বর্তমান উপন্যাস পক্ষান্তরে ধরার চেষ্টা করেছে জীবনানন্দের কবিতার মেকানিজমকে। মাল্যবান কীভাবে জীবনানন্দ হয়ে প্রকাশিত হচ্ছেন কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, গদ্যে! কীভাবে ‘সকল লোকের মাঝে বসে’ও আলাদা তিনি! গৌতম লিখছেন– ‘কলকাতা শহরে যে মাল্যবানের বন্ধুবান্ধব নেই, তা কিন্তু নয়। আসলে কারও সঙ্গে কথা বলেই মাল্য়বান তেমন আনন্দ পায় না।’ হয়তো সেই কারণেই বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাছে গিয়েও শেষপর্যন্ত দূরে সরে যান জীবনানন্দ বা মাল্যবান।
‘কবিরে পাবে না তার জীবন চরিতে’। এই রবীন্দ্র-বচনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিজের আত্মজীবনীকে ‘অর্ধেক জীবন’ বলে ডেকেছিলেন। যেহেতু বহুমাত্রিক কারণে একজন কবির সম্পূর্ণ জীবন লেখা একটি ‘প্রায় অসম্ভব প্রকল্প’, তার ওপর তিনি যদি হন আত্মমগ্ন, প্রচারে অনুৎসাহী জীবনানন্দ দাশ, তাহলে তো কথাই নেই! রাতের আকাশের মতো ‘রহস্যময়তা’ জীবনানন্দের সমগ্র সাহিত্য ও জীবনের ভরকেন্দ্র। ‘কেন লিখি’র উত্তরে যিনি নিজেই প্রশ্ন ছোড়েন– ‘জীবন ছাড়িয়ে কোনও মানবীয় অভিজ্ঞতা থাকা কি সম্ভব?’ তাছাড়া ‘বনলতা সেন’-এর পরিচয় রহস্য, ‘অশ্লীল’ কবিতা লেখার দায়ে চাকরি চলে যাওয়ার মতো ঘটনা, এমনকী সভ্যতার সবচেয়ে নিরীহ যান– ট্রামে চাপা পড়ে মৃত্যু, এসব মিলিয়ে বাঙালির রক্তের ভিতরে ম্যাজিক ম্যান্ডোলিনের কনসার্ট বুনে চলে গিয়েছেন ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’র কবি। সেই জাদুকর জে এন দাস বা জীবনানন্দ দাশের জীবন অবলম্বনে উপন্যাস রচনার মতো কঠিন কাজ আর হয় না। সম্প্রতি সেই দুরূহ চেষ্টাই করেছেন প্রাবন্ধিক ও গবেষক গৌতম মিত্র।
‘ধানসিড়ি’ থেকে প্রকাশিত উপন্যাসের নাম যথাযথ– ‘প্রফেসর মাল্যবান দাশগুপ্ত দ্য ম্যাজিশিয়ান’। বিশেষত নামের লেজটি– ‘দ্য ম্যাজিশিয়ান’ এক্কেবারে লাগসই। ভূমিকাতে গৌতম জানিয়েছেন বন্ধু-সম্পাদকের অনুরোধে জীবনানন্দকে নিয়ে জীবনের প্রথম উপন্যাস লিখতে বাধ্য় হয়েছেন। ‘জীবনে যে-একটিও গল্প লেখেনি’, উপন্যাসের ‘মহাসমুদ্রে পাড়ি দেওয়া’ কি তাঁর জন্য ভুল হল? সত্যি বলতে ‘ঠিক ও ভুলে’র প্রাতিষ্ঠানিক গণ্ডি ডিঙিয়েছে এই আখ্যান। যেহেতু লেখক প্রখ্যাত জীবনানন্দ গবেষক। বাংলা সাহিত্যের বাজারে গৌতম মিত্রের মতো করে জীবনানন্দকে গুলে খাওয়া মানুষ মেলা কঠিন। কবির সঙ্গে যাঁর ‘ঘরকন্না’র বয়স দুই দশক। প্রথমে ভূমেন্দ্র গুহর সঙ্গে, পরে একক ছানবিন। এই পর্বে জীবনানন্দের কবিতা, গল্প, উপন্যাস উদ্ধারের পাশাপাশি সাধ্য মতো ডায়েরির এন্ট্রির রহস্যও উদঘাটন করেছেন আলোচ্য লেখক। সেই ‘জাদুবাস্তব’ ডায়েরিই বর্তমান উপন্যাসের ভ্রূণ।
কাহিনির মূল ভিত্তি ১৯৩১ সালের জীবনানন্দ দাশের লেখা ডায়েরির এন্ট্রি। প্রধান চরিত্র মাল্যবান দাশগুপ্ত। পাশাপাশি কবি জীবনানন্দ যেমন রয়েছেন। রয়েছে মিলুও (কবির ডাকনাম)। প্রয়োজন মতো বাস্তবের একটি মানুষের তিনটি ম্যাজিক লেয়ারকে ব্যবহার করেছেন গৌতম। এখানে মাল্যবান দাশগুপ্ত যেন জীবনানন্দ দাশের অল্টার ইগো। ‘মাল্যবান অথবা জীবনানন্দের লেখা আর পড়ার জগৎ, সূক্ষ্ম অনুভূতি, মর্মভেদী পর্যবেক্ষণ, পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও চরিত্রের বিশ্লেষণ এবং পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন’ উঠে এসেছে এই উপন্যাসে।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বাংলা সাহিত্যের বাজারে গৌতম মিত্রের মতো করে জীবনানন্দকে গুলে খাওয়া মানুষ মেলা কঠিন। কবির সঙ্গে যাঁর ‘ঘরকন্না’র বয়স দুই দশক। প্রথমে ভূমেন্দ্র গুহর সঙ্গে, পরে একক ছানবিন। এই পর্বে জীবনানন্দের কবিতা, গল্প, উপন্যাস উদ্ধারের পাশাপাশি সাধ্য মতো ডায়েরির এন্ট্রির রহস্যও উদঘাটন করেছেন আলোচ্য লেখক। সেই ‘জাদুবাস্তব’ ডায়েরিই বর্তমান উপন্যাসের ভ্রূণ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
এই লেখায় এসেছে সেইসব বিষয় যার কিছুটা জানা, অনেকটাই অজানা। যেমন জীবনানন্দ ও প্রকৃতির সম্পর্ক, জীবনানন্দ ও নারীর সম্পর্ক, জীবনানন্দ ও নশ্বর জীবনের সম্পর্ক, জীবনানন্দ ও কর্মজীবনের সম্পর্ক, জীবনানন্দ ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্ক। এই সমস্ত প্রশ্নের মধ্যে চলাফেরা করে বরিশাল, স্টিমার, প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং, কলকাতার রাস্তা, রাতের আকাশ, নতুন কবিতা, ডায়েরি, খাতা, কলম এবং অসংখ্য অসংখ্য নির্ঘুম রাত।
স্বভাবতই উপন্যাসের প্রথম পংক্তি– ‘রাতে ভালো ঘুম হয়নি মাল্যবানের।’ কারণ ‘স্বপ্নের উৎপাত’। এমনকী আত্মহত্যা প্রবণতা থেকেই শুরু হয় গৌতমের রচিত আখ্যান– ‘একটা তেতলা বাড়ির ছাদে মাল্যবান একা দাঁড়িয়ে আছে। মাথার উপর ঝলমল করছে তারা ভরতি আকাশ। ছাদ থেকে ঝাঁপ দিতে যাবে বা ঝাঁপ দিচ্ছে, ঠিক সেসময় ঘুমটা ভেঙে গেল।’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্রের পরিচয় পান পাঠক– ‘মাল্যবান দাশগুপ্ত, যার ডাকনাম মিলু; খাতায়-কলমে, কলেজে লেখা পৃথিবীতে যাঁর নাম জীবনানন্দ দাশ।’ এই নাম বিড়ম্বনার কথা উঠে এসেছে উপন্যাসে। ‘জীবানন্দ’ বলে কটাক্ষ করা হয়েছে তাঁকে। এ অবশ্যি সামান্য। কবিতা নিয়ে সজনীকান্ত দাসের আক্রমণের চেয়ে ঢের কম অপমান। যদিও হাড় হিম করা সত্যের উপাসক তিনি, অনন্ত প্রকৃতির সন্তানও। পাশাপাশি মায়াবী নারীর প্রেমিক। তারা শোভনা, মনিয়া, লাবণ্য… মাল্যবানের পছন্দের নারী অনেক!
বর্তমান উপন্যাস পক্ষান্তরে ধরার চেষ্টা করেছে জীবনানন্দের কবিতার মেকানিজমকে। মাল্যবান কীভাবে জীবনানন্দ হয়ে প্রকাশিত হচ্ছেন কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, গদ্যে! কীভাবে ‘সকল লোকের মাঝে বসে’ও আলাদা তিনি! গৌতম লিখছেন– ‘কলকাতা শহরে যে মাল্যবানের বন্ধুবান্ধব নেই, তা কিন্তু নয়। আসলে কারও সঙ্গে কথা বলেই মাল্য়বান তেমন আনন্দ পায় না।’ হয়তো সেই কারণেই বুদ্ধদেব বসু, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়ের কাছে গিয়েও শেষপর্যন্ত দূরে সরে যান জীবনানন্দ বা মাল্যবান। সাধনার অর্থ যে একক সাধনা, সেই ইঙ্গিতও ঔপন্যাসিক দেন। লেখেন– ‘মাল্যবান ইদানীং বিশ্বাস করে কাপালিক না হলে কবিতা লেখা যায় না।’
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: কৃত্রিম মেধার সময়ের বহু দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে মানিক চক্রবর্তীর গল্প-উপন্যাস
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
জীবনানন্দের জীবনের মতোই গৌতম মিত্রের এই উপন্যাস শেষপর্যন্ত কোথাও পৌঁছয় না। কেবল কবিতার মতো রহস্যের জাল বোনা একটি জার্নি! যেখানে জন্ম ও মৃত্যু নামের দুই অমোঘ স্টেশনও নেই! মুন্সিয়ানার সঙ্গে উপন্যাসের পর্ববিন্যাস করেছেন লেখক। যেমন– প্রেসিডেন্সি বোর্ডিং, স্টিমার, বরিশাল, পাণ্ডুলিপি, ক্যাম্পে, নক্ষত্রের দোষ। তবে এই লেখার প্রকৃত সাফল্য ঘটনাপ্রবাহে নয়, বরং সাহসের সঙ্গে রক্তমাংসের জীবনানন্দকে চেনার চেষ্টা। যেমন ‘ঝরা পালক’ পড়ে রবীন্দ্রনাথের বহুচর্চিত ‘ভাষা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে এত জবরদস্তি কেন করো বুঝতে পারিনে।’ এবং ‘বড় জাতের রচনার মধ্যে একটা শান্তি আছে, যেখানে তার ব্যাঘাত দেখি সেখানে স্থায়িত্ব সম্বন্ধে সন্দেহ জন্মে।’ এই মন্তব্যকে সম্পূর্ণ ভুল মনে করে মাল্যবান। পাঠক জানেন, বাস্তবেও পাল্টা চিঠি লিখে বরীন্দ্রনাথের মূল্যায়নকে শ্রদ্ধার সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন জীবনানন্দ দাশ। এইসঙ্গে খুড়তুতো বোনের সঙ্গে প্রেম হোক কিংবা মাল্যবানের ব্রথেলে যাওয়ার স্বীকারক্তি– ‘শরীরের ক্ষুধা এত প্রবল’।
শেষ বলতেই হবে পাঠক জীবনানন্দের কথা। জাদুকর এই কবির বহু ঘটনা মিথে পরিণত হলেও তাঁর পঠনপাঠন সম্পর্কে অবগত নন অনেকেই। সেই অনুসন্ধান দেয় কবির ডায়েরি। গবেষক গৌতম তাঁর উপন্যাসে মহাকবির পাঠক সত্ত্বাকে নিংড়ে ব্যবহার করেছেন। যেমন ‘দস্তয়েভস্তির লেখা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে নীটশে একটা কথা বলেছিলেন, রক্তের ভেতর থেকে বলা সত্য।’ উঠে এসেছে হেনরি ডেভিড থোরোর রচনা ‘ওয়ালডেন’-এর প্রসঙ্গ। যা আদতে জঙ্গলবাসের আশ্চর্য জার্নাল। মাল্যবানের প্রিয় বই। বোদলেয়ার পাঠ করে চমকে যান আমাদের উপন্যাসের ‘নায়ক’। জার্মান কবির মতোই তিনিও ‘কর্মী’ হতে চাননি কখনও, পারেনওনি। ক্ষুধার রাজ্যে থেকেও একের পর এক চাকরি খুইয়েছেন। একদিন এই সত্যে উপনীত হয়েছেন– পৃথিবীতে নেই বিশুদ্ধ চাকরি। শেষপর্যন্ত প্রশ্ন ওঠে, মাল্যবান ওরফে জীবনানন্দ দাশ আসলে কে? শিল্পের ইতিহাসে সম্রাট না ফকির?
আমরা উত্তর পাই– মাল্যবান ওরফে জীবনানন্দ যেহেতু ছদ্ম ম্যাজিশিয়ান, ফলে সফলতা-বিফলতা, সম্রাট-ফকিরের ঊর্ধ্বে তিনি। ঠিক কথা বলেছেন গৌতম– ‘বাস্তব ও কল্পনার, স্বপ্ন ও জাগরণের, জন্ম ও মৃত্যুর মাঝখানের অহেতুক পর্দা সরানো’র আশ্চর্য কাজ করতে এসেছিলেন বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ জাদুকর। তারপর একদিন নক্ষত্রের ট্রাপে চেপে মহাকাশে পাড়ি! সেই জীবনানন্দ, ‘সেই শমীবৃক্ষের নীচে বসে দূরভবিষ্যতে একদিন ওই দগ্ধ পাণ্ডুলিপির জন্য হাহাকার করবেন ভূমেন্দ্র গুহ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, দেবেশ রায়, ক্লিন্টন বি সিলি, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং একজন গৌতম মিত্র।’
প্রফেসর মাল্যবান দাশগুপ্ত: দ্য ম্যাজিশিয়ান
গৌতম মিত্র
ধানসিড়ি
২৫০ টাকা