ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘প্রফুল্ল রসায়নী’ বইটি প্রফুল্ল রায়ের জীবন-আধারিত উপন্যাস। কিন্তু, দুঃখের বিষয়, ‘আত্মচরিত’-এ যে পরিমাণ হৃদয়, যে পরিমাণ পরিশ্রম করেছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র– এই যেমন, তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালিখিতে ইংরেজি শব্দ হোক কিংবা আপন জীবনের স্মৃতি উজাড় করতে গিয়ে পারসি বা আরবি শব্দের আগমন, যা বাংলা কথনে হয়তো অচেনা শব্দ, তার সটীক বিবরণ রেখেছিলেন। কেবল তা-ই নয়, জীবনের পর্যায়গুলিকে ভেঙেছিলেন সুচারুভাবে সমকালীন ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে। কিন্তু এই উপন্যাসে আচার্যর জীবনবেত্তা উঠে এসেছে অকারণ প্রফুল্ল আখ্যানে, কাল্পনিক সংলাপে, টীকাহীন উদ্ধৃতি-সহ।
“বাঙালী আজ জীবন মরণের সন্ধিস্থলে উপস্থিত। একটি সমগ্র জাতি মাত্র কেরাণী বা মসীজীবী হইয়া টিকিয়া থাকিতে পারে না; বাঙালী এতদিন সেই ব্রান্তির বশবর্ত্তী হইয়া আসিয়াছে এবং তাহারই ফলে আজ সে সকল প্রকার জীবনোপায় ও কর্ম্মক্ষেত্র হইতে বিতাড়িত। বৈদেশিকগণের ত কথাই নাই, ভারতের অন্যান্য প্রদেশস্থ লোকের সহিত ও জীবন সংগ্রামে আমরা প্রত্যহ হঠিয়া যাইতেছি। বাঙালি যে ‘নিজ বাস ভূমে পরবাসী’ হইয়া দাঁড়াইয়াছে, ইহা আর কবির খেদোক্তি নহে, রূঢ় নিদারুণ সত্য। জাতির ভবিষ্যৎ যে অন্ধকারাবৃত, তাহা বুঝিতে দূরদৃষ্টির প্রয়োজন হয় না। কিন্তু তাই বলিয়া আশা ভরসায় জলাঞ্জলি দিয়া হাত গুটাইয়া বসিয়া থাকিলেও চলিবে না। ‘বৈষ্ণবী মায়া’ ত্যাগ করিয়া দৃঢ়হস্তে বাঁচিবার পথ প্রস্তুত করিয়া লইতে হইবে।”
প্রায় অশীতিপর বয়সে পৌঁছে সাধারণত মানুষ স্মৃতির জাবর কাটে, এবং নতুন প্রজন্মের বাপবাপান্ত-শাপশাপান্ত করে আপন প্রজন্ম ও নিজস্ব জীবনযাপনের ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করে। আত্মবিশ্লেষণে। কিন্তু, উপরোক্ত উদ্ধৃতি যে বাঙালি ভদ্রলোকের– তিনি প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। ৭৬ বছর বয়সে পৌঁছে স্মৃতিসত্তার প্রকাশে যা বেরিয়ে আসছে, সেখানে কেবল ব্যক্তি নয়, একইসঙ্গে শব্দে শব্দে আত্মবিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে সমকালীন দেশ-জাতি-সমাজ-রাজনীতির ঘনঘোর কুয়াশা কাটতে কাটতে যাচ্ছে তাঁর লেখা। নতুন করে উল্লেখ অপ্রয়োজনীয়, তবু বলা দরকার, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তাঁর জীবনসায়াহ্নে এসে ‘আচার্য’ উপাধি পেয়েছিলেন বটে সমবয়সি ও সমকালীন আরেক বাঙালি মনীষা রবীন্দ্রনাথের থেকে এবং বিজ্ঞানী ও শিল্পপতি হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলেছেন– কিন্তু, যা হয়, বাঙালি ‘আত্মঘাতী’ জাতি। ‘বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যাল’-এর জাল পণ্যের ছড়াছড়ি ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন কালোবাজারের অন্ধকারাচ্ছন্ন জেল্লাই ছিল তাঁর শেষজীবনের প্রাপ্তি। খুব ভালোভাবেই বুঝেছিলেন, যতই বিজ্ঞান পড়াও, প্রযুক্তি হাঁকাও, স্বনির্ভর করার চেষ্টা করো, বাঙালি কর্মজীবনে কেরানিগিরি ও ভাবজীবনে হয়রানিগিরি ছাড়া অন্যত্র সাফল্য দেখাতে অক্ষম এবং উপর্যুপরি অপারগ। তবু, নিজেকে ‘সাম্পেল’ বানিয়েই ‘আত্মচরিত’ শীর্ষক আত্মজীবনী লিখনে প্রয়াসী হয়েছিলেন, যদি দৃষ্টান্ত দিয়ে জাতিকে ঠেকনা দেওয়া যায়। প্রথমে ইংরেজিতে লিখেছিলেন এবং অসম্ভব সত্ত্বেও সেই ভারী কলেবরের দাম রেখেছিলেন ‘পাঁচ টাকা’, যাতে বইয়ের বক্তব্য কেরানিলোকের মাথায় বাড়ি মারতে পারে। বই যথারীতি আলোড়ন ফেলল। কারণ, ভূমিকা থেকেই শুরু করে জন্মবৃত্তান্ত পেরিয়ে তিনি যে যে পরিচ্ছদে জীবনকে ভেঙেছেন, সেখানে উঠে এসেছে ভারত তথা বাংলার ইতিহাসের ক্রমবিবর্তন। যেখানে জমিদারি প্রথার পত্তন, বিনাশ, গ্রাম-কে-গ্রাম মড়ক, গ্রামের মানুষের শহরে পরিযান, দেশে শিক্ষাব্যবস্থার ক্রমবিকাশ ও ধরনধারণের বিবর্তন পেরিয়ে তা ঢুকে পড়েছে সমকালীন রাজনীতি, বন্যা, দুর্ভিক্ষ, দেশীয় শিল্প, ধনতন্ত্রবাদ, বেকার সমস্যা এবং সর্বোপরি হিন্দু সমাজের গতিপ্রকৃতি– ঝাঁপিয়ে এসে পড়েছে তাঁর কথনে, ভাষ্যয়। জীবন কখন টুক করে মহাজীবনের চৌকাঠ মাড়ায়, তার অন্যতম দৃষ্টান্ত হতে পারে এই আত্মচরিত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
নতুন করে উল্লেখ অপ্রয়োজনীয়, তবু বলা দরকার, প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তাঁর জীবনসায়াহ্নে এসে ‘আচার্য’ উপাধি পেয়েছিলেন বটে সমবয়সি ও সমকালীন আরেক বাঙালি মনীষা রবীন্দ্রনাথের থেকে এবং বিজ্ঞানী ও শিল্পপতি হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা অর্জন করে ফেলেছেন– কিন্তু, যা হয়, বাঙালি ‘আত্মঘাতী’ জাতি। ‘বেঙ্গল ফার্মাসিউটিক্যাল’-এর জাল পণ্যের ছড়াছড়ি ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন কালোবাজারের অন্ধকারাচ্ছন্ন জেল্লাই ছিল তাঁর শেষজীবনের প্রাপ্তি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
বিশ্বসমাজে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন কেবলই বিজ্ঞানী হিসেবে নয়, একইসঙ্গে অন্যতম মানবিক মুখ ও বুদ্ধিবেত্তা হয়ে উঠেছিলেন কেবলই নিজস্ব শ্রেষ্ঠত্বে নয়, নেপথ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো ঘনঘোর সময়ও রয়েছে। সেই একই সময়ের শরিক প্রফুল্ল চন্দ্র। তিনি ‘ম্যানহাটন’ প্রোজেক্টে কাজ করেননি ঠিকই, কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের দেশ উপর্যুপরি উপনিবেশকালে নিজের সমাজের কথা ভেবে যা করেছেন এবং যেভাবে বিজ্ঞানচর্চার মধ্যে রাজনৈতিকতা, সোশ্যালিজমের ভাবনা প্রবিষ্ট করেছিলেন– তা অতিমানবিকতাই, যদিও ‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’। ফলে, প্রফুল্ল চন্দ্র আইনস্টাইন হতে পারেননি। কিন্তু, তিনি কী পেরেছিলেন ও করেছিলেন এবং করতে চেয়েছিলেন, সেসব ‘আত্মচরিত’-এ কিঞ্চিৎ নাক গলালেই বোঝা যাবে, বুকের পাটা লাগে।
ব্রিটেনে ব্রিটিশ সরকারেরই বৃত্তি অর্জন করে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়ে সিপাহি বিদ্রোহ নিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের রোষানলে পড়েছিলেন, কিন্তু পরোয়া করেননি। সেই মানুষ তাঁর যৌবনের রক্তগরম বয়ে বেড়িয়েছিলেন আজীবন, তা তাঁর আত্মজীবনে প্রবলভাবে ধরা পড়ে। বাঙালির বিজ্ঞানচর্চা ব্যতিরেকেই কেবলমাত্র কালের যাত্রা হিসেবে বাংলা সাহিত্য ও বঙ্গীয় ইতিহাসের অন্যতম দৃষ্টান্ত হয়ে আছে আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্রর ‘আত্মচরিত’, কিন্তু অদ্য বিস্মৃত।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: যে আলেখ্য বঙ্গ-রাজনীতির আধুনিক ইতিহাস রচনায় রসদ জোগাবে
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
সেই বিস্মরণে খানিক ঘাই মারল ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের লেখা ‘প্রফুল্ল রসায়নী’ বইটি। প্রফুল্ল রায়ের জীবন-আধারিত উপন্যাস। কিন্তু, দুঃখের বিষয়, ‘আত্মচরিত’-এ যে পরিমাণ হৃদয়, যে পরিমাণ পরিশ্রম করেছিলেন প্রফুল্ল চন্দ্র– এই যেমন, তাঁর বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালিখিতে ইংরেজি শব্দ হোক কিংবা আপন জীবনের স্মৃতি উজাড় করতে গিয়ে পারসি বা আরবি শব্দের আগমন, যা বাংলা কথনে হয়তো অচেনা শব্দ, তার সটীক বিবরণ রেখেছিলেন। কেবল তা-ই নয়, জীবনের পর্যায়গুলিকে ভেঙেছিলেন সুচারুভাবে সমকালীন ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে। সমাজ সম্পর্কে নিজের মনে হওয়া-কে প্রকাশ করার বেলায় সমকালীন বিরূপ বার্তার বা সেই মনে হওয়ার সঙ্গে সংঘাতমূলক অন্য কোনও গুণীজনের বক্তব্যকে পেশ করেছিলেন পাশাপাশি, যেন রাসায়নিক পরীক্ষাগারে আইডিয়াল ও রিয়্যাল স্টেট নিয়ে পর্যালোচনা। কিন্তু এই উপন্যাসে আচার্যর জীবনবেত্তা উঠে এসেছে অকারণ প্রফুল্ল আখ্যানে, কাল্পনিক সংলাপে, টীকাহীন উদ্ধৃতি-সহ। লেখক কেন প্রায় দু’শো পাতা খরচ করে এই মহাজীবনের কাহিনিকারিতা বেছে নিলেন, সেই উপলক্ষে কোনও ভূমিকা লেখার দায় মনে করেননি। উপন্যাসের শেষে তথ্যসূত্র দিয়ে দায় সেরেছেন যে, তা প্রকাশ পায় উপন্যাস জুড়ে সেসব তথ্য ব্যবহারের টীকাহীনতায়, আগেই বলেছি।
উপন্যাসের নির্মাণে কালের হঠাৎ হঠাৎ কাট-পেস্ট সিনেম্যাটিক চেষ্টা মাঠে মারা গিয়েছে, তা আদপে যথাযথ গবেষণার অভাবেই। যেখানে প্রফুল্ল চন্দ্র নিজেই আত্মজীবনী লিখেছেন, সেখানে কেন তার ধারাবিবরণের প্রয়োজন, কেনই বা সংলাপ প্রয়োজন– আর যদি প্রয়োজন হয়ই, তাহলে কালের নিরিখে সেই কথোপকথনের ধরন কেমন হতে পারে, কীভাবে ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে তৎকালীন সময়ের অভিক্ষেপ জুড়ে দিয়ে মহাজীবনের পরিসর গড়ে তোলা যায়, তা নিয়ে ভাবনামোচনে যথেষ্ট অভিনিবেশের অভাব বা গাফিলতি ধরা পড়ে।
তাঁর আত্মজীবনী জনসাধারণের কাছে যাতে পৌঁছে যায়, তার জন্য প্রফুল্ল চন্দ্র তাঁর প্রাথমিকভাবে লেখা ইংরেজি সংস্করণের দাম ধার্য করেছিলেন পাঁচ টাকা। বিশেষভাবে উল্লেখ্য, তিনি এই জনসাধারণের মধ্যে ‘গৃহ-লক্ষ্মী’দেরই বেশি করে চেয়েছিলেন, তাঁরা এই বই পড়ুন। তা বোধ করি, মায়ের পাঠ ধরে নতুন প্রজন্মের মধ্যে মনীষীজীবনের প্রভাব চারিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, ঠিক যেভাবে এখনও ছোটদের হাতে ধরানো হয় মনীষীদের জীবন। শুধু তা-ই নয়, এর বাংলা সংস্করণের সময়, ইংরেজি সংস্করণের তুলনায় কলেবরে বৃহত্তর হওয়া সত্ত্বেও, দাম কমিয়ে আড়াই টাকা ধার্য করেছিলেন তিনি, প্রকাশকের সঙ্গে ঝামেলাঝাঁটি করেই। উদ্দেশ্য: তাঁর ভাষ্য, তাঁর চিন্তা আরও বৃহত্তর পরিসরে পৌঁছে যাক।
কোনওরূপ বাড়াবাড়ি না করেই বলা দরকার, বিজ্ঞানচেতনায় টইটম্বুর সমাজজীবন ও চেতনা নিয়ে লেখা এই আত্মচরিত আদপে এক ইস্তেহার ছিল। সেই ইস্তেহার কতখানি পৌঁছতে পেরেছিল, জানা যায় না। এবং পৌঁছতে যে পারেনি, তা প্রমাণিত হয় এই বইয়ের বিস্মরণেই।
সেখানে ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়ের এই জীবনোপন্যাস কিঞ্চিৎ ধুলো ওড়ালেও, খানিক মলিন লাগে ওই বৈচিত্রময় জীবন। যিনি কি না ‘বিজ্ঞানীর বেশে বিপ্লবী’ রূপে খ্যাত হয়েছিলেন, সেই বিপ্লবকে খুঁজতে গিয়ে চোখের পাতায় ক্লান্তি আনে। এই বই নাড়াচাড়া করে পাঠক যদি প্রফুল্ল রায়ের স্বলিখিত প্রয়াসের দিকে হাত বাড়ায়, তবে বইটি সফল।
প্রফুল্ল রসায়নী
ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়
৩০০
মান্দাস