শামসুর রাহমান তাঁর ঢাকা শহরটাকে মনে রেখেছিলেন শব্দ দিয়ে। চোখ বন্ধ করলেও ঢাকা শহরের শব্দ শুনতে পেতেন, প্রাণের শহরটা সামনে এসে দাঁড়াত যেন। বদলে যাওয়া ঝাঁ-চকচকে ব্যস্তসমস্ত শহরের মাঝে তিনি চোখ বুজে দাঁড়িয়ে। ঘোড়ার গাড়ির শব্দ, পাখির গান, বাড়ি ফেরার টান, রিকশার রিনধিন আওয়াজ শুনতে শুনতে তাঁর মনে হয়– ‘আমার মনের ভেতরে সময় সময় এই শহর এক অর্কেস্ট্রা হয়ে যায়।’ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, বিভিন্ন বইয়ে প্রকাশিত ঢাকা শহর নিয়ে লেখার সংকলন করে ‘প্রথমা’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে শামসুর রাহমানের ‘আমার ঢাকা’ বইটি।
শহর বড় তাড়াতাড়ি বদলাতে থাকে, নিমেষে চেনা গলি গোলকধাঁধা হয়ে যায়। বাড়ির মালিকানায় হাত বদল হলে বাড়িটাও চেনা লাগে না আর। পাড়ার মোড়ের গাছটা কাটা হয়ে গেলে দিকভ্রান্ত লাগে। একটা হাইরাইজ গোটা পাড়ার মনটাকেই বদলে দেয়। কয়েকটা মুদির দোকান, সাইকেল সারানোর দোকান, পাড়ার একা দর্জির দোকান পুরনো শহরটাকে কাঁধে নিয়ে বসে আছে শুধু। কেউ শহরটাকে খুঁজতে চাইলে ওরা ঠিকানা বলে দেয় মৃদুস্বরে। নিষ্ঠুর লাগে এই বদলে যাওয়া। কিছুতেই জমিয়ে বসতে দেয় না। তবুও শহরের সঙ্গে কীসের যে টান, কেন যে ছেড়ে যাওয়ার ভাবনা আসতেই বুকে নদী ঢেউ তোলে, কে জানে! আমরা শেষমেশ শহরটাকে রেখে দিই নিজের কাছে, মাঝেসাঝে ফাঁক পেলে অপলক তাকিয়ে থাকা।
শামসুর রাহমান তাঁর ঢাকা শহরটাকে মনে রেখেছিলেন শব্দ দিয়ে। চোখ বন্ধ করলেও ঢাকা শহরের শব্দ শুনতে পেতেন, প্রাণের শহরটা সামনে এসে দাঁড়াত যেন। বদলে যাওয়া ঝাঁ-চকচকে ব্যস্তসমস্ত শহরের মাঝে তিনি চোখ বুজে দাঁড়িয়ে। ঘোড়ার গাড়ির শব্দ, পাখির গান, বাড়ি ফেরার টান, রিকশার রিনধিন আওয়াজ শুনতে শুনতে তাঁর মনে হয়– ‘আমার মনের ভেতরে সময় সময় এই শহর এক অর্কেস্ট্রা হয়ে যায়।’
শামসুর রাহমানের কাছে ঢাকা শহরটাই একটা গোটা পৃথিবী। এর বাইরে নেই কোনও রতন। যা কিছু অমূল্য, তা এখানে, এখানেই। শহরটাকে কেন্দ্রে রেখে কত না লেখা, কত না বেদনা, কতই না আহ্লাদ তাঁর। ‘এ শহর ছেড়ে পৃথিবীর অন্য কোনো শহরে বেশি দিন থাকতে পারব না’– বলতে কোনও দ্বিধা নেই তাঁর। চোখের সামনে শহরটা বদলে যেতে থাকে, আধুনিকতা ভালো লাগে না, কিন্তু নিউ মার্কেটে ঘুরে ঘুরে বই কেনা, পুরনো বইয়ের সন্ধান, রবীন্দ্র রচনাবলি কেনার সিদ্ধান্ত, বুদ্ধদেব বসুর রমনা আর পুরানা পল্টনের খোঁজ, আহসান মঞ্জিল, বায়তুল মসজিদের উত্তর গেট, মধুরদাক ক্যান্টিনের চারদিক খোলা আড্ডা– সবই তো এই শহরের আনাচেকানাচেই। তবুও কেন অচেনা হল এই শহর, কী দরকার ছিল শহরটার আড়ে-বহরে বেড়ে যাওয়ার? অভিমানে উল্টোপথ ধরেন তিনি, হঠাৎ মনে হয়, ‘যে পথে আমি হেঁটেছি, বসেছি যে লতাগুল্মময় জায়গায়, সেখানে হয়তো এখন জ্যোৎস্না টলমল করছে।’ আবারও ফিরে তাকান শহরের দিকে। আর পাঠকেরও তার প্রিয় শহরটার কথা মনে পড়ে যায়।
এই শহরের বুকেই তো তিনি স্বাধীনতাকে চিনেছিলেন। ১৬ ডিসেম্বরের আগের দিনগুলো মনে করছেন তিনি। কাম্যুর ‘প্লেগ’ উপন্যাসের মতো মনে হচ্ছিল ঢাকা শহরটাকে। বীজাণু ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। শহর থেকে বেরনোর সব পথ বন্ধ। অনেকেই পালিয়ে গিয়েছিলেন শহর থেকে। তবুও কবি পালালনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এই শহরেই থাকবেন। শেষ অবধি থাকবেন। বাইরে চলছে খুন-খারাপি, গোলা-বন্দুক। ১৫ ডিসেম্বর খবর রটল কবি যে-পাড়াতে থাকতেন, সে পাড়াতেই পাক সেনারা আসছে। পাড়ার সবাই সিদ্ধান্ত নিল যে যা হাতের কাছে পাবে, তা নিয়ে ছাদে উঠে যাবে। সেখান থেকেই পাক সেনাদের সঙ্গে লড়তে হবে। কবিও লাঠি হাতে উঠে গিয়েছিলেন ছাদে। কিন্তু সে রাতে পাক সেনা আসেনি। পরদিনও ঘুম ভেঙেছে আতঙ্কের সঙ্গে, কিন্তু বিকেল গড়াতেই পাড়ায় শোনা গেল ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি। সেদিন থেকে কবি ও স্বাধীনতা পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে শহরজুড়ে। শহরের আলোটা তাঁর চোখে নতুন লাগছিল। নিজেকে প্রশ্ন করছেন, তাহলে কি এতদিন চোখ বুজে ছিলেন?
তবুও এই শহরের মধ্যযুগীয় অন্ধকার তিনি দেখতে পান। বায়তুল মসজিদের উত্তর গেট মৌলবাদীদের হাতে। তিনি বলছেন, ‘আমি চাই ঢাকা হোক আমার সুন্দর আমার সুন্দর স্বপ্নের শহর, মুক্তিচিন্তার শহর, শিল্প-সংস্কৃতির অব্যাহত বিকাশের শহর, সৃজনশীল, প্রগতিশীল মানুষের শহর।’ কলকাতারও কি এই চাহিদাই নয়?
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আরও পড়ুন: বৃষ্টি নামলে এ-কলকাতায় আত্মহত্যা কমে যায়
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রশীদ করীম শামসুর রাহমান সম্পর্কে লিখেছিলেন, ‘শামসুর রাহমানের কবিতায় তাঁর পলেস্তারা খসা ঘর ও সংকীর্ণ উঠোন বারবার ঘুরে ফিরে আসে।’ এই উঠোন থেকেই শুরু হয় তাঁর শহর ভ্রমণ। একদিন ঘুম থেকে উঠে দেখেন তাঁর উঠোনে পাঁচজন অতিথি। শিবনারায়ণ রায়, অমলেন্দু বসু, নরেশ গুহ, জিল্লুর রহমান, সিদ্দিকী এবং রশীদ করীম। আড্ডা জমে উঠলে ঠিক করলেন রাস্তায় হাঁটতে বেরবেন। হাঁটতে হাঁটতে ছ’জন এসে পৌঁছলেন অমলেন্দু বসুর পুরনো বাড়িতে। তার পাশেই ছিল অজিত দত্ত-র বাড়ি। এই পথেই কতদিন হেঁটে বেড়িয়েছেন বুদ্ধদেব বসু, অমলেন্দু বসু ও অজিত দত্ত। নিজের পুরনো বাড়িটা দেখতে দেখতে এসব কথাই বলছিলেন অমলেন্দু বসু। কবি বলছেন, সেই সময় অমলেন্দু বসুকে শিশুর মতো মনে হচ্ছিল। হাঁটতে হাঁটতে এবার তাঁরা পৌঁছলেন আহসান মঞ্জিল। নবাবি এই বাড়ির দুর্দশা দেখে আহত হয়ে পড়লেন। আলোচনা শুরু করলেন নবাবের পরিবারের কি কেউ আর নেই এই বাড়ি দেখভাল করার জন্য? অদূরেই এক সুদর্শন যুবক দাঁড়িয়ে ছিলেন, তাঁকেই জিজ্ঞেস করলেন নবাবের পরিবারের কথা। জানা গেল, সেই সুদর্শন পুরুষটিই নবাবের বংশধর। স্মৃতিকাতর, সমকালের যন্ত্রণায় কাতর ছ’জন মানুষ শহরের পথে লক্ষ্যহীন ঘুরে বেড়ালে শহর নিজে এসেই ধরা দেয়। সেদিন নরেশ গুহ রাস্তা থেকে কাঁচা আম কিনলেন, শিবনারায়ণ রায় শঙ্খচূড়। ইসলামপুরের পথে একটি কিশোর হাতে কয়েকটা আম নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল, রশীদ করীম সেই কিশোরের থেকে একটা আম চেয়ে নিলেন। শিবনারায়ণ রায় সেদিন পথচারীকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁদের ছবি তুলে দেওয়ার জন্য। কবি এই দিনটিকে বর্ণনা করেছেন– ‘সেই দুপুর আমাদের সঙ্গে মোহন খেলা জুড়ে দিয়েছিল মনে হয়। আমরা সবাই বদলে গিয়েছিলাম কয়েক ঘণ্টার জন্য।’ কবি লেখাটি শেষ করছেন– ‘ডক্টর অমলেন্দু বসু ও ডক্টর নরেশ গুহ এখন ঢাকায় নেই। ওঁরা দুজনেই এখন কলকাতায়। প্রফেসর শিবনারায়ণ রায় আজ ঢাকা ছেড়ে চলে যাবেন। ঢাকায় থাকবেন রশীদ করীম ও জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী। থাকব আমিও। অনেক কিছুই ভুলে যাব, কিন্তু রবিবারের সেই দুরন্ত দুপুরটির কথা চিরদিন মনে থাকবে।’
বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, বিভিন্ন বইয়ে প্রকাশিত ঢাকা শহর নিয়ে লেখার সংকলন করে ‘প্রথমা’ থেকে প্রকাশিত হয়েছে শামসুর রাহমানের ‘আমার ঢাকা’ বইটি। সংকলন ও সম্পাদনা করেছেন পিয়াস মজিদ। ঢাকা শহরের সঙ্গে প্রেম হয়েছিল যে যুবক কবির, সেই কবি আজ নেই, সেই ঢাকা আজ নেই। তবুও কবির অভিমান, আহ্লাদ রয়ে গেল আমাদের সঙ্গে এই বইটির দৌলতে। সম্পাদককে ধন্যবাদ এই বইটি উপহার দেওয়ার জন্য।
আমার ঢাকা
লেখক: শামসুর রাহমান
সংকলন ও সম্পাদনা: পিয়াস মজিদ
প্রথমা। মূল্য ৩০০