বছর পনেরো-ষোলো ধরে অল্প-বিস্তর ক্রিকেট সাংবাদিকতা করে একটা বিষয় মোক্ষম বুঝেছি। খেলার মাঠ আমার-আপনার কাছে বৈকালিক আমোদ-প্রমোদের বিলাসভূমি। কিন্তু প্লেয়ারদের কাছে নয়। প্লেয়ারের কাছে মাঠ-ময়দান কখনও মন্দির। কখনও মসজিদ। কখনও গির্জা। বিধি মেনে, আচার অনুসরণ করে, যেখানে নিরন্তর উপাসনা চলে। আর কে না জানে, আরাধ্যের উপাসনায় ফুল-বেলপাতা, কাঁসর-ঘণ্টা, কোসা-কুসির সঙ্গে অদৃশ্যভাবে থাকে আরও একটা জিনিস। সংস্কার।
২৩.
দারুণ সখ্য কিংবা দুর্ধর্ষ আলাপ নেই বটে। তবে সুনীল মনোহর গাভাসকরকে আমি বেশ সমঝে চলি। বছর আট-নয় আগে নাগপুর প্রেসবক্সের বাইরে সিগারেটে সুখটান দিতে গিয়ে যে ঝাড় খেয়েছিলুম, আজও বিলক্ষণ মনে আছে! আসলে কমেন্ট্রিবক্স থেকে বেরিয়ে কখন যে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছেন ‘মিস্টার ইন্ডিয়া’, খেয়াল করিনি। দেখামাত্র সিগারেট ‘ট্যাপ’ করেছিলাম ঠিকই। কিন্তু ততক্ষণে তিনি যা দেখার, দেখে ফেলেছিলেন। এবং বয়োজ্যেষ্ঠর প্রতি অনুজের সম্ভ্রম প্রদর্শনে ঈষৎ প্রীত হলেও, বকা দিতে ভোলেননি। বরং মাঠের ‘শো’ মিনিটখানেক পিছিয়ে গাভাসকর সে দিন এই শর্মাকে বুঝিয়েছিলেন, সিগারেটে টান শরীরের ঠিক কতটা ক্ষতি করে?
তাই ভয়ে হোক। ভক্তিতে হোক। শ্রদ্ধায় হোক। সমীহে হোক। সুনীল মনোহর গাভাসকরকে একটা কথা কখনও জিজ্ঞাসা করতে পারিনি। সাহস হয়নি। গাভাসকরকে জিজ্ঞাসা করতে পারিনি, টস জিতে ব্যাটিং নিলে, মাঠে ফেরত আসার মুহূর্ত পর্যন্ত সত্যিই তিনি ‘নির্বাক’ থাকতেন কি না? পাছে তা তাঁর এক অলপ্পেয়ে ছোঁড়ার ডেঁপোমি মনে হয়! পাছে আবার ঝাড় খাই!
গল্পটা গাভাসকরের পুরনো ক্রিকেট-মিত্রদের থেকে শোনা। যাঁরা বলেছেন, গাভাসকরের সংস্কারের গল্প। যা ‘কু’ না ‘সু’ বলা মুশকিল। কিন্তু তা নাকি নিয়ম মেনে পালন করতেন ‘লিটল মাস্টার’। টস জিতে ব্যাটিং নিলে, ড্রেসিংরুমে ফিরে কারও সঙ্গে কথা বলতেন না ব্যাট-প্যাড পরে মাঠে যাওয়া পর্যন্ত। টুঁ শব্দও করতেন না। শোনা যায়, তিরাশির বিশ্বজয়ী ভারতীয় দলের এক সদস্য সেই ‘পবিত্র’ মুহূর্তে গাভাসকরের সঙ্গে নাকি কথা বলতে গিয়েছিলেন। এবং যা হওয়ার, তাই হয়েছিল। অদৃষ্টে বেদম বকুনি লেখা থাকলে, তা আর খণ্ডাবে কে?
কী জানেন, বছর পনেরো-ষোলো ধরে অল্প-বিস্তর ক্রিকেট সাংবাদিকতা করে একটা বিষয় মোক্ষম বুঝেছি। খেলার মাঠ আমার-আপনার কাছে বৈকালিক আমোদ-প্রমোদের বিলাসভূমি। কিন্তু প্লেয়ারদের কাছে নয়। প্লেয়ারের কাছে মাঠ-ময়দান কখনও মন্দির। কখনও মসজিদ। কখনও গির্জা। বিধি মেনে, আচার অনুসরণ করে, যেখানে নিরন্তর উপাসনা চলে। আর কে না জানে, আরাধ্যের উপাসনায় ফুল-বেলপাতা, কাঁসর-ঘণ্টা, কোসা-কুসির সঙ্গে অদৃশ্যভাবে থাকে আরও একটা জিনিস।
সংস্কার।
প্লেয়ারের কাছে যা তার একান্ত আপন সাফল্য-তন্ত্র। যার নির্দিষ্ট বেদ-উপনিষদ নেই। সম্পূর্ণ যার-যার, তার-তার। ব্যক্তিগত বিশ্বাসই যার শ্বাস-প্রশ্বাস! কিন্তু তা আছে, সর্বত্র আছে। গঙ্গাপারে আছে। পদ্মাপারে আছে। যমুনা তীরে আছে। সবরমতী ধারে আছে। সুনীল গাভাসকরে আছে। পাড়ার পঞ্চাতেও আছে।
আমাদিগের বঙ্গ ক্রিকেটেও কি কম রহিয়াছে?
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলার এ যাবৎ একমাত্র রনজি ট্রফি জয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন টস জিতে ব্যাটিং নিলে কিছুতেই খেলার প্রথম ওভার দেখতেন না! তাঁর ঘোর বিশ্বাস ছিল, দেখলেই টিম হারবে। সম্বরণেরই রনজি জয়ী দলের বাঘা সতীর্থ অরুণ লালের আবার দৃঢ় ধারণা ছিল, টস জিতলে কিছুতেই ব্যাট করা যাবে না! ক্যাপ্টেনের কাছে গিয়ে নাকি অরুণ রীতিমতো ঝুলোঝুলি করতেন যে, ‘ম্যাডসি (সম্বরণের ডাকনাম মাধু, ম্যাডসি তারই সাহেবি সংস্করণ) উই উইল ফিল্ড ফার্স্ট!’ ঘরোয়া ক্রিকেট-আড্ডায় সম্বরণ আজও সহাস্যে বলেন, রনজি জয়ের মরশুমে তাঁকে মহা বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছিল। কারণ, টানা আট ম্যাচ টস জিতেছিলেন তিনি! যার অবধারিত ‘আবহ-সংগীত’ ছিল অরুণের ঘ্যানঘ্যান। শুধু ফাইনালে বেঁচে যান সম্বরণ। কারণ, টস তিনি জেতেননি!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
বাংলার এক দুঁদে ব্যাটারের আবার আচার ছিল, প্রতিটা বল খেলার আগে সূর্যের দিকে তাকানো। এবং রোদে চোখ যাতে ঝলসে না যায়, তাই সেই ক্রিকেটার-মহোদয় বাহুমূলের ফাঁক দিয়ে সূর্য-দর্শন করতেন! দাঁড়ান, বাকি আছে। শুনেছি, পরপর দু’বার রনজি ফাইনাল খেলা দীপ দাশগুপ্তের বাংলা টিমে এক ওপেনার ছিলেন, খেলার দিন যিনি নিয়ম করে লাল অন্তর্বাস পরে মাঠে আসতেন! সূর্য পশ্চিমে উঠতে পারে। কিন্তু তাঁর অন্তর্বাসের রং বদল হত না!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
ড্রেসিংরুমের পূর্ব নির্দিষ্ট চেয়ার, পয়া বাসের সিট, যাগ-যজ্ঞ করে খেলতে আসা, কাপালিকের মতো কপালে তিলক কাটা, এ সমস্ত ছুটকো বিষয় ছেড়েই দিলাম। প্লেয়ার-সংস্কার নিয়ে বাংলা ড্রেসিংরুমের এমন কিছু মুখরোচক গল্প আছে, যা তাক লাগিয়ে দিতে বাধ্য! নাম-ধাম কিছু ক্ষেত্রে লেখা যাবে। কিছু ক্ষেত্রে যাবে না। কারণ, তা কুরুচির পরিচয়। কারও ব্যক্তিগত বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া অনুচিত। যাক গে, লেখা যা যাবে, সে সব আগে লিখি।
বাংলার দিকপাল অফস্পিনার সৌরাশিস লাহিড়ি বল করতে নামার আগে নিজের জুতোকে প্রণাম করতেন! অন্ধ ভক্তিতে। বাংলার প্রখ্যাত পেসার রণদেব বসু সব সময় বাঁ পায়ের জুতো আগে পরতেন, যাঁর কোমর থেকে আবার একটা হলদে রুমাল ঝুলত। ঠিক তেমনই শোনা যায়, ভিন রাজ্য থেকে বাংলায় খেলতে আসা এক বিখ্যাত ক্রিকেটার-পুত্র নাকি মাঠে নামার আগে গলার মাদুলি দাঁতে চেপে ধরে ক্রমাগত লাফিয়ে যেতেন! সে ক্রিকেটারের পরম বিশ্বাস ছিল, ওতে কাজ হবে। ওতে রান আসবে। বাংলার এক দুঁদে ব্যাটারের আবার আচার ছিল, প্রতিটা বল খেলার আগে সূর্যের দিকে তাকানো। এবং রোদে চোখ যাতে ঝলসে না যায়, তাই সেই ক্রিকেটার-মহোদয় বাহুমূলের ফাঁক দিয়ে সূর্য-দর্শন করতেন! দাঁড়ান, বাকি আছে। শুনেছি, পরপর দু’বার রনজি ফাইনাল খেলা দীপ দাশগুপ্তের বাংলা টিমে এক ওপেনার ছিলেন, খেলার দিন যিনি নিয়ম করে লাল অন্তর্বাস পরে মাঠে আসতেন! সূর্য পশ্চিমে উঠতে পারে। কিন্তু তাঁর অন্তর্বাসের রং বদল হত না!
পুজো-পাঠের কাহিনিও রয়েছে অঢেল, অফুরান। ফুটবলে পড়েছি, মোহনবাগান ক্লাবের রেওয়াজ হল ডার্বির আগে কালীঘাটে পুজো দেওয়া। ক্লাবের মালী বনা প্রসাদ যা নিয়ে আসতেন প্লেয়ারদের জন্য। ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে মায়ের প্রসাদ গ্রহণ করতেন ফুটবলাররা। শিলিগুড়িতে খেলা পড়লে কোনও না কোনও কালীবাড়ি ঠিক খুঁজে বের করা হত। প্রথা মেনে আসত প্রসাদ। বাংলা ক্রিকেটেও সে উদাহরণ আছে। এক জাঁদরেল বঙ্গ অধিনায়ক দেশের যে প্রদেশেই খেলতে যেতেন, ব্যাগে ঠাকুর-দেবতার মূর্তি থাকত। এবং হোটেল রুমের টেবলে তা রেখে, তলায় কাগজ সাঁটিয়ে দিতেন। ‘ডু নট টাচ’ লিখে। ঘর গোছাও। বিছানা-বালিশ বদলাও। কোনও অসুবিধে নেই। কিন্তু ঠাকুর-দেবতায় হাত দিলে রক্ষে থাকবে না। ধুস, অতীতের এত ধুলোবালি খামোখা ঘাঁটছি কেন? বর্তমান বাংলা ড্রেসিংরুমেই নাকি খেলার দিন যজ্ঞ-টজ্ঞ হয়। এক কোচই করেন! সঙ্গে থাকেন তাঁর এক নর্মসহচর। বিপক্ষের উইকেট না পড়লে মন্ত্রোচ্চারণের ঝাঁজ নাকি ক্রমাগত বাড়তে থাকে।
বোঝো কাণ্ড!
অবশ্যি বুঝেও বা কে কবে ‘নোবেল’ পেয়েছে? বাংলা প্রবাদেই যে আছে, বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর। আর মহাশয়, বিশ্বাস এমনই বিষম বস্তু যে, এই এআই-চন্দ্রযানের যুগে, এই ২০২৪-এও তার কাছে গো-হারা হারে তর্ক, সাত গোল খান তর্কবাগীশরা। কী, বিশ্বাস হচ্ছে না তো? কেন, সপ্তাহ দু’য়েক আগের কেকেআর দেখেনি? ইডেনে ট্রেনিং করতে এসে প্লেয়ার-সাপোর্ট স্টাফরা কেমন স্টাম্পে পুজো চড়ালেন, শ্রদ্ধার ধুপ-ধুনো দিয়ে খেলতে নামলেন? কথা হল, আইপিএলের চোখ ধাঁধানো পৃথিবীতে যদি ঘটে এ জিনিস, প্রাচুর্যের হাওয়া-বাতাসে যদি মিশে থাকে এ হেন সাবেকি বিশ্বাস, আটপৌরে বাংলা ক্রিকেটের গল্প শুনে অহেতুক হেসে লাভ আছে?
…পড়ুন খেলাইডোস্কোপ-এর অন্যান্য পর্ব…
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২২: ‘ফিক্সার’-রা ছিল, আছে, থাকবে, প্রাগৈতিহাসিক যুগের আরশোলা-র মতো
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২১: বল পিছু স্কোরবোর্ডে যারা সংখ্যা বদলায়, কিন্তু তাদের জীবন বদলায় না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২০: প্রতি গুরু-পূর্ণিমায় প্রথম ফুল দেব সব্যসাচী সরকারকেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৯: ময়দানের ছবিওয়ালাদের কেউ মনে রাখেনি, রাখে না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৮: যারা আমার মাঠের পরিবার
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৭: অহং-কে আমল না দেওয়া এক ‘গোল’ন্দাজ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৬: যে দ্রোণাচার্যকে একলব্য আঙুল উপহার দেয়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৫: সাধারণের সরণিতে না হাঁটলে অসাধারণ হতে পারতেন না উৎপল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৪: মনোজ তিওয়ারি চিরকালের ‘রংবাজ’, জার্সির হাতা তুলে ঔদ্ধত্যের দাদাগিরিতে বিশ্বাসী
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১৩: অনুষ্টুপ ছন্দ বুঝতে আমাদের বড় বেশি সময় লেগে গেল
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১২: একটা লোক কেমন অনন্ত বিশ্বাস আর ভালোবাসায় পরিচর্যা করে চলেছেন বঙ্গ ক্রিকেটের
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১১: সম্বরণই বঙ্গ ক্রিকেটের বার্নার্ড শ, সম্বরণই ‘পরশুরাম’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১০: যাঁরা তৈরি করেন মাঠ, মাঠে খেলা হয় যাঁদের জন্য
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৯: খণ্ড-অখণ্ড ভারতবর্ষ মিলিয়েও ক্রিকেটকে সম্মান জানাতে ইডেনতুল্য কোনও গ্যালারি নেই
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৮: ২০২৩-এর আগে আর কোনও ক্রিকেট বিশ্বকাপ এমন ‘রাজনৈতিক’ ছিল না
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৭: রোহিত শর্মার শৈশবের বাস্তুভিটে এখনও স্বপ্ন দেখা কমায়নি
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৬: বাংলা অভিধানে ‘আবেগ’ শব্দটাকে বদলে স্বচ্ছন্দে ‘বাংলাদেশ’ করে দেওয়া যায়!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৫: ওভালের লাঞ্চরুমে জামাইআদর না থাকলে এদেশে এত অতিথি সৎকার কীসের!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৪: ইডেনের কাছে প্লেয়ার সত্য, ক্রিকেট সত্য, জগৎ মিথ্যা!
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ৩: এ বাংলায় ডার্বিই পলাশির মাঠ
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ২: গ্যালারিতে কাঁটাতার নেই, আছে বন্ধনের ‘হাতকড়া’
খেলাইডোস্কোপ পর্ব ১: চাকরি নেই, রোনাল্ডো আছে