লাদাখে জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদের মোকাবিলা করতে সমতলের পদ্ধতি চলবে না
Published by: Robbar Digital
Posted on: March 26, 2024 6:18 pm
Updated: March 26, 2024 6:18 pm
গত ৬ মার্চ থেকে ‘লে এপেক্স বডি’ সংগঠনের সমর্থনে অনশন সত্যাগ্রহ করছেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, পরিবেশবিদ, সমাজকর্মী সোনাম ওয়াংচুক। লাদাখের নানা শহরে চলছে নানা প্রতিবাদ আন্দোলন কর্মসূচি। ‘কার্গিল ডেমোক্রাটিক অ্যালায়েন্স’ সমর্থন জানিয়েছে সোনম ওয়াংচুকদের আন্দোলনে। সমগ্র লাদাখবাসীর সমর্থন তাঁরা পাচ্ছেন।
তাপস দাস
‘আসমুদ্রহিমাচল’।
ভারত ভূখণ্ডকে চিনতে এই শব্দই আমরা ব্যবহার করি। সমুদ্রতট থেকে পাহাড়, ঘন জঙ্গল থেকে সমভূমি হোক কিংবা মরুভূমি, মানুষ সমস্ত ভূমিরূপকে তাদের বাসযোগ্য মনে করেছে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই। তেমনই বাসযোগ্য ভূমিখণ্ড হিসেবে যোগ্য মনে হয়েছিল লাদাখ অঞ্চলকেও। বৃষ্টিপাত নেই, উর্বরজমির অভাব। বছরের সাত মাস অতিরিক্ত শীতল পরিবেশ। তাও মানুষের জীবন ছিল আনন্দে ভরপুর। সীমিত চাহিদা, সরল অতিথিপরায়ণ, সাদাসিধে জীবন লাদাখবাসীর। সেই মানুষগুলো যখন পথে নেমে আন্দোলন করে, তখন বুঝতে হবে নিশ্চয়ই বড়সড় কোনও সমস্যার মুখোমুখি লাদাখ।
৬ মার্চ থেকে ‘লে এপেক্স বডি’ সংগঠনের সমর্থনে অনশন সত্যাগ্রহ করছেন প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ, পরিবেশবিদ, সমাজকর্মী সোনম ওয়াংচুক। লাদাখের নানা শহরে চলছে নানা প্রতিবাদ আন্দোলন কর্মসূচি। ‘কার্গিল ডেমোক্রাটিক অ্যালায়েন্স’ সমর্থন জানিয়েছে সোনম ওয়াংচুকদের আন্দোলনে। সমগ্র লাদাখবাসীর সমর্থন তাঁরা পাচ্ছেন। প্রধানত দু’টি দাবি তাদের– প্রথমত, ভোট প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে লাদাখ বিধানসভা গঠন করা এবং লাদাখবাসীর হাতে ভূখণ্ডের মানুষ-সহ জীববৈচিত্র-প্রকৃতি সহনশীল বাস্তুতন্ত্র রক্ষার দায়িত্ব দেওয়া, পূর্ণ রাজ্য সরকার গঠন। দ্বিতীয়ত, ২৪৪ ধারা অনুসারে, ষষ্ঠ তপশিল তালিকাভুক্ত করে স্থানীয়দের সাংবিধানিক অধিকার সুনিশ্চিত করা।
বোঝা দরকার, জনসংখ্যার ৯৭% জনজাতি-মানুষের ভূখণ্ডে এই দুই দাবি সাংবিধানিকভাবে ন্যায্য। কিন্তু কর্পোরেট মুনাফা, আর্থিক বৃদ্ধিকে দেশ পরিচালনার প্রধান অক্ষ মেনে চলা বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার লাদাখবাসীর দাবি মানতে নারাজ। এমনকী, ২০১৯ সালের নির্বাচনী ইশতেহারের প্রথম সারিতে রাখা প্রতিশ্রুতি ‘ষষ্ঠ তফশিল তালিকায় অন্তর্ভুক্তি’, সেটাও মানতে চাইছেন না। বস্তুতান্ত্রিকভাবে সংবেদনশীল ও সীমান্ত সংলগ্ন এই ভূখণ্ডের মানুষ ও দিল্লির সরকারের পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস অটুট রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, দেশের অভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা বজায় রাখতে।
আমাদের বোঝা দরকার, সমতলের মতো একই ধাঁচে হিমালয়ের উন্নয়ন আমাদের অর্থাৎ সমতলেরও জীবন-জীবিকার পরিপন্থী। ইতিমধ্যেই বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় দেশজুড়ে কখনও অতি বৃষ্টি-বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়-সহ আরও নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে চলেছে। একমাত্র স্থানীয় সুষ্ঠু যথার্থ ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিপদের মোকাবিলা সম্ভব, আর সেটাই চাইছে লাদাখবাসী।
অনশন আন্দোলনের ১৯তম দিনে ৫০০০ মানুষ লে শহরে প্রতীকী অনশনে শামিল হন। লে-র মতো ছোট শহরে এই জমায়েত মানে বুঝতে হবে রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি প্রতিবাদ ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। সোনম ওয়াংচুক প্রতিদিনের মতো সমাজমাধ্যমের বার্তায় বলেছেন, “গতকালের প্রত্যেক বক্তা ‘ভারত মাতা কি জয়’ বলে কথা শুরু করেছেন আর ‘জয় হিন্দ’ বলে কথা শেষ করেছেন। এই মনোভাবের প্রতি বাকি ভারতেরও অটুট আস্থা রাখা উচিত।”
এখন বোঝা দরকার, আমরা কেন এই দাবিগুলোকে সমর্থন করছি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব সর্বত্র পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্র একটি বৃহৎ জালের মতো। তার কোনও একটি জায়গায় যদি ছিদ্র হয়, তাহলে সেই জালের কার্যকারিতা হ্রাস পায়, ক্রমে বিনষ্ট হয়। হিমালয়ের হিমবাহ ভারতবাসী ও জীববৈচিত্রের প্রাণপ্রবাহ জলের আধার। এই হিমবাহকে বাঁচিয়ে রাখা অত্যন্ত জরুরি। তাই বিজ্ঞানী ও হিমবাহ সংলগ্ন অঞ্চলে মানুষেরা বারবার দাবি তুলেছেন, হিমবাহ সংরক্ষণে যথার্থ ব্যবস্থা গড়ে উঠুক।
সমতলভূমির মতো চওড়া রাস্তা, সেই রাস্তায় অসংখ্য গাড়ির যাতায়াত, উঁচু উঁচু ইমারত, যথেচ্ছ খনিজ উত্তোলন হিমবাহগুলির ক্ষতি ডেকে আনছে। হিমালয়ের সহজ সাধারণ সহনশীল জীবন-যাপন হিমবাহ রক্ষার সহযোগী। আমাদের বোঝা দরকার, সমতলের মতো একই ধাঁচে হিমালয়ের উন্নয়ন আমাদের, অর্থাৎ সমতলেরও জীবন-জীবিকার পরিপন্থী। ইতিমধ্যেই বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনায় দেশজুড়ে কখনও অতি বৃষ্টি-বন্যা, খরা, ঘূর্ণিঝড়-সহ আরও নানাবিধ প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে চলেছে। একমাত্র স্থানীয় সুষ্ঠু যথার্থ ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত বিপদের মোকাবিলা সম্ভব, আর সেটাই চাইছে লাদাখবাসী। তাই নদী-পরিবেশ আন্দোলনে যুক্ত বিভিন্ন গণসংগঠন লাদাখবাসীর সংহতিতে ২৪ মার্চ সারা দেশজুড়ে সংহতি জানিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গেও পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্র মৎস্যজীবী থেকে রাজ্যের বিভিন্ন অংশের নদী তীরের সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ-সহ বিভিন্ন স্তরে থাকা মানুষ ১২ ঘণ্টার প্রতীকী অনশনে সামিল হয়েছেন। ধর্মতলার মোড়ে ৪টে থেকে ৬টা মানববন্ধনে কলকাতা শহর এবং শহর সংলগ্ন জেলা থেকে আসা ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠন, শিক্ষক মহল, বিজ্ঞানী, নদীকর্মী উপস্থিত থেকে তাদের সংহতি জানায়।