরে ‘লাল’ শব্দকে উজ্জ্বল করে দেওয়ার পাশেই থাকে নকশলাবাড়ি। গান-প্রেম-বিরহ-বেদনা-কামনা-চিৎকারের এমন মূর্ত পলিটিক্যাল জ্যান্ত ছটফটানি আর কেই-বা যত্নে-আদরে তুলে ধরতে পারেন!
মনে রাখবেন, আমি কবীর সুমন!’
পঁচাত্তরের জন্মদিন পেরিয়ে এসে তিনি আবার গান ধরেছেন। গাইছেন বসন্তের বাতাসে, এই কলকাতায়। সেই সুমনোচিত কথালাপ, আর নদীদের স্বরলিপিতে ভেসে যাওয়া অনন্ত গানের ভেলা। বাংলা গানের হয়ে-ওঠা ইতিহাস। তিনি বলছেন, গাইছেন। গলা উঠল সুমন-মর্জিতে, কণ্ঠের যে-ওজস্বিতার সঙ্গে কয়েক দশক বাঙালির নাড়া বাঁধা। কলকাতার আকাশে নেহাতই ঝুলে থাকতে থাকতে ১৭ মার্চের ছাপোষা আধখানা চাঁদ হঠাৎ যেন চমকেই উঠল। বসন্তের হাওয়ার কারবার স্তব্ধ এক লহমা! কে বলে মানুষটা পঁচাত্তর! আর তিনি, তিনি কবীর সুমন ঠিক তখনই বলে উঠলেন, ‘গলার জন্য যে আধুনিক গান গাইতে চাইছিলাম না, এমনটা ভাববেন না। গাইতে ভাল্লাগ্ছিল না। এখন পাশে সহশিল্পীরা এমন বাজনা বাজাচ্ছেন, ওই কর্ড-প্রগ্রেশন শুনতে শুনতে আবার গাইতে ইচ্ছে করছে। মনে রাখবেন, আমি কবীর সুমন।’
বাঙালি জানে, কবীর সুমনের ‘ভাল্লাগ্ছিল না’-র ভিতর থাকে নতুনের ভ্রূণ। সে বহু বছর আগের কথা। ঠিক এভাবেই অন্য ভাষায় গানের তালিম নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন এক যুবক। নিজের ভাষায় গানের কথার সঙ্গেও নিজের প্রতিবেশকে মেলাতে পারছিলেন না কিছুতেই। তাঁর ভালো লাগছিল না। নিরর্থক উচ্চারণের অন্তর্গত ক্লান্তি যখন তাঁকে বিপন্ন করছিল, তখনই শুরু হয়ে গিয়েছিল এক অশ্রুত টিক্ টিক্। যুবকটি পথ খুঁজছিলেন। নিজের সময়ের ভাষা খুঁজছিলেন। পণ করেছিলেন, নিজের ভাষায় যদি নতুন গান তৈরি করতে পারেন, তাহলে আবার ফিরবেন। সেই নতুনের জন্য তাঁকে গানের চেনা পথ ছাড়তে হয়েছিল। তবে, শুধু ফিরলেন না। বাংলা গানের জবান বদলে দিয়ে ফেটে পড়লেন দারুণ এক বিস্ফোরণে। এ সবই চেনা-জানা কিস্সা, নতুন করে ঝালিয়ে নেওয়া। কেননা, কবীর যখন বলেন, চেনা পথ ভাল্লাগছে না, তাহলে বাঙালির আশায় বুক বাঁধারই কথা। নতুন কিছু না করে, নতুন পথ চিনিয়ে না দিয়ে তিনি ফিরে যাবার বান্দা নন। অতএব বাংলা খেয়াল। খোদার কসম, কবীরের নতুন লড়াই। সংগীতের গূঢ় রসে যাঁরা বঞ্চিত, তাঁদের কাছে খেয়াল তো নেহাতই দূরের তারা। ঘরে ফেরার পথে শান্তি আনা সন্ধেতারা তা কি হয়ে উঠতে পারে! কবীর বলছেন, কেন হবে না? আধুনিকের লোভে যাঁরা হাজির হয়েছিলেন, এদিনের অনুষ্ঠানে তাঁরা বিস্ময়ে খেয়াল করলেন, খেয়াল বিশেষত বাংলা খেয়াল-ও কেমন আধুনিক হয়ে উঠতে পারে। তবে, শর্ত একটাই। সরস্বতীর বীণা আর কলম– দু’টিই সঙ্গে থাকতে হবে। কবীর আর তাঁর সহশিল্পীরা গাইছেন, ‘ফিরে ফিরে আসো তুমি/ দেখা দাও বলব না, বলব না ছুঁয়ে যাও/ দূরে আছ এই ভালো, কেন আর ডাক দাও!’ ‘বসন্ত’-এর নেশা যখন ছড়িয়ে দিচ্ছেন কবীর, তখন মনে হয়, খেয়ালের আঙ্গিকে আধুনিক গানের সঙ্গেই যেন কথোপকথন চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। আড়াল রেখে যে দূরে থাকে আর ডেকে ডেকে যায়, তার উদ্দেশে, বাংলা আধুনিক গান একদা প্রশ্ন করেছিল, কে তুমি তুমি আমায় ডাকো? কবীরের বাংলা খেয়াল পরিণত প্রেমে এই বসন্তে এসে বলল, বরং দূরেই থাকো। ‘দূরত্বে প্রেম’- এ তো শুনেছিলেন বাংলার কবি রণজিৎ দাশ। এক মুহূর্তেই কবীরের বাংলা খেয়াল ছুঁয়ে ফেলল ভাষা-সংগীতের অবিশ্বাস্য নতুন দিগন্ত। কই না, খেয়ালের আসর থেকে পালাতে ইচ্ছে তো করছে না! এবার আর একটু মনকেমনিয়া ‘বাহার’-এ শুরু হল, ‘সে যে কখন দেখা দেবে, সেই খবর হাওয়ায় আসে, প্রতীক্ষাই জীবন জুড়ে, আসা-যাওয়ার পথের পাশে।’ মনে হয়, পলাতকা ছায়া ফেলে যে এসেছিল অথচ আসে নাই জানিয়ে গিয়েছিল, তাকে দেখার বাসনা যেন উসকে দিলেন কবীর, খেয়ালের আঙ্গিকেই। এ-ও সম্ভব! সকলেই তো শুনলেন নিবিষ্ট, ঠিক যেভাবে এতদিন শুনেছেন ‘সাড়া দাও’ কিংবা ‘সারারাত জ্বলেছে নিবিড়’। আধুনিক আর খেয়াল পরস্পর বিপ্রতীপ নয়, থাকতে পারে আলিঙ্গনেও। যদি ভাষা ছুঁয়ে ফেলে সময়ের শোণিতপ্রবাহ আর পরিবেশন হয় সময়ের মতোই সচল, আধুনিক, স্মার্ট। অপূর্ব এই মিলন! বলতে ইচ্ছে করে, এ যেন বাস্তবতার অচেনা জাদু-সম্ভাবনা। যিনি সম্ভব করে তুলতে পারেন, বাঙালি মনে রাখে, রাখবে, তিনি কবীর সুমন।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
বাঙালি জানে, কবীর সুমনের ‘ভাল্লাগ্ছিল না’-র ভিতর থাকে নতুনের ভ্রূণ। সে বহু বছর আগের কথা। ঠিক এভাবেই অন্য ভাষায় গানের তালিম নিতে নিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন এক যুবক। নিজের ভাষায় গানের কথার সঙ্গেও নিজের প্রতিবেশকে মেলাতে পারছিলেন কিছুতেই। তাঁর ভালো লাগছিল না। নিরর্থক উচ্চারণের অন্তর্গত ক্লান্তি যখন তাঁকে বিপন্ন করছিল, তখনই শুরু হয়ে গিয়েছিল এক অশ্রুত টিক্ টিক্। যুবকটি পথ খুঁজছিলেন। নিজের সময়ের ভাষা খুঁজছিলেন। পণ করেছিলেন, নিজের ভাষায় যদি নতুন গান তৈরি করতে পারেন, তাহলে আবার ফিরবেন। সেই নতুনের জন্য তাঁকে গানের চেনা পথ ছাড়তে হয়েছিল।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
তবু নতুন নিষ্ঠুর, বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কবীরের এহেন নতুনের মুখোমুখি হওয়ার আগে তাই খানিক নিষ্ঠুরতার আভাসও ছিল। তিনি জানিয়েছিলেন, আধুনিক গানের অনুষ্ঠান আর করবেন না, এই শেষ। সুমনের গান বিনে আধুনিক মননের বাঙালির দিনযাপনে খামতি থেকে যায়। এমন নয় যে, তিনি প্রতিদিন এসে সকলের কানে কানে গান শোনান। তবু সুমনের মঞ্চ উপস্থাপনা তো বাংলার সাংস্কৃতিক মানচিত্রে একটি অদৃশ্যপূর্ব ঘটনা। দশকে দশকে তার বিবর্তন হয়েছে, তবে, মেজাজ-মর্জি বদলায়নি। সেখানে দিলীপকুমার রায়ের সঙ্গেই থাকেন লেওনার্ড কোহেন। শ্যামল মিত্রের পাশেই থাকেন অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত। চলতি রাজনীতির রাজনৈতিক ক্রিটিকের হাত ধরেই থাকে রাজনীতির লুপ্তপ্রায় সৌজন্য; সলিল চৌধুরীর সুরে সুরে ‘লাল’ শব্দকে উজ্জ্বল করে দেওয়ার পাশেই থাকে নকশলাবাড়ি। গান-প্রেম-বিরহ-বেদনা-কামনা-চিৎকারের এমন মূর্ত পলিটিক্যাল জ্যান্ত ছটফটানি আর কেই-বা যত্নে-আদরে তুলে ধরতে পারেন! এমন মঞ্চের শেষ উপস্থাপনা! ‘সুমনিস্ট’দের (যে শব্দে এখন সুমন-অনুরাগীরা নিজেদের পরিচয় দিয়ে থাকেন) বুকের ভিতর অদৃশ্য চিনচিন! আর সেই মঞ্চেই গিটারের কর্ড ফিরিয়ে দিল সাত রাজার ধন এক মানিক। তিনি বললেন, ‘আবার আধুনিক গানের অনুষ্ঠান করব, এই শেষ নয়।’ স্বস্তির শ্বাস জ্যোৎস্না মেখে ভেসে গেল কলকাতার উপর দিয়ে। যাক, এবারের মতো বসন্ত তাহলে গত নয় জীবনে!
আসলে কবীর সুমন এক অনন্ত সিরিয়াস পাগলামি। যে-পাগলামির নাম শিল্প, সৃষ্টি, প্রেম; অমরত্বের প্রত্যাশা নস্যাৎ করে অমরত্ব স্পর্শ করে ফেলা এক জীবনে। এই যে অনুষ্ঠানে পবিত্র সরকারের মতো প্রবীণ বনস্পতি থেকে বছর দশেকের খুদে পর্যন্ত ঠায় বসে তাকিয়ে দেখলেন এক পঁচাত্তরের তরুণের কাণ্ডকারখানা, এই অর্জন অসম্ভবপ্রায়। অথচ বাস্তব; তাঁকে নিয়েও তাই পাগলামির অন্ত নেই। কবীর নিজেও তা জানেন। আর জানেন বলেই, একযোগে কয়েক প্রজন্মকে তিনি পৌঁছে দিতে চান বাংলা ভাষার নতুন দিগন্তে। তাঁর মাধ্যম সংগীত। আঙ্গিকে কখনও তা আধুনিক, অধুনা খেয়াল। তিনি ক্রমাগত আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। সেই যে ব্রেখট তাঁর ডায়রিতে লিখেছিলেন, পূর্বসূরির আমলের অপূর্ব কারুকাজের সব আসবাবের কথা। যার প্রতি বিন্দুতে মিশে আছে শিল্পীর মেধা ও শ্রম। ব্রেখট বলছেন, সেদিকে তাকালে ‘মহৎ চিন্তার পথ’ প্রশস্ত হয়। কবীর সুমন সেই জীবন্ত ইতিহাস যাঁর প্রতি পরতে বাঙ্ময় বাংলা ভাষা, সংগীত ও সংস্কৃতি। তাঁর সকল গান আমাদেরই লক্ষ্য করে। সেদিকে তাকালে ব্যক্তিগত চিন্তার পথ আর একটু মহৎ হয়ে উঠতে পারে। সেই সুযোগ করে দেন সুমন, এই পঁচাত্তরেও। বুকের গভীরে আধুনিকে-খেয়ালে সুমন-বসন্ত নিয়ে ফিরলেন যাঁরা, তাঁরাই জানেন এই তাকানোর নেশা। সে-নেশা ধরাতে পারেন, একজনই। বলতে পারেন, মনে রাখবেন, আমি…
খোদার কসম গান, আমরা মনে রাখব, আপনি কবীর সুমন!
দরজার সামনে শম্ভু মিত্র, রেকর্ডিং শেষ করে সবে ফ্লোর থেকে বেরিয়েছেন। গম্ভীর মানুষ, সাহস সঞ্চয় করে কাছে গিয়ে প্রণাম করি, মাথায় হাত রাখলেন। পাশে ছিল চৈতি ঘোষাল অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওর বাড়ির টিভিতে আমাকে দেখতে পায় তাই এই বিস্ময়, নিচু গলায় জানাল ডাকঘরের অমল।