‘বহুরূপী যাপন’ যেন সেদিনের যুবকের সঙ্গে আজকের ক্ষমাসুন্দর অধ্যাপক বসুর দীর্ঘ আড্ডা। তাতে ঘড়ির কাঁটা যখন-তখন গন্ডগোল করে বসে। তাঁর তো ইতিহাস লেখার দায় নেই। গল্পের স্রোত নিজের মতো করে পথ খুঁজে নেয়। আবার সুনিপুণ নির্দেশকের মতো সৌমিত্র বসু তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন ক্লাইম্যাক্সের আগে। যাঁরা সৌমিত্র বসুর ক্লাস বা আলোচনা শুনেছেন, তাঁরা আন্দাজ করতে পারবেন এই বাচন।
বহুরূপীর মহলাকক্ষ। রিহার্সাল চলছে ‘পুতুলখেলা’র সেই বিখ্যাত দৃশ্যের। বুলুর চরিত্রে তৃপ্তি মিত্র আবৃত্তি করছেন ‘ঝুলন’ কবিতা। উদ্দেশ্য তপনকে ভুলিয়ে রাখা। যে চরিত্র করছেন স্বয়ং শম্ভু মিত্র। একটা চাবির রিং ঘোরাতে ঘোরাতে তিনি শুনছেন সেই কবিতা। হঠাৎই আবৃত্তি থামিয়ে তৃপ্তি মিত্র জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি কি এটা করবে? আমার অসুবিধা হচ্ছে।’ শম্ভু মিত্রের উত্তর, ‘হ্যাঁ, এটা তো আমি রোজই করি।’ ব্যস, এটুকুই কথোপকথন। আবার শুরু হল মহলা। অথচ ১৯৭৮-এর এই ঘটনায় নাকি ব্যক্তিত্বের সংকট প্রকাশ পেয়েছিল ‘বিস্ফোরণের মতো। যার পরিণাম সুদূরপ্রসারী হয়ে উঠল প্রতিষ্ঠানের পক্ষে।’
তেমনটাই অন্তত দাবি স্বপন মজুমদারের ‘বহুরূপী’ গ্রন্থে। বাংলা থিয়েটারের দুই নক্ষত্রের মধ্যে ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব নিয়ে মন্তব্য করেছেন সুধী প্রধানরাও। কিন্তু ১৯৭৮-র ১০ জুন সেই রিহার্সালে উপস্থিত ছিলেন এক যুবক। বছর বাইশের তরুণের অভিজ্ঞতা একটু অন্যরকম। ‘বিস্ফোরণ’ জাতীয় কিছু হয়নি। মহলাকক্ষে ঝগড়া করার মতো অবিবেচক মানুষ বহুরূপীর দুই কর্ণধার নন। সেই বিখ্যাত ‘ডিসিপ্লিন’-এর নিগড় থেকে বেরিয়ে এসে বহুরূপী ভাঙনের বার্তা তাঁরা প্রকাশ্যে দিতে চাননি। তাহলে কীভাবে তৈরি হল এসব অকিঞ্চিৎ গল্পগুজব? সেদিনের সেই যুবক আজ প্রথিতযশা নাট্যকর্মী ও অধ্যাপক সৌমিত্র বসু। ‘বহুরূপী যাপন’ গ্রন্থে স্মৃতির পাতা উলটিয়ে কিছুটা বিস্ময় ঝরে পড়ে তাঁর কলমে।
না, তিনি কোনও সিদ্ধান্তে আসেননি। ‘বহুরূপী যাপন’ তাঁর কাছে দুই দশকের আত্মানুসন্ধানের ইতিহাস। যে সময়ে তিনি ছায়া পেয়েছেন শম্ভু মিত্র থেকে কুমার রায়ের, কালীপ্রসাদ ঘোষ থেকে তৃপ্তি মিত্রের। স্মৃতি নামক এক বিশ্বাসঘাতক বন্ধুর থেকে ধার করে নিয়ে আসা অসংখ্য অম্লমধুর গল্প। যেখানে কিশোর সৌমিত্র বসু অপেক্ষা করেন শম্ভু মিত্রের বাড়ির বাইরে। কখন আলগোছে হাওয়ায় দরজার পর্দা উড়লে দেখা মিলবে সেই ঋষিপ্রতিম মানুষটির। কিংবা যাঁর কণ্ঠস্বর শুনে মাথার মধ্যে গুলিয়ে যায় সমস্ত প্রশ্ন-উত্তর। আর একদিন তিনিই কিনা জিজ্ঞেস করে বসলেন সৌমিত্রকে, ‘তোমার কি পার্ট টার্ট কিছু জুটেছে?’
‘যদি আর একবার’ নাটকে ভূতের নাচ থেকে সোজা প্রমোশন মিলল ‘পাখি’র নীতু চরিত্রে। সেই যাত্রা থামল এসে ১৯৯৪ সালে, ‘আকবর বীরবল’ নাটক দিয়ে। ১৯৭৫ সালে বহুরূপীতে এসেছিলেন সৌমিত্র বসু। বয়স তখন মাত্র উনিশ। ‘বহুরূপী যাপন’ গ্রন্থ আসলে এক সদ্য কৈশোর পেরনো নাট্যপ্রেমীর প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ওঠার গল্প। যাঁর আত্মকথায় অনায়াসে জড়িয়ে পড়েন ওই নাট্যদলের বাইরের মানুষ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়রা। যিনি নায়ক হওয়ার উত্তেজনায় শাঁওলী মিত্রের ভাঙা হাতে আচমকা টান দিয়ে বসেন। আবার ‘রাজদর্শন’ নাটকের অভিনয়ে তাঁর পিঠে আলগোছে ছুঁয়ে যায় কুমার রায়ের প্রশংসাসূচক স্পর্শ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
যে অমর গঙ্গোপাধ্যায়ের বিছানার চাদর ভরে আঁকা থাকত বহুরূপীর মুখোশ, আজ তাঁর আচরণ ‘ছেলেমানুষি’ বলেই মনে হয়। আরও এক অন্যরকম ছেলেমানুষির গল্প আছে রমাপ্রসাদ বণিককে নিয়ে। কাছাকাছি সময়ে দুই বন্ধুর বহুরূপী যাপন শুরু হয়েছিল। রমাপ্রসাদের পথ থেমে গিয়েছে অনেক আগেই। আমাদের আপাত যত্নহীন থিয়েটারের ইতিহাসের উপাদানে কি আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাবা যায় না রমাপ্রসাদ বণিকের মতো প্রতিভাকে?
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আর আছে অসংখ্য ভুলভ্রান্তি। কিংবা বলা ভালো শিখতে শিখতে যাওয়ার ইতিহাস। সৌমিত্র বসু অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে স্বীকার করে নেন থিয়েটার জীবনের একাধিক ভুলের দায়। সাধারণত অতীতের দিকে ঘুরলে আতশকাচ সঙ্গী হয়ে যায়। নিজের কর্তব্যকে সামান্য আড়ালে রেখে পরচর্চার মূকাভিনয় মুখ্য হয়ে ওঠার প্রবণতা চোখে পড়ে। কিন্তু ‘বহুরূপী যাপন’ যেন সেদিনের যুবকের সঙ্গে আজকের ক্ষমাসুন্দর অধ্যাপক বসুর দীর্ঘ আড্ডা। তাতে ঘড়ির কাঁটা যখন-তখন গন্ডগোল করে বসে। তাঁর তো ইতিহাস লেখার দায় নেই। গল্পের স্রোত নিজের মতো করে পথ খুঁজে নেয়। আবার সুনিপুণ নির্দেশকের মতো সৌমিত্র বসু তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন ক্লাইম্যাক্সের আগে। যাঁরা সৌমিত্র বসুর ক্লাস বা আলোচনা শুনেছেন, তাঁরা আন্দাজ করতে পারবেন এই বাচন।
এটাও একটা অর্জন এই গ্রন্থের। কোনও তির্যকতার আশ্রয় নেই এখানে। তিনি অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন অনুজ সহ-অভিনেতা দেবেশ রায়চৌধুরীর। যিনি পরবর্তীতে বহুরূপীর দায়িত্ব সামলেছেন। আবার অত্যন্ত সাবধানে বলেন বহুরূপীর অন্যতম প্রাণপুরুষ অমর গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে তীব্র অসন্তোষের কথা। কিন্তু যে অমর গঙ্গোপাধ্যায়ের বিছানার চাদর ভরে আঁকা থাকত বহুরূপীর মুখোশ, আজ তাঁর আচরণ ‘ছেলেমানুষি’ বলেই মনে হয়। আরও এক অন্যরকম ছেলেমানুষির গল্প আছে রমাপ্রসাদ বণিককে নিয়ে। কাছাকাছি সময়ে দুই বন্ধুর বহুরূপী যাপন শুরু হয়েছিল। রমাপ্রসাদের পথ থেমে গিয়েছে অনেক আগেই। আমাদের আপাত যত্নহীন থিয়েটারের ইতিহাসের উপাদানে কি আরও গুরুত্ব দিয়ে ভাবা যায় না রমাপ্রসাদ বণিকের মতো প্রতিভাকে? বন্ধুকৃত্যের মতো সেই প্রশ্নও তুলে দেয় এই গ্রন্থ।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পড়ুন: যে সিনেমা দেখে মানুষ খুনের উল্লাস হয় না, সেই সিনেমাই প্রতিরোধের সিনেমা
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
সেরকমই অসংখ্য প্রশ্ন রয়েছে বহুরূপীর ভাঙন নিয়ে। সৌমিত্র বসু পুরো ছবিটা দেখেছেন ভিতর থেকে। তিক্ত যন্ত্রণার অনুভূতি সহ্য করে নামতে হয়েছে মঞ্চে। ‘দ্য শো মাস্ট গো অন’। সেই পেশাদারিত্ব তাঁকে শিখিয়েছে বহুরূপী। শম্ভু-তৃপ্তি উত্তর সময়ে যখনই ভাঙনের বাতাবরণ এসেছে, তখনই তৈরি হয়েছে ‘মৃচ্ছকটিক’, ‘গ্যালিলিও’, ‘আগুনের পাখি’র মতো নাটক। তাতে কি ভাঙন ঠেকানো গিয়েছে? না, যায়নি। গণনাট্য, বহুরূপী, নান্দীকার– সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে। স্বয়ং শম্ভু মিত্র ‘আন্দোলনের প্রয়োজনে’ প্রবন্ধে একপ্রকার নিয়মশৃঙ্খলা বেঁধে দিয়েছিলেন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রুপ থিয়েটারের ক্ষয়রোগে কোথায় যেন ভেসে গেল বহুরূপীর ‘ডেমোক্র্যাসি’। দল ছাড়লেন অনেকেই। বহু চেষ্টা সত্ত্বেও চোখের জলে একদিন বেরিয়ে এলেন সৌমিত্র বসুও। অভিযোগ নয়, বরং এই গ্রন্থে তিনি বলে যান একটা সময়কালকে দেখার কথা। যার সঙ্গে প্রচলিত ইতিহাসের তফাত আছে। ‘বহুরূপী যাপন’ তাই ব্যক্তি সৌমিত্র বসুর কাহিনি হয়েও যুক্ত হয়ে যায় বাংলা থিয়েটারের বড় ক্যানভাসটার সঙ্গে।
তাতে প্রেম আছে, না হওয়া প্রেম আছে, বন্ধুত্বের গল্প আছে। মাঝেমধ্যে দরজা ঠেলে উঁকি দিয়ে যাবেন অধ্যাপক বসুও। আড্ডার আবহে চকিতে ছুঁয়ে যায় জীবনের অনেকটা পথ পার করে আসার শিক্ষা। সময় তো গ্রিক নিয়তির মতো। তার হাতে পুতুল হয়ে নাচছে সবাই। যে ‘মি. কাকাতুয়া’ নাটকের অভিনয় স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি, তার মতোই আশ্রয় নেন নিজের গভীরে। ‘বহুরূপী যাপন’ সেই অনন্ত যাত্রার গল্প– “কতো বাঁও জল দেখ্। তল নাই? পাড়ি দেও। এ আন্ধারে চম্পকনগরী তবু পাড়ি দেয় শিবের সন্ধানে। পাড়ি দেও–পাড়ি দেও–”
বহুরূপী যাপন
সৌমিত্র বসু
এবং অধ্যায়
২৯৯ টাকা