নতুন বছরের গোড়াতেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট আর স্পিকার– দু’জনেই সরকারি খাদ্যনীতি সম্পর্কে জনসাধারণের মনোভাব বা প্রতিক্রিয়া বোঝার উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন শুরু করলেন। স্পিকার সরকারি দ্রব্যমূল্যনীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। আর জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া কী? কোনও কোনও জায়গায় বিক্ষোভকারীরা বলছে, প্রেসিডেন্টের গায়ে পচা ডিম ছুড়ব কী? সেই ডিমও যে বাজারে নেই। কারা এই বিক্ষুব্ধ সম্প্রদায়? কোন শ্রেণির লোক তারা? তার পরিসংখ্যান প্রচারিত হচ্ছে পত্র-পত্রিকায়, বেতারে, দূরদর্শনে– বেশির ভাগই পুরনো প্রজন্মের লোকজন– নিম্ন ও অর্ধশিক্ষিত এবং শ্রমিক শ্রেণিভুক্ত।
৪৮.
বর্ষশেষে
৩০ ডিসেম্বর, ১৯৯১
একরকম জোর করেই আমাকে ওর গাড়িতে তুলল তোলিয়া। বহুদিনের বন্ধু। গাড়িটা নতুন। নতুন আর্বাতের রাস্তা ধরে গাড়ি ছুটছিল হু-হু করে। তোলিয়া বলল, ‘গাড়ি তো কিনলাম। এখন দেখি হাতি পোষা যায় কদ্দিন।’ স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে তোলিয়া বলল, ‘আগে মস্কোর অটো সার্ভিস স্টেশনগুলিতে গাড়ি ধোওয়া যেত ১ রুবলে। এখন রাস্তাঘাটে বাচ্চা ছেলেরা গাড়ির কাচ মুছে দিয়ে ৩ রুবল চায়। তাতেও মন ওঠে না ওদের। বলে, ডলার পেলে ভালো হয়। তোলিয়ার কথা শেষ হতে-না হতেই লালবাতি জ্বলে উঠল ট্রাফিক সিগন্যালে। কোত্থেকে একটি বাচ্চা ছেলে স্প্রে আর তোয়ালে হাতে চলে এল গাড়ির সামনে। স্প্রে করার পর তোয়ালে দিয়ে মুছে নিমেষে ঝকঝকে করে তুলল আমাদের গাড়ির কাচটিকে। লালবাতি সবুজ হতেই জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিল ছেলেটি। তার হাতে তিনটি রুবল ফেলে দিল তোলিয়া। আমাকে তাজ্জব বনতে দেখে তোলিয়া বলল, ‘নতুন সোভিয়েতের (নামটা চলছিল তখনও) নতুন মানুষ এরা। আমরা পুরনোই রয়ে গেলাম।’ তোলিয়াকে বললাম, গাড়িটাকে দাঁড় করাও দেখি রাস্তার একপাশে। ‘নতুন মানুষদে’র আরেকটু দেখি। চার-পাঁচটা বাচ্চা ছেলের জটলার সামনেই গাড়ি দাঁড় করাল তোলিয়া। হই-হুল্লোড়ের মধ্যেই সিগন্যালের দিকে তাকাচ্ছে ছেলেগুলো। লালবাতি জ্বললেই গাড়ির কাচ মুছে রুবল আদায় করবে। কাছে পেয়ে প্রশ্ন করলাম একটি ছেলেকে, যেরকম জোরে গাড়ি চলে এই রাস্তায়, তাতে যে কোনও সময় তোমরা গাড়ি চাপা পড়তে পারো। এরকম ঝুঁকি নিচ্ছ কেন? কথাটা শুনেই ছেলেগুলো হো হো করে হেসে উঠল। একজন বলল, ‘ঝুঁকি না নিলে রুবল মিলবে কোত্থেকে?’ গোটাকয়েক প্রশ্ন করলাম ওদের। জবাবও পেলাম চটপটে। ‘স্কুলে যাও না?’ জবাব এল, ‘যাই। কয়েকটা ক্লাসের পরই এখানে চলে আসি। আর আসি ছুটির দিন, শনি ও রবিবার।’ বাড়িতে পড়ো কখন? সিগনাল দেখতে দেখতে একটি ছেলে বলে উঠল, ‘অত পড়াশোনা করে কী হবে? আমার মা-বাবা দু’জনেরই অনেক ডিগ্রি আছে। দু’জনেই রোজগার করে। তবে গাড়ির কাচ মুছে এখন দু’জনের চেয়েই আমি বেশি রোজগার করি। এর মধ্যে আরেকজন ব্যঙ্গ করে বলল, ‘আরও রোজগার করতে পারতাম। কিন্তু ট্যাক্স দিতে হয় যে আমাদের।’ ‘ট্যাক্স’ মানে? তাকালাম তোলিয়ার দিকে। বন্ধু বলল, পুলিশকে রোজ মাথাপিছু ২০ রুবল দিতে হয়। আমি অবাক। তাহলে মস্কোতেও পুলিশ এখন ঘুষ নেয়! এর মধ্যে আবার লালবাতি। দাঁড়ানো গাড়ির ভিড়ে হারিয়ে গেল ছেলেগুলো।
সেদিন একটি ঘোষণা শুনছিলাম রেডিয়োতে। তার মূল বক্তব্য ছিল, পশ্চিমি দুনিয়ার মতো এদেশের ছেলেমেয়েদের ছোটবেলা থেকে স্বাবলম্বী হওয়া উচিত। পড়াশুনার জন্য যে-পয়সা খরচ হয়, মার্কিন মুলুকে ছেলে-মেয়েরা তা রোজগার করতে না পারলে মা-বাবার কাছ থেকে ধার নেয়, পরে নিজেরা রোজগার করে তা শোধ করে। পাশে বসেছিল আমার এক প্রতিবেশীর নাতি। বলে উঠল, ‘এক্কেবারে ঠিক কথা। ওইভাবে চলতে হবে আমাদেরও।’
এদেশে যখন প্রথম আসি, তখন এখানকার অনেকেই ঠাট্টা করে বলতেন, এদেশে সুবিধাভোগী শ্রেণি হল শিশুরা। সস্তায় জামাকাপড়, জুতো, বইখাতা, খেলনা, খাবার-দাবার, হলিডে হোম, ছুটি কাটানোর সুযোগ– সব আছে কেবল শিশুদের জন্য। গর্বাচ্যোভের আমল থেকেই আর শুনিনি ঠাট্টাটা। এখানে একসময় শিশুদের জন্য দু’রকমের অনুষ্ঠান হত রেডিয়োতে। সেসবের পাট চুকেছে। এখন শোনানো হয় মার্কিন মুলুক থেকে আমদানি করা অনুষ্ঠান। দেখানো হত শিশুদের জন্য রোজ রাত ছ’টায় ‘শুভরাত্রি’ নামে একটি অনুষ্ঠান দেখানো হত টিভিতে। অনুষ্ঠানটিতে থাকত রূপকথা, কার্টুন ছবি আর ঘুমপাড়ানি গান। ডিসেম্বরের ২ তারিখে জানিয়ে দেওয়া হল, অর্থাভাবের দরুন এই অনুষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আগে প্রতি বছর গরমের ছুটিতে এদেশের স্কুল-পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা নামমাত্র খরচে নানা সরকারি প্রতিষ্ঠানের অনুদানে বিভিন্ন হলিডে হোম, পিকনিক স্পট বা ক্যাম্পে যাওয়ার সুযোগ পেত। ‘পেরেস্ত্রৈকা’র সময় থেকেই খোলা হাওয়ায় সেইসব সুযোগসুবিধা উড়ে গেছে খড়কুটোর মতো। এখন গরমের ছুটিতে রোজগারের ধান্দায় বেরিয়ে পড়ে স্কুল পড়ুয়া বাচ্চারা। মাথায় লম্বা হয়ে গেলেই শুরু করে দেয় কাগজের হকারি। রাস্তায় চ্যারিটি শো-র আয়োজন করেন কিছু কোটিপতি মানুষ। এসব যত দেখি, আমার ততই মনে পড়ে যায় সিনেমায় দেখা বিপ্লব-পূর্ব পেত্রোগ্রাদের ছবি। হায়, এ কোন সভ্যতার আলো!
P1060210
পুরনো বছরের শেষদিন, ৩১ ডিসেম্বর সন্ধ্যা। মস্কোয় পাতাল রেলের সাবওয়েগুলিতে দস্তুরমতো বিকিকিনির হাট বসে গেছে। ‘বেঙ্গল ফায়ার, বেঙ্গল ফায়ার’ ‘দশ রুবলে দশটা, দশ রুবলে দশটা’– সাদা বাংলায় তারাবাজি– তারস্বরে চেঁচিয়ে বিক্রি করছে একটি ছোকরা। মস্কোর বাজারে এটা নতুন। এই বছরেই প্রথম প্রকাশ্যে বিক্রি হতে দেখছি। দিন দশেক আগে এখান থেকে কিনেওছিলাম ওই বয়সের একটি ছেলের কাছ থেকে। দশটার মধ্যে চারটে জ্বলেছিল। লক্ষ করে দেখলাম– না এ সেই ছেলে নয়। তবু আর কিনে পরীক্ষা করার প্রবৃত্তি হল না। তবে ভাগ্যি ভালো দু’খানা বড় সাইজের মোমবাতি কিনেছিলাম। কিনেছিলাম অবশ্য শখ করে– নববর্ষের দিন টেবিলের শোভাবর্ধনের জন্য। কিন্তু লেগে গেল অন্য কাজে।
সেন্টার ছাড়া এ-বছরে আর কোথাও রোশনাই দেখলাম না। লোকজনের উৎসাহ-উদ্দীপনার অভাব। আমার পাড়ায় এসে দেখি আরেক বিপত্তি। গোটা বাড়িতে বিকেল পাঁচটা থেকে ইলেকট্রিসিটি নেই। ষোলোতলা বাড়ি, চারটে সদর– হাজার খানেক লোকের বাস। রাস্তা তো এমনিতেই ঘুটঘুটে অন্ধকার হয়ে থাকে– গোটা দশেক ল্যাম্পপোস্টের মধ্যে দুটোমাত্র জ্বলে টিমটিম করে। না, আমরা যাকে লোডশেডিং বলি, এ তা নয়। মেইন-এ কোথাও কোনও গোলমাল হয়েছে। শীতকালের বিকেল। অনেক আগেই ঘনিয়ে এসেছে রাতের অন্ধকার। শুধু তাই নয়, রান্নার উনুন বলতে হটপ্লেট– অর্থাৎ ইলেকট্রিসিটি ছাড়া এককাপ চা খাবারও উপায় নেই। মস্কোয় দীর্ঘ আঠারো বছরের জীবনযাত্রার মধ্যে একটানা ছয় ঘণ্টা অন্ধকারে থাকার অভিজ্ঞতা এই প্রথম। লাইন ঠিক হল রাত এগারোটার সময়। শাপে বর হল বোধ হয়। বাড়ির বাসিন্দারা বেঁচে গেল আরেকটি ঝামেলার হাত থেকে– নববর্ষের টেবিলটা সাজাবে কী দিয়ে?– যখন বাজারে এক কিলো মাংসের দাম ৩০০ রুবল, পাঁচ কিলো ওজনের রুই মাছের দাম ১৪০০ রুবল। আগে লাইন নিয়মিত পরীক্ষা করা হত, এখন আর তার বালাই নেই– ফলে এই অবস্থা। সর্বত্র গাফিলতি।
পয়লা জানুয়ারি, ১৯৯২, নবযুগের বর্ষবরণ
আমরা সকলে বাড়িতে যখন যে-যার সমস্যা নিয়ে হিমশিম খাচ্ছি, তখন মস্কোর কেন্দ্রের খোঁজটা একবার নেওয়া যেতে পারে। দেশের ইতিহাসে এই প্রথম নতুন বছর ও নবযুগকে বরণ করা হল রেড স্কোয়ারে উৎসবের বাজি পুড়িয়ে। শুধু এদেশের অনেক লোক কেন, আক্ষরিক অর্থে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ মাঝরাতে সমবেত হয়েছিল ক্রেমলিনের দেওয়ালের কাছে। বাস্তবিকই এত সুরের রং-বেরঙের আতশবাজি সমারোহ আগে আর কখনও দেখা যায়নি– বিশেষত আশীর্বাদধন্য ভাসিলি ভজনালয় ও ক্রেমলিনের প্রেক্ষাপটে তা ছিল অতুলনীয়।
বাজি ফাটানোর আওয়াজের সঙ্গে মিশে যায় অসংখ্য শ্যাম্পেনের ছিপি খোলার ফটাফট আর পানপাত্র ঠোকাঠুকির টুংটাং। শ্যাম্পেনের একেকটি বোতলের দাম এখন দেড়শো রুবল– আগের বছরও যা বিক্রি হত ৬.৫০ রুবলে। ক্রেমলিন এই প্রথম রাশিয়ার নতুন পতাকা তলে বর্ষবরণ করল। তবে হ্যাঁ, কাস্তে-হাতুড়ি চিহ্নিত অতিপরিচিত লাল পতাকাও মাঝরাতে রেড স্কোয়ারে দেখা গিয়েছিল। কিছু কমিউনিস্ট বিক্ষোভকারী লাল পতাকা হাতে সরকারবিরোধী ধ্বনি তুলেছিল। সংঘর্ষ অবশ্য ঘটেনি।
কিছু কিছু জিনিস আগের মতো রয়ে যায়। আগের আগের বছরের মতোই ঠিক মাঝরাতে লেনিন স্মৃতিসৌধের প্রহরীবদল হল। কিন্তু ক্রেমলিনের ঘড়িতে বারোটা বাজার ঘণ্টা শোনা গেল না– বাজির আওয়াজে তা চাপা পড়ে গিয়েছিল। নববর্ষের এই ফায়ারওয়ার্ক ছিল বিদেশের উপহার– এর আয়োজন করেছিলেন এক জার্মান কোম্পানি। ঘটনাটি প্রতীকধর্মী– যেমন পশ্চিমের সঙ্গে রাশিয়ার আন্তরিক ও বন্ধুত্বপূর্ণ নতুন সম্পর্কের বিচারে, তেমনি তার দৌর্বল্যের অর্থাৎ অপরের সাহায্যের ওপর তার নির্ভরশীলতার বিচারেও বটে। অন্যান্য বছর নববর্ষের ঠিক প্রাক্কালে দেশের রাষ্ট্রপ্রধান বেতার ও দূরদর্শনের মাধ্যমে দেশবাসীকে শুভেচ্ছা জানাতেন। রাষ্ট্রপ্রধানের ভাষণের আগে বাড়িতে পরিবারের সকলে ভোজের টেবিলের ধারে বসে বর্ষবিদায় উৎসব পালন করত আর ভাষণের ঠিক শেষে ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গে বর্ষবরণ করা হত। এবারে তার ব্যতিক্রম ঘটল। গত বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে ভাষণ দিয়েছিলেন গর্বাচ্যোভ। কিন্তু এবছর রাশিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান ইয়েলেৎসিন কোনও শুভেচ্ছাবাণী দিলেন না জনগণের উদ্দেশে। সেদিন মাঝরাতের পর দূরদর্শনের প্রোগ্রামে বৈচিত্র সঞ্চারের প্রয়াস দেখা গিয়েছিল– পপ, রক, স্ট্রিপটিজ দিয়ে। তবে সেসব উপভোগের মানসিকতা অনেকেরই বোধহয় ছিল না। মনে শঙ্কা, প্রশ্ন; আগামী বছরের ২ তারিখ থেকে দ্রব্যমূল্যের ওপর থেকে সরকারি নিয়ন্ত্রণ একেবারে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। অতঃপর কী?
এদেশের অর্থনীতিতে এতদিন যে ধরনের ব্যবস্থা চলে আসছিল তাতে দোকানবাজারে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়া যেত না, তাই ‘নেই নেই’ হাহাকার লেগেই থাকত। তবে– একসময়ে জিনিস পাওয়া যাবে, এই ভরসাও থাকত। প্রয়োজনীয় কোনও জিনিস দোকানে এলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর অভ্যাস এদেশের লোকের হয়ে গিয়েছিল। লোকে রপ্ত করে নিয়েছিল খাদ্যদ্রব্য থেকে শুরু করে জামাকাপড় ও অন্যান্য পণ্যদ্রব্যের সঞ্চয়ের অভ্যাস। এ ছিল সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের অবদান– যেখানে চাহিদা ও সরবরাহের নিয়ম কাজ করত না, যেখানে চলত রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া আধিপত্য। আটের দশকেই দেশে কমিউনিজম এসে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। এতদিন অপেক্ষা করার পরও কমিউনিজমের সে-ট্রেন আর এল না; লোকে পড়ে রইল রেলস্টেশনে। কমিউনিজমের বদলে এসে পড়ল বাজার-অর্থনীতির শক-থেরাপি। গত বছর এপ্রিল মাসে একচোট শক-থেরাপির ধাক্কা সামলাতে না-সামলাতে এসে পড়ল আরেক ধাক্কা– এ বছর জানুয়ারির ২ তারিখ থেকে সরকারিভাবে ঘটল দ্রব্যমূল্যের বন্ধনমুক্তি। সঙ্গে সঙ্গে লোকেও মুক্তি পেল কিছু কিছু বদ অভ্যাস থেকে। ডিসেম্বর পর্যন্ত সরকারি দামে কুপনে ভোদ্কা আর সিগারেট দেওয়া হত– অবশ্য নামে– বহুকাল হল ওই দুই বস্তু দুর্লভ। সরকারি দোকানে মেলে না। কালোবাজারে এক বোতল ভোদ্কার দাম ১০০ রুবল, এক প্যাকেট দেশি সিগারেট ৯০ রুবল। আগে লোকে প্রয়োজনে রাস্তাঘাটে অচেনা-অজানা লোকের কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিত। এখন আর চায় না। সকলে অনুসরণ করে সেই পুরনো রুশি-প্রবচন– ‘বন্ধুত্ব হোক পাকাপাকি– তামাকের বেলায় ভাগাভাগি।’
তা না হয় হল। কিন্তু সেই সঙ্গে কি খাবার অভ্যাসও ছেড়ে দিতে হবে? তামাকের সঙ্গে সঙ্গে দুধও ছাড়তে হবে দেখছি। চায়ের আনুষঙ্গিক চিনি ছাড়তে হয়েছে অনেক দিন হল– এবারে দুধও বাদ। দ্বিতীয় শক-থেরাপি: দুধ বাজার থেকে উধাও হয়ে গেল– বলতে গেলে রাতারাতি। আর চা? ঘরের পুঁজি ভাঙিয়ে খেতে হচ্ছে। দোকানে যে কতকাল দেখিনি মনে করতে পারছি না। বিদেশি মুদ্রার ঘাটতির ফলে চা-কফির আমদানিতে ভাটা পড়েছে। এখন যারা চা-কফি খাচ্ছে তারা নাকি ধারে খাচ্ছে– আমদানি বাবদ ঋণ এখনও শোধ করা হয়নি।
দুধ কেনার ঝকমারি থেকে বাঁচা গেল। গত বছরের ১৪ নভেম্বরের এক খবরে প্রকাশ, মস্কোর নোভোকোসিনস্কি সুপার মার্কেটে দুধ কিনতে গিয়ে লোকের পায়ের তলায় পিষ্ট হয়ে ছেচল্লিশ বছর বয়স্ক এক ব্যক্তির মৃত্যু হয়। তখন অবশ্য এক লিটার দুধ পাওয়া যেত ৬৫ কোপেকে। এখন কোথাও কোথাও নাকি বিক্রি হয় ৪ থেকে ১২ রুবলে। উৎপাদন কি রাতারাতি নেমে গেল? শোনা যাচ্ছে কোথাও কোথাও নাকি ব্যবসায়ীরা খাদ্যদ্রব্য নষ্ট করে ফেলছে। অমনি পত্র-পত্রিকায় রব উঠে গেল সমস্ত অনাসৃষ্টির মূলে আছে কমিউনিস্টরা, তারা বাজার-অর্থনীতির পথে বাধ সাধছে। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কিছু বলার বিপদ আছে– সম্প্রতি তারা হুমকি দিয়েছে, যে কাগজে তাদের বিরুদ্ধে লেখা হবে সেখানে তারা বিজ্ঞাপন দেবে না। বিজ্ঞাপন না পেলে কোনও কাগজের পক্ষে এখন টিকে থাকা ভার, তাই জানুয়ারির শুরুতে একাধিক পত্রিকায় সংবাদ বেরল, জিনিসপত্রের দাম অন্তত দশ গুণ বেড়ে গেলেও, কোনও কোনও ক্ষেত্রে কমেছে। যেমন– Ketchup Sauce। আগের দিন দাম ছিল ২০ রুবল, এখন নেমেছে ১৫ রুবলে। চাহিদা সরবরাহের নিয়ম যে একেবারে কাজ করছে না কে বলল? কিন্তু এক পাউন্ডের রুটির দাম যে বেড়ে হয়েছে প্রায় ২ রুবল, এক কিলো আলুর দাম ৫ রুবল, পেঁয়াজ ৮ রুবল আর দশটা ডিম ২০ রুবল– তার বেলায়? তাও আবার সর্বত্র মেলে না।
নতুন বছরের গোড়াতেই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট আর স্পিকার– দু’জনেই সরকারি খাদ্যনীতি সম্পর্কে জনসাধারণের মনোভাব বা প্রতিক্রিয়া বোঝার উদ্দেশ্যে দেশের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন শুরু করলেন। স্পিকার সরকারি দ্রব্যমূল্যনীতির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অসন্তোষ প্রকাশ করলেন। প্রেসিডেন্ট নিশিদিন ভরসা রাখার মন্ত্রবাণী দিলেন– শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃতের ভাষায় বলতে গেলে– শ ষ স।
কিন্তু জনসাধারণের প্রতিক্রিয়া কী? কোনও কোনও জায়গায় বিক্ষোভকারীরা বলছে, প্রেসিডেন্টের গায়ে পচা ডিম ছুড়ব কী? সেই ডিমও যে বাজারে নেই। কারা এই বিক্ষুব্ধ সম্প্রদায়? কোন শ্রেণির লোক তারা? তার পরিসংখ্যান প্রচারিত হচ্ছে পত্র-পত্রিকায়, বেতারে, দূরদর্শনে– বেশির ভাগই পুরনো প্রজন্মের লোকজন– নিম্ন ও অর্ধশিক্ষিত এবং শ্রমিক শ্রেণিভুক্ত। সমাজে এদের বিশেষ কোনও প্রভাব নেই, এদেরও উসকানি দিচ্ছে কমিউনিস্টরা।
আরও একটি জিনিস– আমাদের বেশ পরিচিত – প্রেসিডেন্ট যখন যেখানে যাচ্ছেন তখনই পাল্টে যাচ্ছে সেখানকার বাজারের চেহারা। ব্যবসায়ীরা কম দামে কিছু কিছু জিনিস বার করে দিচ্ছে, কিন্তু প্রেসিডেন্টের প্রস্থানের সঙ্গে সঙ্গে আবার যেমনকার তেমন।
বাইরে থেকে এসে কোনও বিদেশির পক্ষে চট করে এখানকার বাজারদরটা বোঝা মুশকিল– বিশেষত পকেটে যদি থাকে মার্কিন ডলার। এক ডলার ভাঙিয়ে পাবেন অন্তত ১৪০ রুবল– তাতে বাজারে কিলো দেড়েক ভালো মাংস কিনতে পারেন। ওই মুদ্রার মাধ্যমেই নির্ধারিত হচ্ছে এদেশের বাজারদর। বহু সোভিয়েত নাগরিকের কাছে আজকাল নানাসূত্রে এসে পড়ছে বিদেশি মুদ্রা। অনেকে বিদেশে মাস কয়েক কাজ করে নিয়ে আসছে প্রচুর ডলায় পাউন্ড। কেউ কেউ এদেশে এসেই নানা বিদেশি ফার্মে কাজ করে অল্পবিস্তর বিদেশি মুদ্রা অর্জন করছে। দোকানগুলিতে বিদেশি মুদ্রার বিশেষ ভিড় দেখা যাচ্ছে। ফলে রুবল কোণঠাসা হয়ে পড়ছে। খুব কম লোকই এদেশে মাসিক হাজার রুবল মাইনে পায়। কিন্তু সেই হাজার রুবলের ক্রয়ক্ষমতা কী? অথচ মাসে ২০ ডলারে একজন লোকের দিব্যি হেসে-খেলে বড়লোকি চালে চলে যায়। তাই তো উন্নয়নশীল দেশের অনেক মানুষ এখানকার বিভিন্ন বিদেশি ফার্মে সামান্য কিছু ডলার মাইনেতে নিযুক্ত হওয়ার পর আর দেশে ফিরে যেতে চায় না। এর চেয়ে সস্তায় জীবনযাত্রা আর কোথায় সম্ভব? আমাদের দেশে ২০ ডলারের দাম কত? মনে রাখতে হবে এখানকার Auction-এ এখন ১ রুবলের দাম মাত্র দেড় টাকা। কিন্তু ২০ ডলার মাসে খরচ করতে পারলে আপনি দুধও খেতে পারেন, তামাকও খেতে পারেন।
…পড়ুন রুশকথা-র অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৪৭। মুক্ত দিনে ব্যালের দেশ রাশিয়ায় ‘আধুনিক ব্যালে’ শেখাতে আসছে ক্যালিফোর্নিয়ার ট্রুপ
পর্ব ৪৬। অক্টোবর বিপ্লবের উচ্ছ্বাস কোনও দেশে কমলে, অন্য দেশে বাড়তে থাকে
পর্ব ৪৫। ‘অক্টোবর বিপ্লব দিবস’ আর পালিত হবে না, পালিত হবে বড়দিন– চোখের সামনে বদলে যাচ্ছিল সোভিয়েত
পর্ব ৪৪। রাজনীতিতে অদূরদর্শিতার ফল যে কত সুদূরপ্রসারী, তার প্রমাণ আফগানিস্তান
পর্ব ৪৩। জানলা দিয়ে পূর্ব জার্মানি দেখতে দেখতে গর্বাচ্যোভ বলেছিলেন, তাহলে এখানেই শেষ!
পর্ব ৪২। পেরেস্ত্রৈকা শুরু হলে বুঝেছিলাম ‘প্রগতি’ ‘রাদুগা’– এসব কিছুই থাকবে না
পর্ব ৪১। কল্পনা যোশীর তুলনায় ইলা মিত্রকে অনেক বেশি মাটির কাছাকাছি বলে মনে হয়েছে
পর্ব ৪০। বেসরকারিকরণের শুরু দিকে রাস্তাঘাটে ছিনতাই বেড়ে গেছিল, কারণ সব লেনদেন নগদে হত
পর্ব ৩৯। হাওয়া বদলের আঁচ অনেকেই আগে টের পেয়েছিল, বদলে ফেলেছিল জীবনযাত্রা
পর্ব ৩৮। শুধু বিদেশে থাকার জন্য উচ্চশিক্ষা লাভ করেও ছোটখাটো কাজ করে কাটিয়ে দিয়েছেন বহু ভারতীয়
পর্ব ৩৭। একটা বিদেশি সাবানের বিনিময়েও নাকি মস্কোয় নারীসঙ্গ উপভোগ করা যায়– এমনটা প্রচার করেছে ভারতীয়রা
পর্ব ৩৬। মস্কোর ঠান্ডায় লঙ্কা গাছ দেখে পি.সি. সরকার বলেছিলেন, ‘এর চেয়ে বড় ম্যাজিক হয় নাকি?’
পর্ব ৩৫। রুশদের কাছে ভারত ছিল রবীন্দ্রনাথের দেশ, হিমালয়ের দেশ
পর্ব ৩৪। সোভিয়েত শিক্ষায় নতুন মানুষ গড়ে তোলার ব্যাপারে একটা খামতি থেকে গিয়েছিল
পর্ব ৩৩। দিব্যি ছিলাম হাসপাতালে
পর্ব ৩২। মস্কোর স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে সাধারণ ডাক্তাররা অধিকাংশই মহিলা ছিলেন
পর্ব ৩১। আমার স্ত্রী ও দুই কন্যা নিজভূমে পরবাসী হয়ে গিয়েছিল শুধু আমার জন্য
পর্ব ৩০। শান্তিদা কান্ত রায়ের প্রিয় কাজ ছিল মস্কোয় ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের কমিউনিজম পড়ানো
পর্ব ২৯। পেরেস্ত্রৈকার শুরু থেকেই নিরাপত্তার অভাব বোধ করছিলেন গোপেনদা
পর্ব ২৮। দেশে ফেরার সময় সুরার ছবি সঙ্গে নিয়ে যাওয়ার অনুমতি পাননি গোপেনদা
পর্ব ২৭। বিপ্লবের ভাঙা হাট ও একজন ভগ্নহৃদয় বিপ্লবী
পর্ব ২৬। ননী ভৌমিকের মস্কোর জীবনযাত্রা যেন দস্তইয়েভস্কির কোনও উপন্যাস
পর্ব ২৫। ননীদা বলেছিলেন, ডাল চচ্চড়ি না খেলে ‘ধুলোমাটি’র মতো উপন্যাস লেখা যায় না
পর্ব ২৪। মস্কোয় শেষের বছর দশেক ননীদা ছিলেন একেবারে নিঃসঙ্গ
পর্ব ২৩। শেষমেশ মস্কো রওনা দিলাম একটি মাত্র সুটকেস সম্বল করে
পর্ব ২২। ‘প্রগতি’-তে বইপুথি নির্বাচনের ব্যাপারে আমার সঙ্গে প্রায়ই খিটিমিটি বেধে যেত
পর্ব ২১। সোভিয়েতে অনুবাদকরা যে পরিমাণ অর্থ উপার্জন করত, সে দেশের কম মানুষই তা পারত
পর্ব ২০। প্রগতি-র বাংলা বিভাগে নিয়োগের ক্ষেত্রে ননীদাই শেষ কথা ছিলেন
পর্ব ১৯। নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় নাকি খুব ভালো রুশভাষা জানতেন, প্রমথনাথ বিশী সাক্ষী
পর্ব ১৮। লেডি রাণু মুখার্জিকে বাড়ি গিয়ে রুশ ভাষা শেখানোর দায়িত্ব পড়েছিল আমার ওপর
পর্ব ১৭। একদিন হঠাৎ সুভাষদা আমাদের বাড়ি এসে উপস্থিত ফয়েজ আহমেদ ফয়েজকে নিয়ে
পর্ব ১৬। মুখের সেই পরিচিত হাসিটা না থাকলে কীসের সুভাষ মুখোপাধ্যায়!
পর্ব ১৫। রুশ ভাষা থেকেই সকলে অনুবাদ করতেন, এটা মিথ
পর্ব ১৪। মস্কোয় ননীদাকে দেখে মনে হয়েছিল কোনও বিদেশি, ভারতীয় নয়
পর্ব ১৩। যিনি কিংবদন্তি লেখক হতে পারতেন, তিনি হয়ে গেলেন কিংবদন্তি অনুবাদক
পর্ব ১২। ‘প্রগতি’ ও ‘রাদুগা’র অধঃপতনের বীজ কি গঠনপ্রকৃতির মধ্যেই নিহিত ছিল?
পর্ব ১১। সমর সেনকে দিয়ে কি রুশ কাব্যসংকলন অনুবাদ করানো যেত না?
পর্ব ১০। সমর সেনের মহুয়ার দেশ থেকে সোভিয়েত দেশে যাত্রা
পর্ব ৯। মস্কোয় অনুবাদচর্চার যখন রমরমা, ঠিক তখনই ঘটে গেল আকস্মিক অঘটন
পর্ব ৮: একজন কথা রেখেছিলেন, কিন্তু অনেকেই রাখেননি
পর্ব ৭: লেনিনকে তাঁর নিজের দেশের অনেকে ‘জার্মান চর’ বলেও অভিহিত করত
পর্ব ৬: যে-পতাকা বিজয়গর্বে রাইখস্টাগের মাথায় উড়েছিল, তা আজ ক্রেমলিনের মাথা থেকে নামানো হবে
পর্ব ৫: কোনটা বিপ্লব, কোনটা অভ্যুত্থান– দেশের মানুষ আজও তা স্থির করতে পারছে না
পর্ব ৪: আমার সাদা-কালোর স্বপ্নের মধ্যে ছিল সোভিয়েত দেশ
পর্ব ৩: ক্রেমলিনে যে বছর লেনিনের মূর্তি স্থাপিত হয়, সে বছরই ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার সূচনাকাল
পর্ব ২: যে দেশে সূর্য অস্ত যায় না– আজও যায় না
পর্ব ১: এক প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে রাশিয়ার খণ্ডচিত্র ও অতীতে উঁকিঝুঁকি