প্রায় সাড়ে তিনশো পাতার উপন্যাসটি শুরুই হয় খুব অদ্ভুত ভাবে। ‘কঁকিয়ে উঠলেন। ছেঁড়া-ফাটা কাঁথা কাপড়ের পোঁটলা-পুঁটুলির ভেতর থেকে শব্দটা বেরোল!’ এই আখ্যান রোহিঙ্গাদের নিয়ে। আরাকান পাহাড় থেকে মায়ানমার সেনার জুলুমে উৎখাত হওয়া এক পরিবার যে কাহিনির নিউক্লিয়াস। কোনও প্রস্তাবনা ছাড়াই এই উপন্যাস শুরুতেই বৃদ্ধ জাফর আলির গোঙানির মুখে ফেলে দেয় পাঠককে।
দ্রুত বদলাতে থাকা এই সময়ে উপন্যাস কি তার চেনা চেহারাগুলির মধ্যেই ঘোরাফেরা করবে? নাকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সে নিজেকে নতুন এক আয়নার সামনে মেলে ধরবে? এই প্রশ্ন ক্রমেই জোরালো হচ্ছে। বিংশ শতাব্দীর তুলনায় গত দুই দশকে দুনিয়া এতটাই পালটেছে যে, এখন কাহিনিকেও হয়ে উঠতে হবে অন্যতর পথের পথিক। পাঠকের থেকে উঁচুতে নয়, বরং পাঠকের হাত ধরেই এগিয়ে চলতে হবে লেখককে। সৌরভ হোসেনের উপন্যাস ‘নেই দেশের নাগরিক’ পড়তে শুরু করলে একথা মনে হবেই। প্রায় সাড়ে তিনশো পাতার উপন্যাসটি শুরুই হয় খুব অদ্ভুত ভাবে। ‘কঁকিয়ে উঠলেন। ছেঁড়া-ফাটা কাঁথা কাপড়ের পোঁটলা-পুঁটুলির ভেতর থেকে শব্দটা বেরোল!’ এই আখ্যান রোহিঙ্গাদের নিয়ে। আরাকান পাহাড় থেকে মায়ানমার সেনার জুলুমে উৎখাত হওয়া এক পরিবার যে কাহিনির নিউক্লিয়াস। কোনও প্রস্তাবনা ছাড়াই এই উপন্যাস শুরুতেই বৃদ্ধ জাফর আলির গোঙানির মুখে ফেলে দেয় পাঠককে। আর তখনই নাফ নদীর জলে ভেসে চলা শরণার্থী পরিবারটির নৌকোয় লেখকের হাত ধরে উঠে পড়েন পাঠক।
বড় উপন্যাসের শুরুতে একটা ঢিমে তালই যেন প্রত্যাশিত। ঔপন্যাসিক ধীরেসুস্থে কাহিনির গিঁট খুলবেন। কিন্তু তরুণ লেখক সৌরভ সেই পথে তো হাঁটলেনই না, বরং এমনভাবে তা শুরু করলেন, যেন পাঠক অনেকক্ষণ এই কাহিনির সঙ্গে রয়েছেন। এভাবেই পাঠককে সঙ্গে নিয়ে নাফ নদীতে ভেসে পড়েন তিনি। ভেসে পড়ে কাহিনিও। আজকের বাঙালি লেখকরা আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে উপন্যাস লেখেন কি না, এই খোঁজ বহু পাঠকের। তাঁরা এই উপন্যাস হাতে নিলে চমকে উঠবেন। রোহিঙ্গা সমস্যা এই সময়ের এক জ্বলন্ত ইস্যু। সেই বিষয়কেই উপন্যাসের বিষয় করেছেন সৌরভ। জাফর আলির পরিবার আরও অসংখ্য রোহিঙ্গা পরিবারের মতোই খুঁজছে আশ্রয়। মায়ানমার থেকে বিতাড়িত তারা। রাষ্ট্রের চোখরাঙানিতে হারিয়ে গিয়েছে দেশ! নাফ নদীতেই তাই বুঝি গড়ে উঠছে এক নৌকা কলোনি। অসংখ্য নৌকা ছুটে চলেছে আশ্রয়ের খোঁজে। কিন্তু আশ্রয় কই?
জাফর আলি ও তাঁর স্ত্রী হালেমা বিবি। তাঁদের দুই পুত্র নুহু আর মতি। মতির স্ত্রী আরফা। তাদের একরত্তি সন্তান। এবং নুহু। সে অবশ্য একাই। তার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে খুন করা হয়েছে। সন্তানও মারা গিয়েছে। এই কয়েকজন মানুষ ভেসে চলেছে নৌকায়। ‘জলের ওপর ঠেস মেরে বসে আছে ঘুটঘুটে আঁধার। হালেমা ভাবেন, ‘এ আঁধার নয়, এ হল আজরাইলের ছায়া।’ নিশ্চিন্ত মধ্যবিত্ত জীবনের ঘেরাটোপ থেকে এই জীবনগুলির দিকে দেখলে শিউরে উঠতেই হয়। খবরের প্রতিবেদনে যে সামগ্রিক ছবি ধরা পড়ে, সেখানে রোহিঙ্গা সমস্যাকে এভাবে চিরে চিরে দেখার সুযোগ নেই। সাহিত্যের প্রিজমেই তাদের বহুবর্ণ দুঃখ-কষ্ট ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ হয়ে ধরা পড়ে। মৃত জাফর আলিকে কবর দিতে হবে। কিন্তু মাটি কই? দেশহারা মানুষের কাছে রয়ে গিয়েছে শুধু বোবা জল। এই অসামান্য কষ্টের মুখে হতভম্ব হয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় কী।
উপন্যাসের আরেক চরিত্র আতিফ। নুহু-মতির সহোদর হয়েও সে অন্যপথে হাঁটাই বেছে নিয়েছে। সে মুজাহিদ। স্বাধীন ‘রাখাইন রাষ্ট্র’ গড়তে মায়ানমার সেনার চোখে চোখ রাখতে সন্ত্রাসের পথই তার কাছে প্রকৃত পথ। সে মেধাবী পড়ুয়া ছিল। ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছিল। কিন্তু রাষ্ট্রের নিপীড়ন রুখতে সে হয়ে উঠল ‘কোনও দুপেয়ে মানুষ নয়, একটা ছটফট করতে থাকা জ্বলন্ত গোলা, ছুটে পড়তে পারলেই শান্তি।’ একদিকে অসহায়তা। অন্যদিকে জেহাদ। এগিয়ে চলে আখ্যান।
এই উপন্যাসের চরিত্রটা সেই অর্থে আমাদের চেনা জগতের বাসিন্দা নন। তাঁদের সংকটও অনেক দূরবর্তী যেন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? এই নতুন শতাব্দীতে শরণার্থী সমস্যা সারা পৃথিবীকেই গ্রাস করছে নতুন করে। উপনিবেশ-উত্তর শিল্প-সাহিত্যে বারবার ফিরে এসেছে যে সমস্যা, তা ফের লিখিত হচ্ছে নয়া সহস্রাব্দে এসেও। ‘পোকা-মাকড়েরও দেশ আছে রে মা, আমাদের যে তাও নেই’, এই উচ্চারণ কেবল হালেমা বিবির নয়। দেশ বুকের মধ্যে থাকে। তাকে কেউ কাড়তে পারে না। কিন্তু রাষ্ট্র একটা যন্ত্র। সে চাইলেই পারে নিজস্ব ভূমিখণ্ড থেকে বিযুক্ত করে দিতে। মায়ানমারের ওই কয়েকজন মানুষ এভাবেই সারা বিশ্বের উদ্বাস্তুদের প্রতিনিধি হয়ে ওঠে।
দীর্ঘ এই উপন্যাসের চলন সব জায়গায় মসৃণ নয়। গদ্যের ভাষা কোথাও কোথাও একটু যেন আড়ষ্ট। আবার কখনও সংলাপের চাবুক কিংবা লেখকের ন্যারেটিভ চাবুকের মতো ঝলসে ওঠে। উপন্যাস যেভাবে শেষ হয়, বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে। বইটির প্রচ্ছদ সুন্দর। নৌকার সিলুয়েট, উপরে আকাশে বিপুল কালো মেঘের চলনের ভিতরে উপন্যাসের সবটাই ধরা রয়েছে। সেই মেঘ, সেই অন্ধকার নদীর আবহ পাঠকের সঙ্গী হয়ে পড়ে। নতুন করে রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্ক নিয়ে নানা প্রশ্ন জাগতে থাকে। যে প্রশ্নগুলো হয়তো সহজ, উত্তরও আসলে জানাই। তবু তাকে অন্বেষণ করে যেতেই হয়।
নেই দেশের নাগরিক
সৌরভ হোসেন
কেতাব ই। ৫২৫ টাকা।
A Unit of: Sangbad Pratidin Digital Private Limited. All rights reserved