ভ্যান গগ আসলে মানুষের শিল্পী। প্রকৃতি প্রিয় হলেও, মানুষকে পাশে সরিয়ে রেখে শুধুমাত্র প্রকৃতিকে উপভোগ করার বাসনা ওঁর ছিল না। সেই খনি শ্রমিক থেকে, কর্মরত নানা মানুষকে উনি অঙ্কনবদ্ধ করতে চেয়েছেন। তাদের দুঃখ, হতাশা, বেদনা, সবই ওঁর বিষয়ে ধরা ছিল। বিস্তীর্ণ প্রান্তর খুঁজতে মাইলের পর মাইল হাঁটতেন। আমার কল্পনায় ওই হাঁটা, ওই চলমানতা, ওঁর চলমান রেখায় প্রকাশ পেত। যখন কর্মরত মানুষ আঁকছেন, তখনও রেখা চলমান, শরীর চলমান।
এখান থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের এক প্রদেশ, এক ক্ষ্যাপা শিল্পী, দু’-পা কাদার মধ্যে রেখে, একটা খেতে, একটা প্রান্তরে, রেখা টেনে চলেছে। আমরা তাঁর কাঁধের ওপর দিয়ে দেখতে থাকি, সেই রেখার চলন, আশ্চর্য সেই চলন।
তাঁর নাম ভিনসেন্ট ভ্যান গগ বা গখ, ডাচ উচ্চারণে সম্পূর্ণ অচেনা একটা নাম শোনাবে। ফ্যান গখ।
ওঁর শিল্পী হওয়ার কথা ছিল না। তেমন আগ্রহও ছিল না। ধর্মযাজক হতে চেয়েছিলেন। মানব দরদি ছিলেন। যা অর্থ চার্চ দিত, তা প্রায় বিলিয়ে দিয়ে, অভুক্ত দিন কাটাতেন। চেষ্টা করতেন ওই খনি শ্রমিক, ওই গোষ্ঠীর একজন হয়ে উঠতে। পারেননি। ব্যর্থ হয়ে, হতাশ হয়ে, একসময় সাদা কাগজ, কোলের ওপর টেনে নিলেন। অন্যমনস্ক কাঠ কয়লার রেখা ফুটে উঠল। আস্তে আস্তে তা চরিত্র পেতে লাগল। প্রায় চমকে উঠলেন, আবিষ্কার করলেন নিজের শিল্পী স্বত্তাকে।
আজকের উত্তর-উত্তর আধুনিক চিত্রিরা ওঁকে সম্পূর্ণ বাতিল করেছে। আবেগ নির্ভর, গুরুত্বহীন শিল্পীর তকমা দিয়েছে। স্বাভাবিক মানুষের চিরকালীন কিছু প্রবৃত্তি থাকে, যা আমি মনে করি, প্রায় মৃত্যুহীন, সুপ্ত থাকে তা। একে অস্বীকার করা অসম্ভব। ভ্যান গগ সেই জাতের শিল্পী। শত বৎসর কেটে গেলেও, আজও তাঁর রেখা, রংকে স্পর্শ করা যায়। সে এতটাই সচল, জীবন্ত এবং প্রায় চিরকালীন। উত্তর-উত্তর আধুনিক ধারনা, থিম তাঁকে আড়ালে রাখতে অক্ষম বলে আমার মনে হয়।
বহু বিষয় নিয়ে কাজ করেছেন। দিনের পর দিন, ছোট ছোট খাতায় খসড়া এঁকেছেন। স্কেচ যাকে বলি আমরা, যা প্রথমেই বললাম, নয়ের দশকে। পুসকিন মিউজিয়ামে, এমন এক খেত দৃশ্যের সামনে আমি দাঁড়িয়ে। এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেছে। দুটো খেতের মধ্য দিয়ে একটা সড়ক চলে গেছে। একটা ঘোড়ার গাড়ি ছুটে চলেছে। ভেজা রাস্তায় তারা ছায়া, কাঁপছে। সামনের খেত ও দূরের খেতের মধ্যে টোনের তফাত, হালকা, ভারী। আমি মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম, অনেকক্ষণ ধরে। ভাবছিলাম, এত কষ্ট ও দুঃখের মধ্যেও শিল্পী তার মনোনিবেশকে গুরুত্ব দিয়েছেন। কত মাইল হেঁটে পৌছে গেছেন ওই মাঠের প্রান্তরে। এর পরেও, প্যারিসে বহু কাজ দেখেছি, ভ্যান গগের বৈশিষ্ট্য ছিল প্রকৃতির সঙ্গে মানুষ। কর্মশীল মানুষ। তারা কেউ নিশ্চল নয়। কর্মরত, কঠোর পরিশ্রমী। একটা বিখ্যাত ছবি আছে– এক চাষি খেতে বীজ ছড়াচ্ছে, কী অপূর্ব তার ভঙ্গি, বলা হয়, মিলে (MILLET)-র অনুকরণে করা। কর্মরত চাষিদের বহু ছবি উনি এঁকেছেন। একেবারে, খেতের মধ্যে দাঁড়িয়ে, প্রত্যক্ষ করা, ওঁর স্কেচই তার প্রমাণ।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
উর্বর খেত। সুফলা খেত। ধরিত্রী ফসলে ভরিয়ে দিচ্ছে। ওর মধ্য দিয়ে ওঁর এক বার্তা ছিল। একটা দর্শন ছিল। খরা নয়। ফসল। প্রান্তরের পর প্রান্তর সবুজ, হলুদ, ফসলে মন আনন্দ করা পরিবেশ, একটা পরিপূর্ণতার ছবি, জীবনের প্রতি, সব কিছু ভালোর প্রতি আগ্রহ। ব্যক্তি জীবনে বহু কষ্ট পেয়েছেন। দারিদ্রও ছিল।
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
ভ্যান গগ আসলে মানুষের শিল্পী। প্রকৃতি প্রিয় হলেও, মানুষকে পাশে সরিয়ে রেখে শুধুমাত্র প্রকৃতিকে উপভোগ করার বাসনা ওঁর ছিল না। সেই খনি শ্রমিক থেকে, কর্মরত নানা মানুষকে উনি অঙ্কনবদ্ধ করতে চেয়েছেন। তাদের দুঃখ, হতাশা, বেদনা, সবই ওঁর বিষয়ে ধরা ছিল। তাদের সঙ্গে একেবারে মিশে যেতেন।
একটা প্রচার ছিল, ভ্যান গগ কখনওই খুব দক্ষ শিল্পী ছিলেন না। প্রথাগত শিক্ষা। অ্যানাটমি জ্ঞান দুর্বল। উনি যেটা খুঁজেছিলেন, এবং সফলভাবে পেয়েছিলেন তা মনুষ্য চরিত্র, ক্যারেক্টার। মনমুগ্ধকর চিত্র রচনা নয়। অজস্র বলিরেখা, পরিশ্রমের ছাপ রাখা মুখ। বিস্ফারিত চোখ, সবই এই চরিত্রকে সৃষ্টি করেছে। রাজা-রাজরার ছবি উনি আঁকেননি, নিজের ডাক্তার, প্রিয় জনের ছবি অবশ্যই এঁকেছেন।
বিস্তীর্ণ প্রান্তর খুঁজতে মাইলের পর মাইল হাঁটতেন। আমার কল্পনায় ওই হাঁটা, ওই চলমানতা, ওঁর চলমান রেখায় প্রকাশ পেত। যখন কর্মরত মানুষ আঁকছেন, তখনও রেখা চলমান, শরীর চলমান। কোদাল দিয়ে এক চাষি খেতকে চাষযোগ্য করে তুলছে। তার সচল ভঙ্গি বিস্ময় জাগায় এবং চরিত্রকে প্রতিষ্ঠা করা, প্রকৃতির সঙ্গে তাকে মিশিয়ে দেওয়া– এই ছিল প্রাথমিক চিন্তা, আবেগ। উনি এদের প্রতি এতটাই সহানুভূতিশীল ছিলেন, ততটাই ভালোবেসেছিলেন, তাঁর তুলি, তাঁর রেখা সে কথা বলে।
ভাই মভ-এর কাছে প্রথাগত শিক্ষা নিতে গিয়ে ব্যর্থ হলেন, ওঁর শিল্পকে বাতিল করলেন। এক সাজানো, উচ্চশ্রেণির ছবি উনি আঁকতে চাননি। কোনও প্রাণ ছিল না ওই মানুষগুলির মধ্যে। মৃত, শুষ্ক, পাংশু সব মুখ, গর্বিত সব মুখ, তা ভ্যান গগের বিষয় ছিল না।
বিশাল খেতের দিগন্তে, উজ্জ্বল সূর্যের আলো। হলুদ আলোতে মাঠ ভরে যাচ্ছে, রেখারা আস্ফালন করছে নৃত্যরত। দিগন্ত, অকিঞ্চিৎকর, খেত, মাঠ চিত্রে প্রধান। উর্বর খেত। সুফলা খেত। ধরিত্রী ফসলে ভরিয়ে দিচ্ছে। ওর মধ্য দিয়ে ওঁর এক বার্তা ছিল। একটা দর্শন ছিল। খরা নয়। ফসল। প্রান্তরের পর প্রান্তর সবুজ, হলুদ, ফসলে মন আনন্দ করা পরিবেশ, একটা পরিপূর্ণতার ছবি, জীবনের প্রতি, সব কিছু ভালোর প্রতি আগ্রহ। ব্যক্তি জীবনে বহু কষ্ট পেয়েছেন। দারিদ্রও ছিল। ভাই থিও-র পাঠানো পঞ্চাশ ফ্রাঁই সম্বল। জীবন ধারনের জন্য যৎসামান্য খরচ করে, রং-তুলি-ক্যানভাসে সব কিছু ব্যয় করা। জীবনের শেষ দশবছর এভাবেই কেটে গেল। হতাশায় নয়, উর্বরতায়। মৃত্যু অবশ্য আসে সেই প্রান্তরেই। শেষ ছবি একঝাঁক কালো কাক উড়ে যাচ্ছে গমের খেতের ফসল দুলিনির ওপর। এই খেতের ওপরেই মনে, চোখে ভেসে ওঠে যে ছবি, যা আজও বিস্ময়। বিজ্ঞানীদের প্রশ্ন, বিরাট এক রহস্য, সেই ছবি, স্টারি নাইট, ঘুর্ণায়মান ব্রহ্মাণ্ড। চলমান বিশ্ব। কীভাবে দেখেছিলেন এই দৃশ্য? কোনও সুস্থ মানুষ এমন চলমানতাকে কীভাবে দেখতে পান, আজও রহস্য। নানা পরীক্ষায় আজ প্রমাণিত, বিশ্ব এমনভাবে ঘুর্ণায়মান। সেই খেতের প্রান্তে। অন্ধকার রাত্রে। তারারা কথা বলে পরস্পরের সঙ্গে। নিশ্চয়ই ভ্যান গগ শুনতে পেয়েছিলেন সেই কথা, তারাদের কথা, তাদের পরস্পরকে আলিঙ্গন করার বার্তা, এর জন্য উত্তর আধুনিকতার তকমা লাগে না। শুধু বিস্ময় আর বিস্ময়।