‘রক্তকরবী’ নাটকে প্রথম-দ্বিতীয় খসড়ায় রাজার চশমা নজরদারি করে। কেন করে? নজরদারি করে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে, কীভাবে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে এখন পুঁজি আর প্রশাসন, সে-কথা ব্যাখ্যার দরকার পড়ে না।
রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’ নাটকে রাজার একটি চশমা ছিল। এ-বাক্যটি পড়ে রবীন্দ্র রচনাবলিতে শতবর্ষ আগের নাটকটি খুলে চশমা খোঁজার চেষ্টা করে অবশ্য লাভ নেই। কারণ ‘প্রবাসী’ (আশ্বিন, ১৩৩১) পত্রিকায় যে পাঠ প্রকাশিত হয়েছিল ও পরে যা গ্রন্থরূপে (১৩৩৩) প্রকাশিত হয়, তা-ই তো আমাদের চেনা ‘রক্তকরবী’। সেখানে রাজার চোখে চশমা নেই। তবে ছিল। ‘প্রবাসী’-তে নাটকটির চূড়ান্ত রূপ প্রকাশের আগে এ-নাটকের ১০টি খসড়া করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। চশমার গুণাগুণ-সহ সুস্পষ্ট বিবরণ ছিল ‘রক্তকরবী’-র প্রথম ও দ্বিতীয় খসড়া পাঠে। সে চশমা যেমন-তেমন চশমা নয়। অনেক তার গুণ, নিশ্চয়ই মেলা তার দাম। জেমস বন্ডের প্রযুক্তিনির্ভর উপকরণগুলির যেমন অনেক দাম, তেমনই রবীন্দ্রনাথের রাজার চশমারও বুঝি অনেক দাম! রাজাকে এমন একখানা চশমা হয়তো বানিয়ে দিয়েছিল দুর্দান্ত কোনও প্রযুক্তিবিদ। সে প্রযুক্তিবিদকে এ নাটকে রবীন্দ্রনাথ সামনে আনেননি। ক্ষমতার সঙ্গে তো প্রযুক্তির সম্বন্ধ গভীর– সত্যজিতের ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবিখানি সেই সত্য প্রকাশ করেছে। প্রকাশ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথও– ‘রক্তকরবী’-র ঠিক আগে লেখা নাটক ‘মুক্তধারা’-তে ছিল যন্ত্ররাজ বিভূতির কথা। প্রাকৃতিক সম্পদকে সকলের অধিকার থেকে ছিনিয়ে নিয়ে মুষ্টিমেয় মানুষের করতলগত করেছিল তার যন্ত্র।
‘রক্তকরবী’ নাটকে কেমন সে চশমা? খোদাইকাররা বলে, ‘মকরের মত ওর চোখের উপর পর্দ্দা নেই, একটা চষমা আছে। …চোখ বাদসাধ দিয়ে দেখে, চষমা ষোলো আনা দেখ্তে পায়। চোখের পক্ষপাত আছে চষমা নির্ব্বিকার।’ ‘রক্তকরবী’ নাটকের প্রথম খসড়ায় এই যে রাজার চশমার বিবরণ পাওয়া গেল, দ্বিতীয় খসড়ায় তা আরও একটু বিশদ হল। চন্দ্রা আর ফাগুলাল– দু’জনের কথায় উঠে এল রাজার চশমার প্রসঙ্গ। ফাগুলাল খনিশহরের শ্রমিক। এই নাটকে একটি খনিশহরের কথা আছে। সেখানে শ্রমিকেরা কাজ করে। আর প্রশাসন মুনাফার জন্য তাদের খাটায়– নির্দিষ্ট সময়ের পরেও ওভারটাইম খাটতে বাধ্য করে তাদের। চন্দ্রা ফাগুলালের বউ। চন্দ্রা রাজার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলে, ‘মুখের মধ্যে একজোড়া চশমার কাঁচ ছাড়া আর ত কিছুই দেখা যায় না।’ উত্তরে ফাগুলাল বলে, ‘সেই কাঁচ দিনেও দেখে, রাত্রেও দেখে। মানুষের চোখ চলে না এমন দেশ আছে, ওর চষমা চলে না এমন দেশ পাব কোথায়?’ এই যে রাজার চশমা যেটিকে নন্দিনী বলেছিল ‘ভীষণ চষমা’, সে আর মূল নাটকে রাজার চোখে রইল না। তবে রাজার চশমা যে কাজ করত, সে কাজ করার উপকরণ খনিশহরে বজায় রইল। কী কাজ করত চশমা? ১৯২৩-এ যখন খসড়া লেখা হচ্ছে, তখন এ চশমা কী কাজ করে– তা জানা গেলেও বোঝা ছিল কঠিন। এখন অবশ্য খুবই বোঝা যায়। কারণ আমরা এখন প্রত্যেকে সিসিটিভি-র আওতায়। শুধু কি সিসিটিভি? আন্তর্জালের দুনিয়ায় আমরা এখন নজরদারির মধ্যে স্বেচ্ছাবন্দি– প্রায় প্রত্যেকেই। ১৯২৩-এ রবীন্দ্রনাথ বিষয়টি অনুধাবন করতে পারলেও তাঁর পাঠকরা এই ‘ডিসটোপিয়া’টি কতটা বুঝতে পেরেছিল, বলা কঠিন। তাঁর জীবৎকালে একবারই অভিনীত হয় এ নাটক– তবে সেই মঞ্চপ্রয়োগ তেমন দাগ কাটেনি।
‘রক্তকরবী’ নাটকে প্রথম-দ্বিতীয় খসড়ায় রাজার সেই চশমা নজরদারি করে। কেন করে? নজরদারি করে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য হাতিয়ে, কীভাবে মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে এখন পুঁজি আর প্রশাসন, সে-কথা ব্যাখ্যা করার দরকার পড়ে না। দুধের ছেলেও তা জানে। ‘রবীন্দ্রনাথ’ যখন ‘রক্তকরবী’ লিখছিলেন, তখন তো এসব সুদূর ভবিষ্যৎ। লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের দেখা হলে যা তিনি সত্যজিতের ফেলুদাকে বলেছিলেন, তা একটু ঘুরিয়ে কবিগুরুকে বলতেন। বলতেন, ‘ধন্যি আপনার দূরদৃষ্টি।’ ফেলুদা অবশ্য রবীন্দ্রনাথের তারিফ করতেন অন্য কারণে। এই যে রবীন্দ্রনাথ রাজার চোখ থেকে সবকিছু দেখতে পাওয়ার, সর্বত্র নজরদারি করার চশমাটিকে পরবর্তী পাঠে বাদ দিলেন, অথচ চশমাটি রেখে দিলেন অন্যত্র অন্যভাবে, তারই জন্য রবীন্দ্রনাথের তারিফ প্রাপ্য।
‘রক্তকরবী’ নাটকের চূড়ান্ত পাঠে রাজার চশমা গেল, তার বদলে এল সর্দারের তৈরি করা নজরদারিতন্ত্র। সর্দার কে? সে রাজাকে জুজুর পুতুল সাজিয়ে রেখে মুনাফার জন্য খনিশহরের উৎপাদনতন্ত্র পরিচালনা করে। এই যে সামনে একজনকে ‘সর্বশক্তিমান’ বলে খাড়া করে অন্তরালে একজন কলকাঠি নাড়ছে– এই তো আধুনিক ক্ষমতাতন্ত্রের দস্তুর। কে যে ক্ষমতার কেন্দ্রে বোঝা কি যায়? খনিশ্রমিকদের সংলাপে জানা যায়, রাজা নয়, নজরদারি চালাচ্ছে সর্দার, সে বানিয়ে তুলেছে নানাজনের সমবায়ে নজরদারিতন্ত্রের নিখুঁত ব্যবস্থাপনা। সেখানে লাভের জন্য একে-অপরের প্রয়োজনীয় তথ্য প্রশাসনের হাতে তুলে দেয়। অর্থাৎ, ক্ষমতাতন্ত্র যে তথ্যের ওপর দাঁড়িয়ে, তা নিজস্বার্থ ও শ্রেণিস্বার্থের জন্য মানুষই ক্ষমতাকামীদের হাতে তুলে দিচ্ছে। সকলেই আড়চোখে সকলকে দেখছে, সকলেই ক্রমাগত হয়ে উঠছে ক্ষমতার দালাল– জ্ঞাত কিম্বা অজ্ঞাতসারে। আছে নজর-রাখার জন্য আলাদা আলাদা লোক। এখানে যেন মানুষই হয়ে উঠল তথ্য সরবরাহের যন্ত্র। একজন শাসক নয়, অনেকে মিলে বজায় রাখছে ক্ষমতাতন্ত্র। এখানে ক্ষমতা আরও সুকৌশলী– মানুষই পরিণত হয়েছে নজরদার চশমায়, আর চশমাটাও হয়তো কোথাও না কোথাও আছে।
১০০ বছর আগে লেখা নাটকের সামনে থমকে দাঁড়ান পাঠক। পাঠক, আপনি এখন সিসিটিভির আওতায় আছেন।