‘আপনজন’-এর পর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘ইন্টারভিউ’, ‘পদাতিক’ পেরিয়ে বাংলা ছবিতে এসেছিল এক অনালোচিত আলোর ফুলকি, পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ‘যদুবংশ’। আবারও সেই ছবি লক্ষ্যহীন, নিরুদ্দিষ্ট যৌবনের গল্প বলছে। মাঝের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের বছরগুলিতে সিনেমায় যৌবনের রাগের ভাষা পড়া যাচ্ছিল। ‘আপনজন’-এর অনিশ্চয়তা যেন কোথাও পৌঁছচ্ছিল। কিন্তু আন্দোলনের গতি হারানো, রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের শেষে যা পড়ে রইল, তা আদতে ‘যদুবংশ’-র অবক্ষয়।
৮.
একদিকে বোমাবাজির কারফিউ, অন্যদিকে ব্ল্যাকআউট। পূর্ব-পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে ততদিনে। স্বাধীন বাংলাদেশ তখন কেবল সময়ের অপেক্ষা। তেমন একটা সময়েই, পাড়ার সকলকে বিষণ্ণ করে চলে গেল মানুষটা। পাড়ার চায়ের দোকান থেকে ক্লাবঘর জমিয়ে রাখা বছর পঁয়তাল্লিশের লোকটা রাজেশ খান্নার স্টাইলে চুল রাখা শুরু করেছে সেই ‘বাহারো কে সপনে’ বা ‘আরাধনা’-র সময় থেকেই। বারবার বলত দুটো কথা, ‘যতই তোরা সৌমিত্র-সৌমিত্র করিস, রোমান্টিক সিনে কিন্তু উত্তমকুমার সেরা!’, আর ‘রাজেশ খান্নার মতো রোমান্টিক হিরো শালা বম্বেতে আর আসেনি, আসবেও না!’
আশ্চর্য, এই বছরেরই মার্চ মাসে হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘আনন্দ’ যখন রিলিজ করল, তখনই অসুখটা ওর শরীরে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। আগের চেয়ে ঢের দুর্বল। প্রভাতফেরি থেকে মড়া পোড়ানো– সব কিছুতেই সমান সক্রিয় লোকটা আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছিল। রোয়াকবাজি বন্ধ হচ্ছিল, পুজোর জলসা-নাটক থেকে পাড়ার বিয়েবাড়ির আয়োজন, সবেতেই তরুণদের উৎসাহী করে নিজে খানিকটা বিশ্রামে থাকত লোকটা। সিনেমা দেখতে গিয়ে, প্রিয় রাজেশ খান্নাকে দেখতে গিয়েও ঘুমিয়ে পড়ত। ব্যতিক্রম হল ওই ‘আনন্দ’-এ। ‘পূর্ণ’ সিনেমায় ৭৫ পয়সায় দেখা ওই ছবি যেন নতুন জীবন দিয়েছিল ওকে। পাড়ায় সকলকে এসে বলেছিল, ‘এ তো মণিকাঞ্চন যোগ! এই জুটি তো সবাইকে টেক্কা দেবে!’ এই জুটি, অর্থাৎ কি না অমিতাভ বচ্চন-রাজেশ খান্না জুটির পরের হিট ছবি, ‘নমক হারাম’ যদিও দেখে ওঠা হয়নি আর তার, সেই ছবি রিলিজ করেছিল আরও তিন বছর পর।
সেই বছরটা যেন রাজেশ খান্নার বছর! ‘মর্যাদা’, ‘আন্দাজ’, ‘হাতি মেরে সাথী’, ‘কাটি পতঙ্গ’– হিটের পর হিট! ওইরকম যুদ্ধবিধ্বস্ত বছর, সাইরেন আর অন্ধকার পাড়া, যখনতখন সংঘর্ষ, পুলিশি ধরপাকড়, বেপাত্তা, হঠাৎ লাশ ভেসে ওঠা ইত্যাদির মধ্যে প্রতিটি পাড়ারই নিজস্ব আনন্দ ছিল। সবসময় ভাস্কর ডাক্তারের মতো বা অমিতাভ বচ্চনের মতো কোনও সঙ্গী তাদের জোটেনি। তারা সবাই অসুস্থ ছিল তাও নয়, বা রাজেশ খান্নার ভক্ত ওই লোকটির মতোই ‘অকারণে ফাঁকতালে মহাপ্রয়াণ’ ঘটেছে তাদের, তাও তো নয়। কিন্তু তারা ছিল।
‘আপনজন’-এর পর ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘ইন্টারভিউ’, ‘পদাতিক’ পেরিয়ে বাংলা ছবিতে এসেছিল এক অনালোচিত আলোর ফুলকি, পার্থপ্রতিম চৌধুরীর ‘যদুবংশ’। আবারও সেই ছবি লক্ষ্যহীন, নিরুদ্দিষ্ট যৌবনের গল্প বলছে। মাঝের রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের বছরগুলিতে সিনেমায় যৌবনের রাগের ভাষা পড়া যাচ্ছিল। ‘আপনজন’-এর অনিশ্চয়তা যেন কোথাও পৌঁছচ্ছিল। কিন্তু আন্দোলনের গতি হারানো, রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের শেষে যা পড়ে রইল, তা আদতে ‘যদুবংশ’-র অবক্ষয়। ধৃতিমান চট্টোপাধ্যায়, শর্মিলা ঠাকুর, অপর্ণা সেন, সন্তোষ দত্ত, রবি ঘোষ আর জীবনের সবচেয়ে ব্যতিক্রমী, সবচেয়ে জটিল, অন্যতর চরিত্রে উত্তমকুমার বাদে বাকিরা মোটামুটি অল্প চেনা বা অচেনা অভিনেতা। যে কারণে ‘পরিচিত মুখ’ বলে টাইটেল কার্ডের অভিনেতাদের তালিকায় আলাদা বিভাগ ছিল।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পার্থপ্রতিম ‘ছায়াসূর্য’-র ঘেঁটুকে তৈরি করেছিলেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতার কাছাকাছি সময়েই। সব উজাড় করে দেওয়া সেইসব চরিত্রদের চিনতেন তিনি, যারা জীবন থেকে প্রতিদান পায়নি কোনও। গনাদাও তেমনই এক চরিত্র। আনন্দের মতো তার মারণরোগ ছিল না। কিন্তু বারবার অপমানে ন্যুব্জ, সারাজীবন গলার স্বর না তোলা গনাদাদের পরিণাম শেষত খুব সুখের নয়। অপবাদের কালি নিয়ে, মারধরের দাগ নিয়ে আত্মহনন করলে পর সেই মারমুখী যুবকরাই আসে তাকে কাঁধে তুলতে। উত্তমকুমার ওভাবে কাঁদাতে পারেন, কে জানত?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
পুলিশের গাড়ি, তাড়া খাওয়ার উত্তেজনা দিয়ে শুরু হওয়া এই ছবি খানিক থিতিয়ে যায় প্রথম দৃশ্যেই, উদ্দেশ্যহীন বেকার যুবকদের ঠেকে এসে। এখন লভ্য অত্যন্ত খারাপ প্রিন্টেও একটু খেয়াল করলে শোনা যাবে, সেখানে বাজছে প্রথমে ‘আজ ফির জিনে কি তামান্না হ্যায়’ ও তারপর ‘তেরে মেরে সপনে আব একহি রং হ্যায়/ হো যাঁহা ভি লে যায়ে রহে হাম সঙ্গ হ্যায়’… লতা মঙ্গেশকর ও মহম্মদ রফির কণ্ঠের সঙ্গে বেপাড়ার মস্তানি নিয়ে ভুরু তোলা, কলার উঁচিয়ে দাঁতে দাঁত ঘষা বাকতাল্লার সেই আশ্চর্য সন্ধি কীভাবে সম্ভব ছিল, তা জানতেন পার্থপ্রতিম চৌধুরীর মতো কোনও জাদুকর, যাঁরা সমসময়কে উত্তেজনার উত্তাপ আর বেদনার ঝিমিয়ে পড়ায় একসঙ্গে চিনতে জানতেন। প্রায় এক দশক আগের ‘গাইড’-এ দেব আনন্দ-ওয়াহিদা জুটির ওই ঝলমলানির সুর পুড়ে যাওয়া কলকাতার নেশার ঠেকে আদতে হয়তো রূপকথার আবহসংগীত। সে যা হোক, ওই ছবিতেই আরেকটা চরিত্র এল, গনাদা।
পার্থপ্রতিম ‘ছায়াসূর্য’-র ঘেঁটুকে তৈরি করেছিলেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’-র নীতার কাছাকাছি সময়েই। সব উজাড় করে দেওয়া সেইসব চরিত্রদের চিনতেন তিনি, যারা জীবন থেকে প্রতিদান পায়নি কোনও। গনাদাও তেমনই এক চরিত্র। আনন্দের মতো তার মারণরোগ ছিল না। কিন্তু বারবার অপমানে ন্যুব্জ, সারাজীবন গলার স্বর না তোলা গনাদাদের পরিণাম শেষত খুব সুখের নয়। অপবাদের কালি নিয়ে, মারধরের দাগ নিয়ে আত্মহনন করলে পর সেই মারমুখী যুবকরাই আসে তাকে কাঁধে তুলতে। উত্তমকুমার ওভাবে কাঁদাতে পারেন, কে জানত? পাড়াতুতো ট্র্যাজেডিতে তাই মিলে গিয়েছিলেন উত্তমকুমার আর রাজেশ খান্না।
আনন্দ আর গনাদারাই সেই সময়ের পাড়া মাতিয়ে রেখেছিল, অথবা নীরবে নিয়ে নিয়েছিল ভুবনের ভার। স্বার্থত্যাগী, অথবা অন্যের জন্য জীবন নিবেদনের মহত্বটুকু অনুভবের জন্য স্বার্থপর হতে জানত তারা। যেভাবে রাজেশ খান্নার ভক্ত লোকটির শেষ দেখা ছবি হয়ে উঠেছিল ‘আনন্দ’, তা অবশ্যই স্মরণ করিয়ে দিতে পারে দিব্যেন্দু পালিতের উপন্যাসের শিরোনাম, ‘সিনেমায় যেমন হয়’। ‘জিন্দেগি, ক্যায়সি হ্যায় প্যাহেলি হায়ে/ কভি তো হাসায়ে কভি ইয়েহ রুলায়ে’ শুনে কেঁদেছে তারপরেও হয়তো কত জন, যারা ওই পাড়ার আনন্দ ওরফে রাজেশ খান্না-কে চিনত, পিকনিক থেকে শ্রাদ্ধে তার অতি উৎসাহকে ভরসাও করত, আবার কখনও বিরক্তও হত।
(চলবে)
…পড়ুন জনতা সিনেমাহল-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৭। পাড়ার রবিদা কেঁদেছিল ‘কাটি পতঙ্গ’ আর ‘দিওয়ার’ দেখে, সাক্ষী ছিল পাড়ার মেয়েরা
পর্ব ৬। যে কলকাতায় পুলিশ-পকেটমার মিলেমিশে গেছে, সেখানে দেব আনন্দ আর নতুন করে কী শিরশিরানি দেবেন?
পর্ব ৫। হিন্দি ছবির পাপ ও একটি অ্যাডাল্ট বাড়ির গল্প
পর্ব ৪। দেব আনন্দ, একটি বোমা ও অন্ধকারে হাত ধরতে চাওয়ারা
পর্ব ৩। অন্ধকারে ঢাকা পড়ল কান্না থেকে নিষিদ্ধ স্বপ্ন!
পর্ব ২। ‘জিনা ইঁয়াহা মরনা ইঁয়াহা’ উত্তর কলকাতার কবিতা হল না কেন?
পর্ব ১। সিনেমা হলে সন্ত্রাস ও জনগণমন-র দলিল
আমবাগানে গজল-সম্রাজ্ঞীকে গোর দেওয়া হয়ে যাওয়ার পর, রাত জেগে শাহিদ লেখেন ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে একটি কবিতা, যে কবিতাটা পরে উৎসর্গ করেছিলেন সেলিমকে। এর বেশ কয়েক বছর পর শাহিদের একটা কবিতার বই বের হয় ‘In Memory of Begum Akhtar’ নামে।