‘ভালোবাসার কারক প্রকরণ’ বইয়ের ‘নিবেদন’ অংশেই বিশ্বজিৎ রায় ইঙ্গিত করেছেন, ভালোবাসার ব্যাকরণ খোঁজার, তাকে ব্যাখ্যার চেষ্টা যদি এই গ্রন্থে কোথাও থেকেও থাকে, তাহলেও তা ভালোবাসার কিছু উপকরণের দিকে চেয়ে থেকেছে নিষ্পলক। ভালোবাসার ‘কারক প্রকরণ’, অর্থাৎ, কারকের যে ব্যাকরণগত সংজ্ঞা- ক্রিয়াপদের সঙ্গে বাক্যের অন্যান্য পদের সম্পর্ক, তার ভিত্তিতে ভালোবাসায় নিহিত কার্যকারণ সম্পর্ক অন্বেষণে রত হয় এই বই।
অপরের চোখে নিজেকে চেনার মধ্য দিয়েই তৈরি হয় বন্ধুত্বের অন্তর্লীন শরীর, ‘দ্য পলিটিক্স অফ ফ্রেন্ডশিপ’-এ জাঁক দেরিদা যে সন্দর্ভ তুলে ধরেছিলেন, তার সূত্রে এই সারচিন্তায় হয়তো বা পৌঁছে যাওয়া সম্ভব। কিন্তু ভালোবাসার ক্ষেত্রে অঙ্কটা কিন্তু আরেকটু জটিল। দেরিদাকেই যদি আশ্রয় করি, দেরিদা ভালোবাসার মৃত্যুকে চিনিয়েছেন দার্শনিক মোকামে। আমরা যাকে ভালোবাসি, তাকে কি নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে গড়ি বলে ভালোবাসি? সে যেমন, তেমন করে তাকে না চিনে, তাকে আমি যেভাবে চাই, সেভাবে ভালোবেসে ফেলি বলে ভালোবাসা বাঁচে না? এই প্রশ্ন এখন, এই তীব্র আন্তর্জালিক, আদতে প্রেমহীন, বরফশীতল, হত্যাকারী মন ও ধর্ষকামের প্রতি আদতে নির্বিকার সময়ে দাঁড়িয়ে আরও জীবন্ত, আরও দগদগে লাগে যেন।
পড়ুন অন্য পাতাবাহার: পুরুলিয়া বলেছিল: হামদের ভাষাট্ কী?
বিশ্বজিৎ রায় কিঞ্চিৎ এই প্রশ্ন থেকেই এক অন্যতর অনুসন্ধানে রত হয়েছেন তাঁর ‘ভালোবাসার কারক প্রকরণ’ গ্রন্থে। এই বইয়ের লেখাগুলি আগে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত, কিন্তু এই বই যেন প্রকৃত অর্থে এক ‘মনোগ্রাফ’ বা এক-অভিমুখী চিন্তাখণ্ডের ধারক। খণ্ড এই কারণেই, ভালবাসাকে তার সামগ্রিকতায় চিনতে চাওয়ার মতো কোনও অসম্ভব প্রকল্প তা নয়, যা দর্শন, সমাজতত্ত্ব, ইতিহাস, সাহিত্য, বিনোদন সবকিছুর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে অনন্তকাল, এবং শেষত কোন বিন্দুতে মিলবে, তার দিশা না-ও দেখতে পারে। বরং এই বই আঞ্চলিকতায় নিজেকে বেঁধেছে যত্নে, যা মূলত বাংলা সাহিত্যের নানা ঘাটে সফর করে, কদাচিৎ ঘাই মারে বাঙালির ইতিহাসের জলে (রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ প্রসঙ্গ), কখনও বা কোনও মোহানায় মিলে যায় স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর প্রেমচিন্তার সঙ্গে ‘মৃচ্ছকটিক’-এর বসন্তসেনা-চারুদত্তর প্রেমচারণ। কিন্তু যে স্রোত এই বইয়ের মূল সুর, তা বিক্ষিপ্ত হয় না। তা ভালোবাসাকে নিরপেক্ষভাবে চেনার চেষ্টা করে, বুঝতে চায় প্রেম নামক উপত্যকার অন্তঃস্থল।
বইয়ের ‘নিবেদন’ অংশেই বিশ্বজিৎ ইঙ্গিত করেছেন, ভালোবাসার ব্যাকরণ খোঁজার, তাকে ব্যাখ্যার চেষ্টা যদি এই গ্রন্থে কোথাও থেকেও থাকে, তাহলেও তা ভালোবাসার কিছু উপকরণের দিকে চেয়ে থেকেছে নিষ্পলক। ভালোবাসার ‘কারক প্রকরণ’, অর্থাৎ, কারকের যে ব্যাকরণগত সংজ্ঞা- ক্রিয়াপদের সঙ্গে বাক্যের অন্যান্য পদের সম্পর্ক, তার ভিত্তিতে ভালোবাসায় নিহিত কার্যকারণ সম্পর্ক অন্বেষণে রত হয় এই বই। যেভাবে ‘হার্ট’ ও ‘লাভ’-এর আন্তঃসম্পর্ক নির্ণয় করতে চান দেরিদা, সেই আঙ্গিককে স্মরণ করেই শরীর-মনের ভেতরের দেনা-পাওনার সম্পর্ককে লেখক বুঝতে চেয়েছেন। কিন্তু তা খুব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বোঝাপড়ায় আটকে না থেকে ভালোবাসার প্রিজমের বহুবর্ণে ছড়িয়ে গেছে অকাতরে।
পড়ুন: বিশ শতকের চারের দশকেও কি এ বঙ্গে নবজাগরণ ঘটেনি?
মানুষী স্মৃতিই মানুষ, মণীন্দ্র গুপ্ত লিখেছিলেন ‘অক্ষয় মালবেরি’-তে। তাঁর জন্মের দিনের অভিমান ও রাগের উৎস পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পেরেছিল তাঁর স্মৃতি। অথচ তাঁর অল্পবয়সে মায়ের মৃত্যু কিন্তু তাঁকে আলোড়িত করেনি সেভাবেও। বরং পঞ্চান্ন বছর বয়সে দাঁড়িয়ে তাঁর ভাষায় নারীত্বও না ফুটে ওঠা সেই মাকে তিনি অক্লেশে চিনতে চেয়েছিলেন গতজন্মের মা বলে। ‘একদা এমনই বাদলশেষের রাতে/ মনে হয় যেন শত জনমের আগে’– ভালোবাসায় তো এভাবেই স্মৃতি জন্মান্তরের শিকড়ে গিয়ে ধাক্কা খায়। অথচ এমন স্মৃতিহীন সময়ের প্রতিপলে ভালোবাসার মৃত্যু হয়, সেই মৃত্যুর স্মৃতিও ধারণ করি না আমরা, করতে পারি না। আর সেই স্মৃতিহারা, ছিন্নমূল মননকেই চিনতে চেয়েছেন বিশ্বজিৎ বইয়ের প্রথম দু’টি লেখায়। প্রেমিকাকে হত্যা করে যে প্রেমিক তার দেহাংশ রেখে দেয় ফ্রিজে, ততটাই শীতল ও নির্বিকার, যে প্রেম জোড়ে খণ্ডেই, কোনও একাত্মচেতনাই তৈরি হয় না তার, মুখ থেকে মুখে চলে যায় যে দৃষ্টি, আকষর্ণের গতিবিধি, অ্যাপবহুল এই যে সময় প্রেম বা শরীরকে মনে রাখতেও দেয় না বিশেষ– তার বিপ্রতীপে হাঁটতে শুরু করে এই বই তারপর।
তাই তা রবীন্দ্রনাথের ‘তবু মনে রেখো’-র আকুতিকে মাথায় করে রেখে চলে যায় এক জটিল মুসাবিদার অন্তরে, তা খোঁজ করে, রবীন্দ্রনাথের প্রেমে মুক্তির চেতনা কোথায় মিলছে বিবেকানন্দর সঙ্গে। ‘মেঘলা দিনে’-র ভিখিরি কীভাবে বিবেকানন্দর রামকৃষ্ণ-ভাবের সঙ্গে সেতু বাঁধে, তা বিশ্বজিৎ রায় অনুধাবনের চেষ্টা করেন। উঠে আসে মাইকেল-বিদ্যাসাগর প্রসঙ্গ। এ-লেখার শুরুটি উল্লেখ্য–
‘দয়াকে কি ভালোবাসা বলে? করুণা কি ভালোবাসা বলে বিবেচিত হয়? ভালোবাসার ঝরনামুখে পাথর চাপালে কি তা দয়া আর করুণা হয়ে চাপানো পাথরের পাশ দিয়ে বাইরে আসে, ধীর গতি এবং ক্রমশ ছড়িয়ে পড়ে ভিজিয়ে দেয় আশে-পাশের মাটি! ঝরনাটি তীব্র একমুখী ছিল– পাথর চাপাতেই সেই জল আটকে গিয়ে ক্রমে পাথরের গা বেয়ে বাইরে এলো, তুলনায় ধীরে, তারপর ছড়িয়ে পড়ল ঝরনা তলার মাটিতে, ক্রমে অনেকটা জায়গা নিয়ে।’
এই দৃশ্যকল্প দিয়েই দুই মণীষার ভালোবাসার ময়নাতদন্তে লিপ্ত হয়েছেন লেখক। সেই ময়নাতদন্ত যতটা নিস্পৃহ, নির্মোহ, ততটাই সমব্যথী, বুঝদার।
বিরহ-আলাপে যেমন আসেন চণ্ডীদাস, তেমনই ঘুরেফিরে আসে দাম্পত্যের কঠোর নির্মমতার আলেখ্য, যা ‘যোগাযোগ’-কে স্পর্শ করে ঘেঁটে দেখতে চায় এই স্পর্শকাতর অথচ জরুরি বিষয়মুখ। দিলীপকুমার রায়-রবীন্দ্রনাথ পত্রালাপে যেভাবে বঙ্কিমচন্দ্রের দাম্পত্যচিন্তা আসে, তা বাংলা সাহিত্যের সারস্বত চর্চার জন্য প্রয়োজনীয় হয়ে উঠতে পারে। মধুসূদনের ‘বীরাঙ্গনা’ কাব্যের বিদ্রোহ থেকে ‘রক্তকরবী’-র বিশুপাগলের শাশ্বত বেদনামুকুল চলে আসে আলোচনায়। খাজুরাহো দেখে অস্থির চিত্তপ্রসাদের বন্ধু দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়কে লেখা চিঠির সঙ্গতে তাঁর চিত্রভুবনে উঁকি মেরেছেন লেখক। অমিত-লাবণ্য থেকে রাজলক্ষ্মী-শ্রীকান্ত– না হওয়া প্রেম কি নেহাতই মাপে আঁটে না বলেই, এই প্রশ্নেও এক রসিক দৃষ্টি রাখে এই বই। সুনীলের দিকশূন্যপুরের বোহেমিয়ানতা শক্তির হৃদয়পুরে কতটা অনুরণিত হয়, তা যেমন কথায় কথায় এসেছে, তেমনই গোবিন্দলাল-রোহিণীর প্রেমের খুনে পরিণতির সঙ্গে ওথেলো-ডেসডিমোনার সংযোগে লেখক টেনে আনেন নিখিলেশ-বিমলার প্রসঙ্গ। একরকমের ইন্টারটেক্সচুয়ালিটি, পাঠের ভেতর পাঠ যেন এভাবেই চলে।
আরেকটা প্রসঙ্গের কথা অবশ্যই এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। সত্যজিৎ রায়ের মৃত্যুর পর শর্মিলা ঠাকুর ‘অভিযান’-এর প্রসঙ্গে বলেছিলেন, সত্যজিৎ আসলে বন্ধুত্বকে তেমন বোঝেননি। তাই কি তাঁর গল্পে বারবার বন্ধুদের প্রবঞ্চনা? নয়তো ভিনগ্রহীর সঙ্গে বন্ধুত্ব, অথবা সহপাঠীর ছেলের মধ্যে তার শৈশব খুঁজে পেয়ে তবে সন্দেহমুক্ত হওয়া? একই সঙ্গে ফেলুদা-জটায়ুর বন্ধুত্বের সমীকরণই বা কী? একটি অধ্যায় জুড়ে এই প্রসঙ্গে চমৎকার কথোপকথন। ব্যোমকেশ-অজিত-সত্যবতীর কথাও আসে অন্য লেখায়। প্রেম ও বন্ধুতার সীমারেখা নিয়ে ভাবনার তা নতুন খোরাক দেবেই।
কোথাও শরীরকে উপেক্ষা করেননি বিশ্বজিৎ। রামকৃষ্ণর কথায় শরীরের সীমার প্রসঙ্গ হোক, বা পাশ্চাত্যের যৌনতার অভিঘাত থেকে নেহরুর প্রাচ্যের শরীর-চিন্তার সঙ্গে মোলাকাত, নানা প্রসঙ্গ এসেছে তাত্ত্বিক মোড়কেই। শুরুতে লেখক বলেছেন যদিও, রস কম পড়তে পারে শাস্ত্রীয় হওয়ার ঠেলায়, কিন্তু শেষত এই বই যতটা রসের, ততটাই শাস্ত্রসম্মত। ‘মান্দাস’-কে ধন্যবাদ এত সযত্ন প্রকাশনার জন্য।
ভালোবাসার কারক-প্রকরণ
বিশ্বজিৎ রায়
মান্দাস। মূল্য ২৫০ টাকা