প্রথম গুরু যে আমার। যে জানে আমার প্রথম সব কিছু! গৌতমদাকে (গৌতম ভট্টাচার্য) নিয়ে লেখায় লিখেছিলাম, ইন্টারভিউয়ের পর কেমন তিনি আমায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সব্যদার কাছে। বলেছিলেন, ‘সব্যসাচী একে তালিম দিয়ে দাও।’ আর সেই যে ধপ করে চেয়ার টেনে সব্যদার পাশে বসে পড়া, পরের পাঁচ বছর আর উঠিনি সে চেয়ার থেকে! নাহ্, পাঁচ বছরের বেশি ‘আনন্দবাজার’-এ আমি পাইনি সব্যদাকে। ২০০৭ থেকে ২০১২। ব্যস। যে না পাওয়ার জ্বালা এখনও কাজ করে। আজ যৎসামান্য যা লিখতে পারি, তার ভিতপুজো করে দিয়ে গিয়েছিল সব্যদা। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও ঠিক, সব্যদা ‘আনন্দবাজার’ ছেড়ে চলে না গেলে লেখা আমি শিখতে পারতাম না!
সব্যদা একদম বাচ্চাদের মতো। সব্যদা এখনও বড় হয়নি। ধুর, সব্যদা কখনও বড়ই হয়নি!
ফোলা গাল। গোল চশমা। দোল-দোল দুলুনি চলন। সিগারেট টানার সময় মুখ আবার অজান্তে পোঁটলা করে ফেলে! ফোনে এক কথা পাঁচবার বলে! দিনে সাত বার ‘মহাশত্রু’দের উদ্দেশে উচ্চাঙ্গ হুমকি দেয়। শেষে দুম করে সব ভুলে যায়। হাতে তখন কী করে যেন একটা কলম চলে আসে। সাদা কাগজের গায়ে ভালোবাসার দাঁত বসায় কালো কালি। জন্ম নেয় কিছু অক্ষয় অক্ষর, ভূমিষ্ঠ হয় কবিতা!
বড় ভালো লেখে সব্যদা। খেলার লেখা। লেখার খেলা। সাহিত্য। কবিতা। লিখতে বসলে ঈষৎ ঝুঁকে যায় কম্পিউটারের কাঁখে। অনামিকা, মধ্যমা, তর্জনীরা লেখায় সুর দেয় তখন। বাংলা ভাষার ডাকিনী-যোগিনীরা মন্ত্রগুপ্তি দিতে নামে সব্যদাকে তারপর (যদিও চর্মচক্ষে দেখিনি, তবে আলবাত দেয়, না হলে ও লেখা বেরবে না মশাই)। সব্যদাও অবলীলায় সৃষ্টি করে শব্দের রাগ-রাগিনী। একমনে। আনমনে। দেখতে দেখতে কেমন যেন নেশা ধরে যায়। ঝিমুনিরা জড়ো হয় সব। আফিমের মৌতাতের মতো।
সব্যদা, অর্থাৎ বর্তমানে ‘এই সময়’-এর ক্রীড়া সম্পাদক সব্যসাচী সরকারের কাছে আমার ‘দীক্ষালাভ’ আনন্দবাজারে যোগদানের পর নয়, অনেক আগে। এক ঘুম-ঘুম দুপুরে। যখন ‘আনন্দমেলা’ খুলে বসেছিলাম। একটা গল্প লিখেছিল সব্যদা। সম্ভবত, এমসিসি ইলেভেন বনাম বিশ্ব একাদশের ম্যাচ নিয়ে। যা স্বর্গের টিভিতে পাশাপাশি বসে দেখছিলেন ডন ব্র্যাডম্যান ও হ্যারল্ড লারউড! যে খেলায় ওয়াসিম আক্রমের একটা ডেলিভারি ব্রায়ান লারার পাঁজর ছুঁয়ে চলে যাওয়ার পর, লারউডের ঠোঁটে চিলতে হাসি ফুটে উঠেছিল! সব্যদা তাই লিখেছিল। সব্যদা আরও লিখেছিল, শচীনের ব্যাটিং দেখে কেমন উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন ডন। জানতাম– সব বানানো! গাঁজাখুরি। কিন্তু বিশ্বাস করতে ইচ্ছে হয়েছিল খুব। দেখতে ইচ্ছে করেছিল সেই স্রষ্টাকে, যার হাত দিয়ে এমন কল্পনার গল্প বেরয়। যে পারে স্বর্গ আর মর্ত্যকে এমন অসহ্য সুন্দর চরাচরে মিলিয়ে দিতে।
ভাবিনি, ক’বছর পরেই দেখা হবে তার সঙ্গে। ‘আনন্দবাজার’-এ। এক বিশ্বকর্মা পুজোর বিকেলে। প্রথম গুরু যে আমার। যে জানে আমার প্রথম সব কিছু!
গৌতমদাকে (গৌতম ভট্টাচার্য) নিয়ে লেখায় লিখেছিলাম, ইন্টারভিউয়ের পর কেমন তিনি আমায় পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সব্যদার কাছে। বলেছিলেন, ‘সব্যসাচী একে তালিম দিয়ে দাও।’ আর সেই যে ধপ করে চেয়ার টেনে সব্যদার পাশে বসে পড়া, পরের পাঁচ বছর আর উঠিনি সে চেয়ার থেকে! নাহ্, পাঁচ বছরের বেশি ‘আনন্দবাজার’-এ আমি পাইনি সব্যদাকে। ২০০৭ থেকে ২০১২। ব্যস। যে না পাওয়ার জ্বালা এখনও কাজ করে। আজ যৎসামান্য যা লিখতে পারি, তার ভিতপুজো করে দিয়ে গিয়েছিল সব্যদা। কিন্তু একই সঙ্গে এটাও ঠিক, সব্যদা ‘আনন্দবাজার’ ছেড়ে চলে না গেলে লেখা আমি শিখতে পারতাম না!
এ হেন পরস্পরবিরোধী বক্তব্য কেন, কী তার কারণ– পরে বলছি। সব্যদাকে নিয়ে আমার একমাত্র দগদগে ঘায়ের কথা আগে বলি। প্রথমে তেতো থাক। শেষ পাতে না হয় রাজভোগ আসবে!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
কম স্মৃতি যে নেই আমার সব্যদার সঙ্গে। দিনের পর দিন আমার লেখা ফেলে নতুন করে লিখে দেওয়া, ফোনে লেখার ‘অ্যাঙ্গেল’ বলে দেওয়া ছেড়েই দিলাম। জীবনের প্রথম ফ্লাইট যাত্রার আগে কোনটার পর কী করতে হবে, সিকিউরিটি চেক প্রথমে আসে না বোর্ডিং পাস সংগ্রহ, কাগজে নিজে লিখে দিয়েছিল সব্যদা! রাতের দিকে একটু ‘ফুয়েল’ লাগত সব্যদার। শব্দটা ও-ই বলত। ‘ফুয়েল’ নিতে যেত। আমিও ‘স্টেপনি’-র মতো সঙ্গী হতাম। কখনও ‘বার’। কখনও বাড়ি। সব্যদার বাড়ি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সব্যদা যখন আকস্মিকভাবে ‘আনন্দবাজার’ ছেড়ে ‘এই সময়’ চলে যায়, বিহ্বলতায় বাকরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। আমাকে সব্যদা বলেনি। কাউকেই বলেনি। স্রেফ ছেড়ে চলে গিয়েছিল! অথচ আমি বলেছিলাম সব্যদাকে। সর্বপ্রথম। গৌতমদাকেও বলার আগে। ‘এই সময়’-এর প্রস্তাব আমার কাছেও ছিল। তবে সব্যদা না করায়, আমি যাইনি। যাব না বলে দিয়েছিলাম। কিন্তু পরে সব্যদা নিজেই চলে গিয়েছিল। টেলিফোনে কথা হলে এখনও সেই প্রসঙ্গ ওঠে। সব্যদা নানা কারণ দেয়। বিবিধ ‘প্রবঞ্চনা’-র কথা বলে। আমি ‘হুঁ’, ‘হাঁ’, ‘ঠিকই’ বলি। আদতে পাশ কাটিয়ে যাই। শরীরের পোড়া দাগ নতুন করে কে আর ডলতে চায়?
করার নেই কিছু। আসলে সাতাশের অপরিণত মনে লেগেছিল বড়। আর পাঁচজন হলে লিখতাম না। মন কষাকষির ঝঞ্ঝাট নতুন করে বয়ে আনতাম না। কারণ, কিছু যেত-আসত না। কিন্তু সব্যদা আলাদা। তাই লিখব। বলব। যা বলার, যা করার প্রকাশ্যেই করব। সব্যদার সঙ্গে আমার চিরকাল সেই সম্পর্ক। নির্দ্বিধায় যাকে যা ইচ্ছে আমি বলতে পারি। পেরেছি। পারব। তাই বেশ করেছি, লিখেছি। একশোবার লিখব!
কম স্মৃতি যে নেই আমার সব্যদার সঙ্গে। দিনের পর দিন আমার লেখা ফেলে নতুন করে লিখে দেওয়া, ফোনে লেখার ‘অ্যাঙ্গেল’ বলে দেওয়া ছেড়েই দিলাম। জীবনের প্রথম ফ্লাইট যাত্রার আগে কোনটার পর কী করতে হবে, সিকিউরিটি চেক প্রথমে আসে না বোর্ডিং পাস সংগ্রহ, কাগজে নিজে লিখে দিয়েছিল সব্যদা! রাতের দিকে একটু ‘ফুয়েল’ লাগত সব্যদার। শব্দটা ও-ই বলত। ‘ফুয়েল’ নিতে যেত। আমিও ‘স্টেপনি’-র মতো সঙ্গী হতাম। কখনও ‘বার’। কখনও বাড়ি। সব্যদার বাড়ি।
এক-এক সময় সপ্তাহে দু’তিনদিন থেকে যেতাম সব্যদার বাড়ি। অর্বুদ বিষয় নিয়ে কথা হত। প্রেম। সাহিত্য। লেখা। সিনেমা। পরনিন্দা-পরচর্চা। ওর যাদবপুরের বাড়ি (বাড়িটার নামও খাসা, ‘সিলি পয়েন্ট’) শেষে এত ঘনঘন যেতাম যে, আমি কিছু না বললেও আমার খাবার রাখা থাকত! সব্যদার মা-ই পাঠিয়ে দিতেন। স্বাভাবিক। সব্যদার বাড়ি বসে কী করিনি আমি? বান্ধবীর সঙ্গে প্রেম করেছি। আবার প্রেম ভাঙার কান্নায় ভেঙেও পড়েছি।
লিখলাম না, সব্যদার সঙ্গে সব চলে। আসলে সব্যদার একটা বড় গুণ হল, জুনিয়রদের সামনে কখনও ‘সব্যসাচী সরকার’ হতে চায়নি। আমি না। প্রিয়দর্শিনী (রক্ষিত) না। প্রীতম (সাহা) না। কারও কাছে না। আনন্দবাজার স্পোর্টসের কেউ কেউ ‘কুচুটেপনা’ করে আমায় বলেছেন বটে, ‘মনার (সব্যদার ডাকনাম) পুরনো ফর্মা তো দেখিসনি! ধরাকে সরা জ্ঞান করত!’ না, দেখিনি। আমি কেন, আমার মতো কোনও জুনিয়রই দেখেনি। বরং সহমর্মিতা দেখেছি, ভালোবাসা পেয়েছি। সিএবি একবার ময়দানে গড়াপেটা নিয়ে নিজেদের অপদার্থতা ঢাকতে আমার নামে যখন প্রতিবাদী চিঠি পাঠায় (‘স্টোরি’টা আমি করেছিলাম), উত্তর লিখে দিয়েছিল সব্যদা। ঝেড়ে কাপড় পরিয়ে। ক’জন করে অমন? ভয়ে বলির পাঁঠার মতো তো তখন কাঁপছিলাম আমি। পরে জিজ্ঞেস করেছিলাম। জিজ্ঞেস করেছিলাম, জুনিয়রদের তুমি এত আশকারা দাও কেন? বাকিরা তো দেয় না। সিগারেটে টান দিয়ে সব্যদা উত্তর দিয়েছিল, ‘রাজু, তুই আমার চেয়ে ছোট। তোর বয়স আছে আমায় ছাপিয়ে যাওয়ার। আমার কিন্তু সেটা নেই। তাই জুনিয়রদের সঙ্গে কখনও দুর্ব্যবহার করবি না।’
পালন করার যা চেষ্টা করি এখনও। যাক গে। পূর্বে লিখেছিলাম, সব্যদা চলে যাওয়ার পর লোকসানের মতো আমার লাভও হয়েছিল। অবশ্যই হয়েছিল। আমার বেশ মনে হয়, সব্যদা সেই সময় থেকে গেলে, ‘আনন্দবাজার’ না ছাড়লে, আমার লেখায় নিজস্বতা আসতে আরও দেরি হত। হয়তো বা শেষে সময়ই পেরিয়ে যেত! সব্যদার ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিলাম যে! নিজের বলে কিছু আর তখন থাকত না। তবে সমান্তরাল একটা আক্ষেপ আছে। আরও কিছুটা সময় কাজ না করার আক্ষেপ, আরও কিছুটা শিখতে না পারার আক্ষেপ। জানি না, এ জীবনে কখনও আর সব্যদার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ আসবে কি না? হয়তো আসবে। হয়তো আসবে না। তবে এটুকু আমরা দু’জনেই জানি, আমরা দু’জন দু’জনের পরিপূরক। সব্যদার মনোযোগী ছাত্র দরকার। আর আমার দরকার সব্যদার মতো শিক্ষক। এবং শেষে একটা কথা আমি আরও জানি।
প্রতি গুরু-পূর্ণিমায় প্রথম ফুল আমি সব্যসাচী সরকারকেই দেব। আমৃত্যু!
(চলবে)
…পড়ুন খেলাইডোস্কোপ-এর অন্যান্য পর্ব…
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৯: ময়দানের ছবিওয়ালাদের কেউ মনে রাখেনি, রাখে না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৮: যারা আমার মাঠের পরিবার
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৭: অহং-কে আমল না দেওয়া এক ‘গোল’ন্দাজ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৬: যে দ্রোণাচার্যকে একলব্য আঙুল উপহার দেয়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৫: সাধারণের সরণিতে না হাঁটলে অসাধারণ হতে পারতেন না উৎপল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৪: মনোজ তিওয়ারি চিরকালের ‘রংবাজ’, জার্সির হাতা তুলে ঔদ্ধত্যের দাদাগিরিতে বিশ্বাসী
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৩: অনুষ্টুপ ছন্দ বুঝতে আমাদের বড় বেশি সময় লেগে গেল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১২: একটা লোক কেমন অনন্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পরিচর্যা করে চলেছেন বঙ্গ ক্রিকেটের
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১১: সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটের বার্নার্ড শ, সম্বরণই ‘পরশুরাম’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১০: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৯: খণ্ড-অখণ্ড ভারতবর্ষ মিলিয়েও ক্রিকেটকে সম্মান জানাতে ইডেনতুল্য কোনও গ্যালারি নেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৮: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৭: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৬: বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৫: ওভালের লাঞ্চরুমে জামাইআদর না থাকলে এদেশে এত অতিথি সৎকার কীসের!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৪: ইডেনের কাছে প্লেয়ার সত্য, ক্রিকেট সত্য, জগৎ মিথ্যা!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৩: এ বাংলায় ডার্বিই পলাশির মাঠ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২: গ্যালারিতে কাঁটাতার নেই, আছে বন্ধনের ‘হাতকড়া’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১: চাকরি নেই, রোনাল্ডো আছে