‘ধানসিড়ি’ থেকে প্রকাশিত বইটির ২৭টি রম্যরচনা সংবলিত অপূর্ব সৎপতি-র ‘হাসকুটে’-তে বহুবিধ হাসির ছোঁয়া রয়েছে। রচনাগুলির বিচিত্র শিরোনাম পাঠকের চোখ টানে। ভাল রম্যে নিছক মজার ভেতরেও উঁকি মারে দেশ-কাল-সমাজ। তবে সরাসরি টের পেলে ফাউল।
‘মৌচাক’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় শিবরাম চক্রবর্তীর প্রথম হাসির গল্প ‘পঞ্চাননের অশ্বমেধ’। যার জন্য ১৫ টাকা আগাম পেয়েছিলেন বঙ্গসাহিত্যের হাস্যরসের সম্রাট। তার আগে বিস্তর ‘বড় বড় কবিতা, মেজ মেজ গল্প, আর মাজাঘষা প্রবন্ধ’ লিখলেও হালে পানি পাননি। শেষ পর্যন্ত ‘হাসিতেই ফাঁসি’, মানে বাঙালি পাঠক ফাঁসল বা মজল শিবরামীয় মজার রসে। তাঁকে কিংবদন্তি হিসেবে মেনে নিলাম আমরা। কিন্তু আজব চাপ! এর পরেও জাতে ওঠেনি ‘হাস্যরস’! পণ্ডিতদের কাছে সে ‘গরিব’ সাহিত্য হয়েই থেকে গিয়েছে! তাতে অবশ্য পাঠকের কিছু এসে যায় না। তাই তো সুকুমার, শিবরাম, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা, সঞ্জীব চাটুজ্যের একাধিক রচনা ও চরিত্র বছরের পর বছর ধরে কলেজ স্ট্রিটের বেস্টসেলার। আমাদের আলোচ্য গ্রন্থ ‘হাসকুটে’-র লেখক অপূর্ব সৎপতি-ও যেমন। নেটদুনিয়ায় তুমুল জনপ্রিয়। ফেসবুকে তাঁর সরস রম্যগদ্য পোস্ট হলেই কমেন্টের বন্যা। নিজে পড়ে একচোট হেসে, অন্যকে পড়াতে শেয়ার করেন পাঠক।
হাস্যরস বহুমুখী ও বিচিত্র। যা কৌতুক (Fun), তা উপহাস (Jest ও Joke) নয়, যা পরিহাস (Wit) তা ব্যঙ্গ (Satire) নয় কখনওই। আবার বিদ্রুপ (Irony ও Sarcasm) আরেক জিনিস। ‘ধানসিড়ি’ থেকে প্রকাশিত বইটির ২৭টি রম্যরচনায় এই বহুবিধ হাসির ছোঁয়া রয়েছে। রচনাগুলির বিচিত্র শিরোনাম পাঠকের চোখ টানে। যেমন ‘হাঁট্যরস’, ‘ভুলগেটিং’, ‘পটলবাবু ফিল্মস্টার (দ্বিতীয়)’, ‘মাধ্যমিকমন’, ‘গোরুর রচনা’, ‘অ্যান্টেনার উপরে কাক’ ইত্যাদি। আসলে শিরোনামেই ধরা আছে গদ্যচরিত্রের অম্লমধুর কটাক্ষ। সহজ করে বললে, ব্যক্তি আমি ও তার চারপাশের হাজারও ভ্রান্তি তৈরি করে যে কৌতুকময় হাজারও মুহূর্ত, তাকেই ‘স্ট্রিট স্মার্ট’ ভাষায় মেদহীন গদ্যে পরিবেশন করেছেন লেখক।
সংকলনের প্রথম রচনা ‘হাঁট্যরস’-এ নিজেকে নিয়েই মজায় মাতেন লেখক। পেশায় মাস্টারমশাই। সবে স্কুল থেকে ফিরেছেন। ওমনি বউয়ের হাঁক– ‘চলো হাঁটতে যাই।’ যার পর অপূর্ব বয়ান– ‘এ কী নির্যাতন রে বাপ! হঠাৎ এখন হাঁটতে যাওয়ার মতলব কেন? এটা তো আমার শবাসন করার সময়। খানিকক্ষণ শবাসন করে, অবশেষে বুকে বালিশাসন এবং হাতে মোবাইলাসন করে পড়ে থাকতে হবে।’ ‘বালিশাসন’ অবধি ঠিক আছে, কিন্তু ‘মোবাইলাসন’ পড়ে হাসতে হাসতেই খোঁচা খান পাঠক। এই যে নিজেকে ব্যঙ্গের ছলে পাঠককেও জিলিপির প্যাঁচে ফেলা, উত্তম রম্যরচনার এই গুণ গোটা বইতে ফুল, থুড়ি হুল ফুটিয়েছে থেকে থেকে।
ভাল রম্যে নিছক মজার ভেতরেও উঁকি মারে দেশ-কাল-সমাজ। তবে সরাসরি টের পেলে ফাউল। যেমন ধরুন, ‘বিবাহ অভিযান’ গদ্যটির কথাই। কেন্দ্রীয় চরিত্র শিবুদা। হাফ ইঞ্জিনিয়ার এবং অর্ধেক ব্রহ্মচারীর শিবুদার বিয়ে খেতে গিয়ে তুমুল ভোগান্তি হয় লেখক ও তাঁর সঙ্গীদের। ঝড়খালির সেই গ্রামে শৌচালয় থেকে খ্যাটন সবেতেই বিপত্তি। ‘মাংস যেন শকুনের ঠ্যাং’। লেখকের সঙ্গীদের একজন সৌভিক। অপূর্ব লিখছেন– ‘বেচারা সৌভিক গোঁসাই বংশের ছেলে। আগে কখনও মাংস খায়নি। অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে ওর নিয়মভঙ্গ করিয়েছি। ওকে বলেছি, বিবেকানন্দ স্বয়ং মাংস খেতে বলেছেন। …তা ছাড়া শিবুদার বিয়ের মাংস মানে মহাপ্রসাদ।’ গদ্যের শেষ হয়– ‘‘পরদিন ভোরবেলা থেকে শুরু প্রত্যাবর্তন যাত্রা। সকাল আটটা নাগাদ ঝড়খালি বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি। রেডিওতে লোকসভা ভোটের ফল ঘোষণা চলছে। সাড়ে তিনশো আসনে এগিয়ে মোদিবাবু। আচ্ছে দিন আ রাহা হ্যায়। পরের বার যখন শিবুদার বিয়ে হবে, হাড়ের সঙ্গে নিশ্চয়ই মাংসের টুকরো থাকবে দু’একটা।’’
সমকাল তীব্র কটাক্ষে উঠে আসে ‘শীতের মুকুটমণিপুরে…’ গদ্যে। এর বিষয়বস্তু ‘ক্যাপশন’। সেকথা বলতে গিয়ে একালের নায়িকাদের ‘সাহসী’ প্রসঙ্গ আসে। লেখা হয়, ‘আগে সাহসী হওয়ার জন্য অসাধারণ কিছু করে দেখাতে হত। বাঘের খাঁচায় ঢুকে খেলা দেখাতে হত, রাত্রির অন্ধকারে অস্ত্রাগার লুণ্ঠন করতে যেতে হত, গুলি খেয়েও হাতে পতাকা ধরে রাখতে হত। এখন দেখুন, মডেল আর নায়িকারা স্বভাবতই দুঃসাহসী। পোশাকের পরিধি যত কমে সাহসের বারিধি তত বাড়ে।’ শেষের বক্রোক্তি– ‘সেই হিসেবে দেখলে এযুগে গ্রাত্রাবরণ মূলত ভীরু মানুষদের জন্য।’ কিংবা উদ্ভট এক ঝঞ্ঝটের মধ্যে শুরু হয় ‘লাভ রিয়্যাক্ট’ গদ্যটি– ‘ফেসবুকে আমি সাধারণত সেফ গেম খেলার চেষ্টা করি।… যেমন ধরুন, দিলীপ ঘোষের পোস্টে লাইক মারলে পাছে কেউ বি জে পি ভেবে বসে– অমনি গিয়ে সায়নী ঘোষের পোস্টে টুক করে একটি লাইক মেরে দিই।’ এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করবে কে? সকলেই যে ভুক্ত এবং ভোগী। একইভাবে লেখক যখন বলেন, ‘মানসিক কনস্টিপেশনের খুব কার্যকরি টোটকা খিস্তি।’ তখন আয়নার মুখোমুখি হয়ে মুচকি হাসেন পাঠক।
অপূর্ব সৎপতির রম্যরচনাগ্রন্থ ‘হাসকুটে’ আরেক বিষয়েও নীরব ঘোষণা দিয়েছে। মনে রাখতে হবে পত্রপত্রিকায় নয়, লেখকের গদ্যগুলি প্রথমবার প্রকাশ্যে এসেছিল সামাজিকমাধ্যমে। সেই রচনাসম্ভারই এবার গ্রন্থাকারে বাংলা রম্য সাহিত্যে নয়া সংযোজন। অর্থাৎ অপূর্ব এবং তাঁর গ্রন্থ প্রমাণ করল, বঙ্গ সাহিত্যের ময়দানে পত্রপত্রিকার আর তত ভূমিকা নেই। সোশ্যাল মিডিয়ার যুগ ভেঙে গিয়েছে বড় প্রতিষ্ঠানের ম্যানুফ্যাকচার করা লেখকদের একচেটিয়া ‘বাজার’। আপনার অন্তরবাগানে যদি প্রতিভাগাছ থাকে, তবে একটি মুঠোফোনই যথেষ্ট অস্ত্র।
হাসকুটে
অপূর্ব সৎপতি
ধানসিড়ি। মূল্য ২০০