জীবন ভুল করলেও মৃত্যু ভুল করে না, বিশ্ব অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে প্রাণীজগৎকে। চিকিৎসকদের ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ প্রমাণ করে আড়াই মাসের মাথায় প্রয়াত হন কোভিড আক্রান্ত এই গ্রন্থের লেখিকা। তার চেয়ে বড় কথা, লিখিত হয় ‘অবভাস’ প্রকাশিত ‘শিকড়-গাথা, এক অনাম্নীর শেষবেলার দিনলিপি’। বলে দিতে হয় না এই গ্রন্থ যমের দুয়ারে ছুড়ে দেওয়া নশ্বর মানুষের চিরকালীন চ্যালেঞ্জ! নচিকেতা, মৈত্রেয়ী, গার্গী, অপলার মতো আলোকপ্রাপ্ত কি অনাম্নী? মৃত্যু উপেক্ষা করে অনন্তের নৌকোয় জীবন নিঙড়োনো অক্ষরমালাকে চাপিয়ে দেওয়ার সাহস পেলেন কোথা থেকে?
‘এই শেষ বেলায় নতুন করে শিকড় ছড়ানোর মতো মাটি কোথায় পাব। এই সব ভেবে রাতগুলো হয়ে উঠছে দীর্ঘ আর নির্ঘুম। একদিকে বিছানায় অস্থির শরীর, আরেক দিকে বিভ্রান্ত মন। যে কোনও সময় আচমকা থেমে যেতে পারে আমার এই পথ চলা। এই ভাবনা ঘুণ পোকার মতো আমার মাথায় সুড়ঙ্গ তৈরি করে চলেছে; এ কি বিদায়ের প্রস্তুতি নাকি অমূলক আশঙ্কা। আমার এই পরিক্রমার শেষে থেকে যাবে কি কিছু আফশোস, কিছু মনস্তাপ?’ কোনও উপন্যাস কী গল্পে মৃত্যুপথযাত্রী চরিত্রের এ হেন অন্তর্গত সংলাপ পাঠকের মনে করুণার উদ্রেক করে বটে, তথাপি দিনের শেষে তা সাহিত্যরস। ফলে বই গুটিয়ে অনায়াসে ফুর্তির পৃথিবীর দিকে হাঁটা চলে। এক্ষেত্রে উপায় নেই। যেহেতু এই সংলাপ রক্তমাংসের ‘এক অনাম্নীর শেষবেলার দিনলিপি’।
কাছেই গাছের মৃত্যু! শিকড় আলগা হচ্ছে, এমন সময় রচিত ‘শিকড়-গাথা’ এক সাদামাটা নারীর আশ্চর্য দিনলিপি। গ্রন্থের উপস্থাপক অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়ের মরমী ভূমিকা থেকে জানতে পারি, মৃত্যুর সওদগর মহামারী কোভিড জন্ম দিয়েছিল এই লেখা ও লেখকের! কীভাবে? অঙ্গনা লিখেছেন, ‘থমকে যাওয়া দিন যাপনের মাঝে একদিন আমার মুঠোফোনেই ভেসে এল এক দুঃসহ দুঃসংবাদ। জানতে পারলাম, আমার এক নিকট আত্মীয়া, যার সঙ্গে আমার সম্পর্ক নিবিড় এবং অন্তরঙ্গ, তিনি মারণরোগে আক্রান্ত।’ বিশ্বজোড়া সেই দুঃস্বপ্নের দিনে জবাব দেন চিকিৎসকরা, বড়জোর দেড়-দু’-মাস আত্মীয়ার বেঁচে থাকার মেয়াদ। স্বভাবতই ভেঙে পড়েন অঙ্গনা। কিন্তু আশ্চর্যের কথা, যার সঙ্গে আর দেড়-দু’মাসের সম্পর্ক এই নীলগ্রহের, ‘সেই আত্মীয়া তাঁর জীবনে অকস্মাৎ নেমে আসা অমোঘ নির্মম পরিণতিকে তুচ্ছ করে আমাকে জানালেন অন্তিম ইচ্ছের কথা।’ কী সেই ইচ্ছে? ‘প্রতিদিন একটু একটু করে মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যেতে যেতে তিনি লিখে রেখে যাবেন তাঁর জীবনের কিছু কথা।… তাঁর মৃত্যুর পর যেন সেই লেখা ছাপার অক্ষরে প্রকাশ করবার দায়িত্ব নিই আমি।’
জীবন ভুল করলেও মৃত্যু ভুল করে না, বিশ্ব অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে প্রাণীজগৎকে। চিকিৎসকদের ভবিষ্যদ্বাণী অব্যর্থ প্রমাণ করে আড়াই মাসের মাথায় প্রয়াত হন কোভিড আক্রান্ত এই গ্রন্থের লেখিকা। তার চেয়ে বড় কথা, লিখিত হয় ‘অবভাস’ প্রকাশিত ‘শিকড়-গাথা, এক অনাম্নীর শেষবেলার দিনলিপি’। বলে দিতে হয় না এই গ্রন্থ যমের দুয়ারে ছুড়ে দেওয়া নশ্বর মানুষের চিরকালীন চ্যালেঞ্জ! নচিকেতা, মৈত্রেয়ী, গার্গী, অপলার মতো আলোকপ্রাপ্ত কি অনাম্নী? মৃত্যু উপেক্ষা করে অনন্তের নৌকোয় জীবন নিঙড়োনো অক্ষরমালাকে চাপিয়ে দেওয়ার সাহস পেলেন কোথা থেকে?
তার পিছনে কোনও দেবতা নেই, রয়েছে মানুষ। একটি প্রবন্ধগ্রন্থ। পরিমল ভট্টাচার্য রচিত ‘যন্ত্রণার উত্তরাধিকার’। অনাম্নী লেখিকার বয়ান, ‘বইটা পড়তে পড়তে হঠাৎ এমন একটা মুহূর্ত এল যখন মনে হল আমার নিস্তরঙ্গ মন-পুকুরে একটা ঢিল এসে পড়েছে…।’ যে বাক্যে এসে থমকে যায় লেখিকার পাঠ, সেটি হল– ‘হিরাইথ হল এক স্মৃতিমেদুর অনুভূতি, ঘরে ফেরার টান, এমন এক ঘরে ফেরার টান যে ঘরের বাস্তবে কোনও অস্তিত্ব নেই।’ শিকড়-গাথার লেখিকা অনুভব করেন, তিনিও তো এক ঘরহীন ঘরের খোঁজে আজীবন ছুটে বেরিয়েছেন। আক্ষেপের সুরে লেখেন– ‘যতবার খুঁজতে গেছি বুকভাঙা যন্ত্রণাই পেয়েছি।’ তথাপি প্রশ্ন ওঠে, এই যন্ত্রণা কি কেবল অপ্রাপ্তির, নাকি অপূর্ণতার স্মৃতিও এক প্রাপ্তিযোগ?
হিরাইথকে একই সঙ্গে জীবন এবং মৃত্যুর অনুভূব মনে হয়। এই জন্মের সবটাই মিথ্যে অথবা ‘আমার এ ধূপ না পোড়ালে গন্ধ কিছুই নাহি ঢালে/ আমার দ্বীপ না জ্বালালে…।’ যেমন এক খুচরো আলোর কথা– ‘তখন আমি কিশোরী, বয়সন্ধির দোরগড়ায়; অল্পবিস্তর প্রতিবাদ করতে শিখেছি বড়োদের অন্য়ায়ের। একদিন বাড়িতে আসা অতিথিদের সামনে আমার এক আত্মীয়া যেই বলতে শুরু করেছেন যে আমার গায়ের রং মায়ের গায়ের রঙের মতো না হয়ে ‘ফর্সা’ হওয়ায় তা কত ভালো হয়েছে আমার পক্ষে, বিশেষ করে বিয়ের বাজারে আমার ‘দাম’ নিয়ে সমঝোতা করতে হবে না, অমনি আমিও সেই সুযোগে ঝটপট বলে উঠেছিলাম যে আমার মায়ের মতো মেধা ও বুদ্ধি পেয়েছি বলেই তো আমি পরীক্ষায় ভালো ভালো ফল করে চাকরি করে নিজের পায়ে দাঁড়াব, এটাই আমার লক্ষ্য, বিয়ে করতে আমার বয়ে গেছে।’
শিকড়-গাথায় রয়েছে এমনই এক বাঙালি মধ্যবিত্ত নারীর বেড়ে ওঠার কাহিনি। যাঁর সামান্য জীবনে হঠাৎ দেখা দেয় অসামান্যের ঝিলিক। একাকী নদীর দুই পাড়ে বাবা-মা-পরিজন, সমাজ, অর্থনীতি, হিংসা, ভয়, দ্বেষ, অন্তহীন জীবনের টিলা! এই যে সমুদ্রমিলনবেলায় অনাম্নীর স্মৃতিলেখা, তার সূত্রপাত হয়তো পিতা-কন্যার সম্পর্কের সূতোয়! লেখিকার বয়ান, ‘ছোটবেলায় একটা বয়স পর্যন্ত আমার প্রতি মাসে জ্বর হতো। তখন বাবা আমার মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিত। আবোলতাবোল, হযবরল, সুকুমার রচনাবলি, লীলা মজুমদার, উপেন্দ্রকিশোর থেকে গল্প, কবিতা আমাকে পড়ে শোনাত।’ এর পরের বাক্যেই শরীর ডিঙোনো স্নেহের খোঁজ– ‘তাই জ্বর হলে মনে মনে আমার এক রকম অনন্দই হতো।’
এমন স্নেহের পাশে ভেঙে তছনছ হয় মায়া। যখন ঝড়ে উড়ে আসা বুলবুলি লেখিকার মা এবং লেখিকার শুশ্রুষা, আদর পেয়েও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এভাবেই কী খাঁচা জীবন থেকে মুক্তি পায় প্রাণী? মৃত্যুপথযাত্রী লেখিকা পুরুষতান্ত্রিক সমাজে পরবাসী মেয়েদের হয়েও সোচ্চার হন। কর্মজীবনের কটু অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন পাঠকের সঙ্গে। বলেন– ‘পুরুষশাসিত সমাজব্যবস্থায় বসবাসকারী ব্যক্তি হিসেবে মেয়েরা নো-ম্যানস ল্যান্ডের অধিবাসী, এক নেই রাষ্ট্রের নাগরিক।’ তবে এ গ্রন্থের অনুভব জাগতিক জীবনকে ছাপিয়ে যায়। কোভিড যন্ত্রণা থেকে সম্পূর্ণ নিরাময় বা মৃত্যুর আগেভাগে গভীর রাতে লেখক অনুভব করেন, শিকড় যাতনার বৃত্ত সম্পূর্ণ হয় সন্তানের বিযুক্তির হাত ধরে! লেখেন– ‘নিজের শরীর থেকে আলাদা করে, বিচ্ছিন্ন করে তবেই লাভ করা যায় সন্তানের সান্নিধ্য।’ শান্তিনিকেতন গ্রন্থমালায় ‘মৃত্যু ও অমৃত’ শীর্ষক গদ্যে রবীন্দ্রনাথ লেখেন– ‘এই বৈরাগ্যের দ্বারা আত্মা যেন নিজের স্বরূপ কিছু উপলব্ধি করতে পারল।’ কোভিড, মৃত্যু… সেখানে গৌণ।
শিকর গাথা: এক অনাম্নীর শেষবেলার দিনলিপি
উপস্থাপনা: অঙ্গনা চট্টোপাধ্যায়
প্রকাশক: অবভাস। মূল্য ২০০