হোঁচট খেতে খেতে সময় বদলে যায়। কৌটো ভরা নারকেল নাড়ুর সঙ্গে ওপারের কথা আসে। শান্তিবাহিনী আসলে রাজাকার, বদর— এদের মিলিত রূপ। মুক্তিবাহিনী লড়ছে। লড়ছে ভিয়েতনামের গেরিলা, প্যালেস্তাইন যোদ্ধা। যে যেখানে মুক্তির জন্য লড়ছে সবাই আত্মীয়। ‘জয় বাংলা’র পাশে ‘ইনকিলাব’ ধ্বনি উঠল। তার পরপরই দেখি ৩৬৩ বছরের পুরনো ঢাকা সদ্যোজাত রাষ্ট্রের রাজধানী হল।
স্বপ্নময় চক্রবর্তীর ‘চতুষ্পাঠী’ একটি বহুপঠিত ও প্রশংসিত উপন্যাস। পরবর্তী সময়ে ‘দিশা’ পত্রিকায় লেখক ‘অনুপ্রবেশ’ নামে একটি ধারাবাহিক উপন্যাস লিখতে শুরু করেন, কিন্তু সেটি ১১টি পর্ব প্রকাশিত হয়ে বন্ধ হয়ে যায়। তারও পরে এই লেখা ‘জলের উপর পানি’। লেখাটিকে ‘চতুষ্পাঠী’র পরের অংশ বলা যায়। তাই এখানে কাহিনি পরিণতির দিকে গিয়েছে। ‘চতুষ্পাঠী’ শেষ হয় এভাবে, যেখানে পণ্ডিত অনঙ্গমোহন তাঁর পূর্ণচন্দ্র চতুষ্পাঠীর খাতাগুলি ছিঁড়ে ছিঁড়ে আগুন দিচ্ছেন। সেই আগুনে বসানো কেটলিতে ফুটছে চায়ের জল… হে জল, চায়ের জল হে, আমাদের অন্নভোগের অধিকারী করো। অন্তরকথা ছিল– অন্নই ব্রহ্ম। আমারে বাঁচাও।
‘জলের উপর পানি’র শুরু অনঙ্গমোহন জীবন বিপর্যয়ে এখন চা-বিক্রেতা। মোটামুটি সময় ১৯৬৭। বাম দলগুলো নির্বাচনে যাচ্ছে। এখান থেকেই উপন্যাসের চলার পথের সময় চিহ্নিত হয়ে যায়। এই কাহিনি অনঙ্গমোহনের বিপর্যস্ত পরিবারের। কিন্তু সেই পরিবারের অনঙ্গমোহন হয়ে ওঠেন দেশভাগের মুখ। আপত্তি জানিয়েও চা বিক্রেতা অনঙ্গমোহন খাদ্য আন্দোলনের শহিদসভায় বক্তৃতা দেন। পুলিশের গুলিতে শহিদ তাঁর নিকটজন। পূর্ব-পাকিস্তান থেকে স্রোতের মতো বাস্তুহারার দল আসছে। বাগবাজারের ভাড়াবাড়িতে স্থান হয়েছে অনঙ্গমোহনের। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে উদ্বাস্তু পল্লির। বিপন্ন অনঙ্গমোহন বাগবাজার ছেড়ে কলোনির জমি কিনে ঘর গড়তে চললেন। বিলুর পড়া শেষের পথে। ‘কলুনি হইল গিয়া সর্ব জিলার মিলন ক্ষেত্র। সর্ব জাতের।’ উপন্যাসের কাহিনি নির্মাণ হল উদ্বাস্তু কলোনির ভেতর ভেতর। অনঙ্গমোহন থাকলেন এ উপন্যাসের চালিকা শক্তি হিসেবে।
উপন্যাসে কলোনি বিস্তারের শাখাপ্রশাখা স্বপ্নময় লেখেন অনায়াসে। এমনকী, বিহার থেকে আসা মুসলিম জীবনও বর্ণনা করেন। এই অনায়াস গদ্যর মধ্যে সরস কথায় বুনুনি স্বপ্নময়ের সহজাত। রঙ্গ রসিকতা, পুববাংলার ভাষার ব্যবহার কাহিনিকে অপার সৌন্দর্যে সাজিয়ে দেন লেখক। ’৬৭ নির্বাচন পেরিয়ে সময় ধাবমান হল।
উপন্যাসে শুধু দেশভাগ নয়, আত্মা ভাগাভাগির যন্ত্রণার যে ছবি আঁকেন লেখক। যা ক্ষতবিক্ষত, রক্তাক্ত। অনঙ্গমোহনকে জব্বার লেখে– এতদিন হিন্দু যাহা আদেশ দিয়াছে মোছলমানে পালন করিয়াছে। এখন মোছলমানের কথাও হিন্দুর শুনিতে হইবে।
স্বপ্নময় নিজেও কাহিনির ভেতর বসবাস করেন। কাহিনির প্রয়োজনে ক্ষেত্রসমীক্ষা করেছেন। পায়ে পায়ে তিনি ঘুরছেন, দেখছেন। নানা আঙ্গিকে আলতো করে এক নাগরিক সমাজ তুলে এনে অন্য কাহিনি বুনে দিচ্ছেন। তারপরেও রাজনীতির কথাগুলো খোলস ছাড়িয়ে স্পষ্ট করে বলেছেন। সেখানে নেহরু, প্যাটেল, ফজলুল হক, শ্যামাপ্রসাদ বাদ যান না। এঁরা থাকেন, কিন্তু পাশাপাশি কাহিনিও থাকে। চরিত্ররা এসে এদের কথা কেড়ে নিয়ে নিজের গল্প তৈরি করেন। দেশ-কাল-রাজনীতির সঙ্গে জীবন জড়িয়ে যায় স্বাদে গন্ধে। জীবন যেন বার বার বিপন্ন হয়ে পড়ে।
স্বপ্নময় উপন্যাসে পুরনো কথা, স্বাধীনতার আগের কথাও ফিরিয়ে আনেন। বিশাল ক্যানভাস। কাহিনি পিছিয়ে যায়। ১৯৪২। গ্রামের ইমাম সাহেব বক্তৃতায় বলেন– বিলাতি কাপড়ের লুঙ্গি পিন্ধিয়া নামাজ পড়লে সেই নামাজ কবুল হয় না।
এদিকে পূর্ববাংলার-অসমের গভর্নর ফুলাল সাহেব বললেন– মোসলমানরা হল সরকারের ফেভারিট ওয়াইফ। মানে সুয়োরানি।
হোঁচট খেতে খেতে সময় বদলে যায়। কৌটো ভরা নারকেল নাড়ুর সঙ্গে ওপারের কথা আসে। শান্তিবাহিনী আসলে রাজাকার, বদর– এদের মিলিত রূপ। মুক্তিবাহিনী লড়ছে। লড়ছে ভিয়েতনামের গেরিলা, প্যালেস্তাইন যোদ্ধা। যে যেখানে মুক্তির জন্য লড়ছে সবাই আত্মীয়। ‘জয় বাংলা’র পাশে ‘ইনকিলাব’ ধ্বনি উঠল। তার পরপরই দেখি ৩৬৩ বছরের পুরনো ঢাকা সদ্যোজাত রাষ্ট্রের রাজধানী হল।
এরই পাশাপাশি চলে পৃথিবী বদলে যাওয়ার কথা। কাশীপুর, বরাহনগর, টবিন রোডে নকশাল নিধনযজ্ঞ। দেশ-বিদেশে দুনিয়ার লড়াইয়ের গল্প। স্বপ্নময় যেমন জীবন দেখেন তীর্যক দৃষ্টিতে, তেমনই শব্দকে উলটেপালটে দেখেন। যেমন, পূর্ব-পাকিস্তান থেকে স্রোতের মতো মানুষ আসে। স্রোত যদি জলের হয় তবে কিউসেক। কিন্তু মানুষের স্রোতের একক? স্বপ্নময় খোঁজেন। বিলু-উজমা ভাবী সন্তানের নামকরণ হয়, ছেলে হলে মেঘ, মেয়ে হলে বৃষ্টি। কিন্তু স্বপ্নময় এখানে থামেন না। মেঘ মানে, সেই মেঘ কিউমুলো নিম্বাস, বজ্রগর্ভ, তাই থেকে বৃষ্টি। মেঘের বিদ্যুৎরেখায় ফুটে উঠেছে ‘দ’। দম্যত, দত্ত, দয়ধ্বম। দমন করো, দান করো, দয়া করো। স্বপ্নময়ের সার্থকতা, তাঁর লেখনিতে শব্দ জীবনের সঙ্গে সঙ্গে শব্দব্রহ্ম হয়।
ওদিকে বিলুর জগৎ বাড়ছে। বিলুর প্রেমিকা লাহোরের মুসলিম কন্যা উজমা। বিয়ে হল, সংসারজীবন। শিবসেনা, বজরং দল। ১৯৯২। বাবরি ধ্বংস হল। আগুন জ্বলছে। আবার ঘরছাড়া। আবার মানুষ কাঁদছে। বিলু আর উজমা সন্তান চেয়েছিল– মুসলমান মা আর হিন্দু বাবার সন্তান। কিন্তু উজমা এখনও মা, তার গর্ভে মৃত সন্তান। মৃত হলেও সন্তান তো–।
দেশভাগ, দেশ হারানোর বেদনা, জাতের নামে বজ্জাতি, ধর্ম নিয়ে হানাহানি, উদ্বাস্তু জীবন, কলোনি পত্তন, ব্যর্থ আন্দোলন, নোংরা রাজনীতি, বাবরি ধ্বংস, বোম্বে ব্লার্স্ট-এর বহুমুখী যন্ত্রণাদায়ক, ক্ষতবিক্ষত বিচ্ছুরণ নিয়ে ‘জলের ওপর পানি’। কিন্তু তারমধ্যেই লেখকের সরস উপস্থাপনা, রাজনৈতিক বিশ্লেষণ, বিজ্ঞান ও সমাজ সচেতনতা উপন্যাসটিকে এক অন্যমাত্রায় নিয়ে যায়। ‘জলের উপর পানি না পানির উপর জল/ বল খোদা, বল খোদা, বল’ গানটি থেকেই উপন্যাসটির নাম। আর এই গানের নির্যাসই উপন্যাসটির অন্তরকথা। এই সুরই বিস্তার লাভ করেছে সমগ্র উপন্যাস জুড়ে।