ভারতীয় মার্গ সংগীত কিংবা বাদ্যযন্ত্র চর্চার পথপ্রবাহ একাধিক ঘরানা, গুরুপরম্পরা, রাগরূপ ও তার নির্মাণ ও পরিবর্তন, সব মিলিয়ে জটিলই বটে। কিন্তু সেই সংগীতচর্চাই তো ছিল মজলিশে পরিবেশনের মন-ভেজানো শিল্প। সংগীতের ইতিবৃত্তে সেই মজলিশি মেজাজ সঞ্চারিত করে দিলে তা কেমন তুলনাহীন সরস হতে পারে, কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের একাধিক লেখায় তা দেখা গিয়েছে। এই বইটি সেই লেখার ঘরানা অনুসরণ করেছে এমন নয়, তবে সহজ কথায় গল্প জমানোর ভঙ্গির লিখনশৈলীটি আয়ত্ত করেছেন এ-বইয়ের লেখক।
বয়স যখন সবে সাত পেরিয়েছে, তখনই শিশুটির হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল সেতার। না, পরিবারের নির্দেশে নয়, তার নিজেরই ইচ্ছায়। খুব ছোটবেলা থেকেই যে সুরের সামনে সে শান্ত হয়ে বসে, তা নজর করেছিলেন বাড়ির বড়রা। তার সেই আগ্রহকে কেবল উসকে দেওয়ার কাজটুকুই তাঁরা করেছিলেন সযত্নে। দীক্ষাগুরুও মিলে গিয়েছিল শিশুটির ১৫ ভাই, ১৬ বোনের যৌথ পরিবারের মধ্যে থেকেই। তার চেয়ে ৩১ বছরের বড় বড়দা, যিনি ঢাকার নবাবের দপ্তরে ঘণ্টা চারেক চাকরি করে বাকি সময় ব্যয় করতেন নিজের গানবাজনা-ফোটোগ্রাফির শখে, তিনিই নিয়েছিলেন সেতার শেখানোর ভার।
ঢাকার বিখ্যাত সেতারি ভগবানচন্দ্র দাসের ভাই শ্যামচন্দ্র দাসের কাছে, পরে এনায়েৎ খাঁ সাহেবের শাগরেদ মনোরঞ্জন মুখোপাধ্যায়ের কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন সেই মানুষটি। ফলে তাঁর সূত্র ধরেই এই বিভিন্ন ঘরানার শিক্ষা চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়েছিল নবীন শিক্ষার্থীর কাছে। আর ১১ বছর বয়সে তিনিই ভাইকে পৌঁছে দেন এমন একজন শিল্পীর কাছে, পরবর্তী জীবন ধরে যাঁকে নিজের শিক্ষাগুরু বলেই মেনে চলবেন সেদিনের কিশোর– সিদ্ধার্থ রায়। জীবনের আলাপ বিস্তারের শেষবেলায় এসে নিজের এই সামগ্রিক সংগীতশিক্ষার্থী জীবনের কথা লিখতেই কলম ধরেছেন তিনি। যদিও বইয়ের নাম ‘সংগীতশাস্ত্রী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর স্মৃতি’, লেখক বলেওছেন যে ‘মাস্টারমশাই’-এর কথা যা কিছু মনে পড়ে, তা লিখে রাখতে চেয়েই তাঁর এই উদ্যোগ, কিন্তু এ-বইয়ে কেবল সেই স্মৃতিটুকুই ধরা নেই। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘তার আগে আমার নিজের প্রাথমিক সংগীতশিক্ষার কথা বলতে হবে আনুপূর্বিকভাবে। তা না হলে তিনি আমাকে শিষ্য করে নিতে রাজি হলেন কেন সেটা বোঝা যাবে না। আবার, কীরকম পারিবারিক পরিবেশে একটা ছোট্ট ছেলের সংগীতশিক্ষার আয়োজন করা হয়,– লেখাপড়া শেখাবার সঙ্গে সঙ্গে সেতার শেখাবারও ব্যবস্থা করা হয় সমান উদ্যমে,– সেটাও সবিস্তারে বলা দরকার।’ আবার যিনি সংগীতকে বৃত্তিরূপে গ্রহণ করেননি, গুরুর কাছে পাওয়া শিক্ষাকে তিনি কীভাবে ধারণ করেছিলেন, সেই কথার উত্তর দেওয়ারও একরকম তাগিদ ছিল তাঁর। পরবর্তী জীবনে তিনি যে ওস্তাদ মুস্তাক আলি খাঁ, পণ্ডিত তারাপদ চক্রবর্তী, ওস্তাদ কেরামতুল্লা খাঁ, পণ্ডিত নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত চিন্ময় লাহিড়ী, পণ্ডিত শঙ্কর ঘোষ প্রমুখের সংস্পর্শে এসেছিলেন, তারও নেপথ্য অনুঘটক ছিল ওই সংগীতচর্চাই। সংগীতের দুনিয়ায় জীবনভর এই বিচরণের কথাও উঠে এসেছে তাঁর লেখায়। আর এই যাবতীয় কথার সূত্র ধরে এ-বইয়ে মিলেমিশে গিয়েছে গুরু ও শিক্ষার্থী উভয়েরই জীবনচিত্র, গ্রন্থনামের মতো তা আর একমুখী থাকেনি।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সংগীতশাস্ত্রী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীকে বর্তমান প্রজন্মের সংগীতরসিকেরা মনে রেখেছেন সংগীততত্ত্বের এক অসামান্য কোবিদ্-রূপে। কিন্তু তাঁর যে এসরাজ বাদনে পুরোদস্তুর তালিম ছিল সে-কথা প্রায় কেউই জানেন না, কারণ জনসমক্ষে কখনও অনুষ্ঠান করেননি তিনি। তেমনই গৌরীপুরে শিক্ষালাভের সময় ওস্তাদ এনায়েৎ খাঁ-র সঙ্গে যে তাঁর নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, আবার খাতার পাতায় স্বরলিপি লিখে তিনি যে সেতার ও অন্যান্য যন্ত্রের উপযোগী গৎ রচনা করে চলতেন অনর্গল, আর সেই স্বরলিপির মাধ্যমেই তালিম দিয়ে তৈরি করেছিলেন দক্ষিণামোহন ঠাকুর, শোভা ঘোষ (কুণ্ডু) প্রমুখ কয়েকজন সেতারি ও অন্যান্য যন্ত্রীকে– সেসব কথাও টুকরো টুকরো গল্পে ধরা পড়েছিল তাঁর শিক্ষার্থী ও ঘনিষ্ঠদের কাছেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
বস্তুত, ভারতীয় মার্গ সংগীত কিংবা বাদ্যযন্ত্র চর্চার পথপ্রবাহ একাধিক ঘরানা, গুরুপরম্পরা, রাগরূপ ও তার নির্মাণ ও পরিবর্তন, সব মিলিয়ে জটিলই বটে। কিন্তু সেই সংগীতচর্চাই তো ছিল মজলিশে পরিবেশনের মন-ভেজানো শিল্প। সংগীতের ইতিবৃত্তে সেই মজলিশি মেজাজ সঞ্চারিত করে দিলে তা কেমন তুলনাহীন সরস হতে পারে, কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের একাধিক লেখায় তা দেখা গিয়েছে। এই বইটি সেই লেখার ঘরানা অনুসরণ করেছে এমন নয়, তবে সহজ কথায় গল্প জমানোর ভঙ্গির লিখনশৈলীটি আয়ত্ত করেছেন এ-বইয়ের লেখক।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: শিল্প নিয়ে কোনও টিকরমবাজি রেয়াত করতেন না অহিভূষণ মালিক
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সংগীতশাস্ত্রী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীকে বর্তমান প্রজন্মের সংগীতরসিকেরা মনে রেখেছেন সংগীততত্ত্বের এক অসামান্য কোবিদ্-রূপে। কিন্তু তাঁর যে এসরাজ বাদনে পুরোদস্তুর তালিম ছিল সে-কথা প্রায় কেউই জানেন না, কারণ জনসমক্ষে কখনও অনুষ্ঠান করেননি তিনি। তেমনই গৌরীপুরে শিক্ষালাভের সময় ওস্তাদ এনায়েৎ খাঁ-র সঙ্গে যে তাঁর নিবিড় বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল, আবার খাতার পাতায় স্বরলিপি লিখে তিনি যে সেতার ও অন্যান্য যন্ত্রের উপযোগী গৎ রচনা করে চলতেন অনর্গল, আর সেই স্বরলিপির মাধ্যমেই তালিম দিয়ে তৈরি করেছিলেন দক্ষিণামোহন ঠাকুর, শোভা ঘোষ (কুণ্ডু) প্রমুখ কয়েকজন সেতারি ও অন্যান্য যন্ত্রীকে– সেসব কথাও টুকরো টুকরো গল্পে ধরা পড়েছিল তাঁর শিক্ষার্থী ও ঘনিষ্ঠদের কাছেই। স্মৃতির পাতার ধুলো ঝেড়ে গুরুর সেই ব্যক্তিক রূপটিকেই প্রকাশ করেছেন তাঁর শিষ্য। এক সংগীতশাস্ত্রীকে ঘিরে সেই সহজ স্মৃতিচারণটুকুই এ-বইয়ের বড় পাওনা।
সংগীতশাস্ত্রী সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তীর স্মৃতি
সিদ্ধার্থ রায়
ঋতাক্ষর প্রকাশন
৩০০ টাকা
‘মহুয়া’র প্রচ্ছদের নেপথ্যে নন্দলালের আঁকা সহজ পাঠের ছবি রবীন্দ্রনাথকে নিশ্চয়ই প্রাণিত করেছিল। সহজ পাঠের আগে আমরা দেখেছি, ১৯২২ সালের শেষে আন্দ্রে কারপেলেস প্যারিস থেকে এনেছিলেন একগুচ্ছ কাঠখোদাই। এমনকী, বিশের দশকে রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকবার বিদেশ সফরে গিয়েছেন, সেখানে জার্মানিতে ও ফ্রান্সে তাঁর রীতিমত চেনাজানা ঘটেছিল কাঠখোদাই মাধ্যমটির সঙ্গে।