ছ’টি প্রবন্ধে উনিশ শতকের বাংলাকে ধরতে চেয়েছেন শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়। ওই অগ্রাহ্য করা আর স্বীকৃতি দেওয়ার দ্বন্দ্বের মাঝে পক্ষ নিয়েছে ‘বাংলার রেনেসাঁস: বোঝা না ভেলা?’ প্রবন্ধটি। খতিয়ে দেখতে চেয়েছেন, সেই সময়েই বাংলায় একাধিক দ্যুতিমান মনীষা উঠে আসছেন কীভাবে, এহেন উত্তুঙ্গ মননশীল ও সৃজনশীল প্রতিভার উত্থানের নেপথ্যে কি রয়েছে নির্দিষ্ট কার্যকারণ দিয়ে গাঁথা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতই?
বণিকের মানদণ্ড রাতারাতি বদলে গিয়েছে রাজদণ্ডে। আর সেইসঙ্গে সমাজ জুড়েই চলছে এক ভোলবদলের পালা। এক বিপুল লুটের অধ্যায়ের মাঝে দাঁড়িয়ে দিশাহারা সকলে। তার মধ্যেই কোথাও কোথাও জ্বলে উঠছে বিদ্রোহের আগুন। দেশজুড়ে যখন এমনই উথালপাতাল, সেই সময় বাংলার ছবিটা ঠিক কেমন? দেখা যাচ্ছে, সামাজিক বদলের সঙ্গে সঙ্গে সেই সময়ে তাকে বুঝে নিতে হচ্ছে এক আমূল সাংস্কৃতিক বদলকেও। কলকাতার বুকে নতুন শাসকের রাজধানী গড়ে ওঠায় সেই বাংলা শাসকের সভ্যতা ও সংস্কৃতির সবচেয়ে সামীপ্য পেয়েছে। তার ফলেই, এতদিনকার সঞ্চিত অভ্যাসের ওপর এসে পড়েছে এক নতুন আলোর রেখা। পুরনো আর নতুনের সংস্পর্শে বা সংঘাতে ভাঙাগড়া চলছে ভিতরে ভিতরে। উনিশ শতকের সেই ভাঙাগড়ার অধ্যায়কেই নাম দেওয়া হয়েছে ‘নবজাগরণ’ বা ‘রেনেসাঁস’।
আরও পাতাবাহার: বেড়াতে গিয়ে পাইপয়সার হিসেব করে চলার পাবলিক আর যাই হোক, ‘বাঙাল’ নয়
কিন্তু প্রশ্ন হল, রেনেসাঁস বলতে যে বিপুল বদলে যাওয়াকে চিহ্নিত করে ইতিহাস, তেমন কোনও সামগ্রিক ও সামূহিক বদলের সাক্ষী কি সে সময়ে হয়েছিল বাংলা? এই সময়পর্বকে রেনেসাঁস আখ্যা দেওয়া ঠিক কতটা যুক্তিযুক্ত? এ নিয়ে বিদ্বৎমহলে প্রশ্নোত্তর চলতেই থেকেছে। ‘আধুনিক বঙ্গসংস্কৃতির তেপান্তর’ বইয়ে সেই প্রশ্নগুলিকেই ফের উলটেপালটে দেখে নিতে চেয়েছেন শক্তিসাধন মুখোপাধ্যায়। যদিও তাঁর মূল প্রবণতাটি ইতিবাচকতার দিকেই ঝুঁকে থেকেছে, অর্থাৎ রেনেসাঁস-লক্ষণের থেকে এই অধ্যায় কোথায় পিছিয়ে পড়েছে– সেদিকে না গিয়ে তিনি খুঁজে দেখতে চেয়েছেন সেই বদলের কার্যকারিতাগুলোকে। উনিশ শতকীয় সাংস্কৃতিক বিচ্ছুরণকে নাকচ করায় যে তাঁর মত নেই, সেকথা তিনি ভূমিকাতেই স্পষ্ট করে দিয়েছেন। আর সেই মতামতের আলোতেই জারিত হয়েছে বইটি।
ছ’টি প্রবন্ধে উনিশ শতকের বাংলাকে ধরতে চেয়েছেন শক্তিসাধন। ওই অগ্রাহ্য করা আর স্বীকৃতি দেওয়ার দ্বন্দ্বের মাঝে পক্ষ নিয়েছে ‘বাংলার রেনেসাঁস: বোঝা না ভেলা?’ প্রবন্ধটি। খতিয়ে দেখতে চেয়েছেন, সেই সময়েই বাংলায় একাধিক দ্যুতিমান মনীষা উঠে আসছেন কীভাবে, এহেন উত্তুঙ্গ মননশীল ও সৃজনশীল প্রতিভার উত্থানের নেপথ্যে কি রয়েছে নির্দিষ্ট কার্যকারণ দিয়ে গাঁথা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষিতই? তাহলে কি এমন কিছু সাংস্কৃতিক সম্পদ সে সময়ে উৎপন্ন হয়েছিল, যা বাংলাকে সমৃদ্ধ করেছিল? ঔপনিবেশিক শাসনে থাকা একটি জাতির কাছে সেই সাংস্কৃতিক বিচ্ছুরণের তাৎপর্যই বা কী? সেই উত্থান কি নিছক ঔপনিবেশিক আধিপত্যবাদের দাসত্ব থেকেই উদ্ভূত, না কি এর মধ্যে রয়ে গেল কোনও আত্মপ্রতিষ্ঠার বয়ানও– তা খতিয়ে দেখতে চেয়েছেন প্রাবন্ধিক। আর বাংলার গণ্ডি পেরিয়ে, দেশের অভ্যন্তরে ও বহির্বিশ্বে এই সময়পর্ব কোনও পৃথক অভিঘাত রেখে গেল কি না, দ্বিতীয় প্রবন্ধ ‘রেনেসাঁস: আন্তর্জাতীয়তা ও জাতীয়তা’ সে উত্তর খুঁজেছে।
আরও পাতাবাহার: নিজেকে ব্যঙ্গ করে পাঠককে প্যাঁচে ফেলা
উনিশ শতকের বঙ্গীয় জাগরণের সঙ্গে মুসলমান সমাজের সম্পর্ক ঠিক কোন বিন্দুতে দাঁড়িয়ে ছিল, তা নিয়ে কথা হয়েছে এর আগেও। বস্তুত, বিজিতের পক্ষে বিজয়ীর থেকে আলোর ঋণ নেওয়া সহজ নয়। উনিশ শতকের সাহিত্য-সংস্কৃতি-নাট্যচর্চার জগৎ থেকে অনেক সময়েই তাই মুসলমান সম্প্রদায়ের এক বড় অংশকে সরে থাকতে দেখা গিয়েছে। এই পরিস্থিতি নিয়ে দোষারোপের ঝড় না তুলে সমস্যাটিকে ভেতর থেকে পর্যালোচনা করার প্রয়াস নিয়েছেন এ বইয়ের লেখক, যা ঠাঁই পেয়েছে ‘রেনেসাঁস ও বাংলার মুসলমান সমাজ’ নিবন্ধে। ‘বাংলার রেনেসাঁস ও বঙ্গভঙ্গ’ প্রবন্ধে আবার আরেক ভাঙনকে ছুঁয়ে দেখেছেন তিনি।
‘চল্লিশের দশক: অন্য এক রেনেসাঁস’ নিবন্ধে উঠে এসেছে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের কথা, যা কালপর্বের নিরিখে রেনেসাঁসকে পিছনে ফেলে এসেছে। কিন্তু বিশ শতকের চারের দশকে মার্কসবাদী চেতনার সংস্পর্শে যে নতুন ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল, বঙ্গসংস্কৃতিতে তার মাত্রা অস্বীকার করা চলে না। সেই সময়কেও একরকমের নবজাগরণ বলা চলে কি না, তা খতিয়ে দেখেছে এই প্রবন্ধটি। আর পরবর্তী কালে এই মার্কসবাদের চর্চা ও বুর্জোয়া লিবারালিজম প্রসূত মানবতাবাদের চেতনা– এই দুয়ের ধারা কীভাবে সমান্তরালে বয়ে গিয়েছে বঙ্গসংস্কৃতিতে, তা বিশ্লেষণ করেছে ‘আধুনিক বঙ্গসংস্কৃতির তিন ভুবন’ প্রবন্ধটি। সব মিলিয়ে, উনিশ শতকের বাংলার এই পট-পরিবর্তনকে বুঝে নিতে এই বইটি যে খানিক সহায়ক হবে, তা বলাই যায়।