সভ্যতার সংকটকালে রূপকথা এক উত্তরণের আশা জাগিয়ে তোলে, এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সে সংকটেরও কিন্তু নানা মাত্রা। তা যেমন মানুষের গড়ে তোলা সাংস্কৃতিক সভ্যতার সংকট, তেমনই তা প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা সমগ্র মানবসভ্যতার অস্তিত্বের সংকটও বটে। মানুষেরই কৃতকর্মের জেরে প্রকৃতি ও প্রাণীজগৎ যখন সংকটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, তখন সেই সংকটে শুশ্রূষা বুলিয়ে দেওয়ার বার্তা দিতে পারে রূপকথা। বিশেষ করে এই জাপানি রূপকথাগুলি সে উদ্দেশ্যকে ধারণ করে আছে সর্বতোভাবেই। আর অন্যতর যে সংকট?
আকাশ থেকে নেমে আসা আচমকা বোমায় যে দেশের স্বপ্ন ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়, সে দেশও কি স্বপ্ন দ্যাখে না আর? অন্ধকার সময় এলেই কি গান থেমে যায়, নাকি তখনও গান বয়ে চলে গোপনে? সে গান তো কেবল অন্ধকার সময়ের গানই নয়। অন্ধকারকে চিনে তার গর্ভ থেকে আলো ফোটানোর স্বপ্ন দ্যাখে সে গান। স্বপ্ন দেখায়ও। জাপানের রূপকথার মধ্যে বুঝি সে গান বোনা থাকে। না, এসব রূপকথা বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের কি না, হিরোশিমা-নাগাসাকি পেরিয়ে আসা কালের ফসল কি না, সে কথা জানা নেই। রূপকথার গায়ে তো আর ইতিহাসের সাল তারিখ লেখা থাকে না। কিন্তু সময়ের এই রংবদল তো সব যুগে, সব দেশেই অল্পবিস্তর ঘটতেই থাকে। রবীন্দ্রনাথ যেমন বলেন, মনের রূপকথায় দেশ কাল জুড়ে যাবে, সময়ের ভাগাভাগি আর কাছে-দূরের সীমানা মুছে গিয়ে তৈরি হবে সমগ্র এক সত্তা। আসলে সব দেশে-কালেই দ্বন্দ্ব ঘনিয়ে আসা যেমন চিরন্তন, তেমনই সে কুয়াশা থেকে উত্তরণের স্বপ্নও বরাবরের সত্যি। সত্যি আর রূপকথা, আসলে একই মানুষের দুটো গল্প। তাই ‘পাতালপুরীর রাজকন্যা’ একগুচ্ছ জাপানি রূপকথার বঙ্গানুবাদ হয়েও কেবল সে দেশের চৌহদ্দিতে নিজেকে বেঁধে রাখেনি। জাপানের স্বাদ গন্ধ ধরে রেখেও তার বাঙালি পাঠকের নিজের হয়ে উঠতে বাধা নেই। ভালো-মন্দ আর আলোয়-কালোয় মেলানো এই গল্পের ঝুড়িকে তেমন করেই ভাষান্তরে সাজিয়েছেন সুচিক্কণ দাস। ‘সারস রাজকন্যা’ কিংবা ‘জিভকাটা চড়াইয়ের কাহিনি’ কিংবা ‘পালকের পোশাক ও চাঁদের পরী’-র মতো গল্পের পাতা ওলটালে তাই ‘ঠাকুরমার ঝুলি’ বা টুনটুনির গল্পদের স্মৃতি ভেসে আসে। আসলে রূপকথার মধ্যে তো এমনই এক বেঁধে থাকার আলগা সুতো থাকে। ওই দেশ-কাল জুড়ে যাওয়ার সেতু সে যেমন গড়ে তুলতে পারে, তেমনই মানুষ আর না-মানুষ, মানুষ আর প্রকৃতিকেও বেঁধে বেঁধে থাকার ফুসমন্তর দিতে পারে সে। যেমনটা দিয়েছে ‘সামুরাই ও সবুজ উইলো’ বা ‘অরণ্যে এক সামুরাই’-এর মতো গল্প।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন রাধামাধব মণ্ডলের লেখা: গ্রামীণ মেয়েদের গ্রীষ্মদুপুরের আড্ডা কি চিরতরে হারিয়েছে?
…………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
সভ্যতার সংকটকালে রূপকথা এক উত্তরণের আশা জাগিয়ে তোলে, এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে সে সংকটেরও কিন্তু নানা মাত্রা। তা যেমন মানুষের গড়ে তোলা সাংস্কৃতিক সভ্যতার সংকট, তেমনই তা প্রকৃতির কোলে গড়ে ওঠা সমগ্র মানবসভ্যতার অস্তিত্বের সংকটও বটে। মানুষেরই কৃতকর্মের জেরে প্রকৃতি ও প্রাণীজগৎ যখন সংকটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে, তখন সেই সংকটে শুশ্রূষা বুলিয়ে দেওয়ার বার্তা দিতে পারে রূপকথা। বিশেষ করে এই জাপানি রূপকথাগুলি সে উদ্দেশ্যকে ধারণ করে আছে সর্বতোভাবেই। আর অন্যতর যে সংকট? সেখানে বলতে হয়, সাদা আর কালো দু’রঙের পরিপাটি সীমানা পৃথিবী বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি কোনও দিনই। তাই তার গা বেয়ে নেমে আসে ধূসর রং। রাজনীতির ঝড়ঝাপটা সামলে যেই না মানুষেরা তাদের একচিলতে জীবনটাকে একটু সাজাতে চেয়েছে, অমনি তাতে বাদ সেধেছে তার ভারাক্রান্ত রোজনামচার ব্যর্থতা। সে মানুষের মুখে মুখে ফেরা রূপকথা তাই কেবল ফুল আর তারার গল্প বলে না, তা মানুষের নিজের মধ্যেকার এই স্বপ্ন আর দীনতার নিরন্তর দোটানায় জেরবার হয়ে থাকার বয়ানও লিখে রাখে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পড়ুন সৃজা মণ্ডলের লেখা: যেসব জীবন জড়িয়ে রয়েছে মহুয়া গাছের ফুলে-বাকলে
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
রূপকথার উদ্দিষ্ট শ্রোতা বলতে শিশুদের কথাই ধরলেও, আদতে রূপকথা ছদ্মবেশের মোড়কে সেইসব স্বপ্ন আর স্বপ্নভাঙার ডায়েরি, যে স্বপ্নে সব মানুষের অধিকার। পচাগলা জীবনের মিথ্যে কাঠামোটা বয়ে বেড়াতে থাকা যে মানুষেরা নিজেদের ওপর নিষ্ঠুর হতে শিখে গিয়েছে, তারা সেই পেরিস্তানের খোঁজ ভুলে যায়। তারা রোজকার তেতেপুড়ে ওঠা জীবনের সত্যিটাকেই চেনে কেবল। কিন্তু জগতে তো দু’রকম পদার্থ আছে, এক হচ্ছে সত্য, আর হচ্ছে আরও-সত্য; এ কথাও সেই রবিঠাকুরেরই বলা। আর সেই দু’রকমের সত্যির মাঝের ফাটলটায় সাদামাটা কেজো আর কর্কশ যাপনের গল্প জমে ওঠে। দু’রকমের সত্যি থেকেই রং চুরি করে তার ধূসর রঙের মধ্যে ঝিলিক দিয়ে ওঠে সাতরঙা রামধনু, যার নাম রূপকথা। সে রূপকথা কখনও কখনও একা একজনের, আবার কখনও সেই রূপকথা কোনও একটা গোটা সময়ের, কখনও বা গোটা দেশ কিংবা এক পৃথিবীর। রূপকথা সেই পৃথিবীর সত্যকে অস্বীকার করতে চায় না, বরং চিরযৌবনের দেশ থেকেও মানবতার টানে মানুষকে ফিরিয়ে আনে ধুলোমাটির পৃথিবীতে। মনে করিয়ে দেয়, ‘রক্ত মাংসে গড়া সব মানুষকে পৃথিবীতেই ফিরতে হয়। কারণ অনন্ত যৌবন নয়, মৃত্যুর মধ্যে দিয়েই মানুষ অমৃতলোকের সন্ধান পায়।’ রূপকথা যে আসলে বাস্তব থেকে নিছক পালানোর সুড়ঙ্গ খোঁড়ে না, বরং বাস্তবের সঙ্গে লুকোচুরি খেলে তার অমোঘ অনিবার্যতাকে সয়ে নেওয়ার শুশ্রূষা দেয় কেবল; এ বই যেন সে কথাই মনে করিয়ে দিল নতুন করে।
পাতালপুরের রাজকন্যা
একগুচ্ছ জাপানি রূপকথা
ভাষান্তর: সুচিক্কণ দাস
মান্দাস
২৫০