‘লায়ন গড’, মহারাজ সিংহদেবের বর্ণময় রোমান্স-ভরপুর ইতিহাস-আখ্যান, প্রথম পর্বে, পাঠককে আচ্ছন্ন করে রাখে ঠিকই, তবে আমার মতো সামান্য পাঠকের কাছে নায়ক বদলে বদলে যায়; বড়ায়িনন্দন থেকে বেণুমোহন, পতিতপাবন, নিবারণচন্দ্র, বিধুশেখর হয়ে সে-নায়কত্ব অর্পিত হয় প্রবোধ বসুরায়ে। দীর্ঘ আখ্যান পরিক্রমার পর ‘দান ছাড়ব না’ এই প্রতিজ্ঞা সম্বল করে, নতুন সময়ের বড়ায়িনন্দন, বিশ্বজিৎ-এর কথকতাকে অভিনন্দন জানাই
when a man read — which he did very seldom — he read to himself …
Nietzsche
কোনও কোনও বই, বই হয়ে ওঠার আগে থেকেই কেমন মায়া ছড়াতে থাকে! বিশ্বজিৎ রায় প্রণীত, ৩০৪ পৃষ্ঠার দীর্ঘ উপন্যাস ‘তাম্বুলি-আখ্যান’, প্রথম যখন ২০২৩ সালে, ‘বইচই’ পুজো সংখ্যায় পড়ি, তখন থেকেই আখ্যানের মায়াবী টানে অপেক্ষা করছিলাম, কবে, এই ‘খসড়া’ প্রকৃত উপন্যাস হয়ে ওঠে। অবশেষে, শুভ-সেঁজুতির ‘ধানসিড়ি’ থেকে বইটি বেরল, আমার পাঠও সম্পূর্ণতা পেল। উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছদের শিরোনাম ‘বড়ায়িনন্দন’; এর তৃতীয় অনুচ্ছেদে, কাশীপুরের ‘যুবা মহারাজ’ সিংহদেবের ভাবনা-সূত্রে আমরা কাহিনির শুরুর সময়ের আন্দাজ পাই– ‘এখন ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দ’। আর, উপন্যাসের শেষ পরিচ্ছেদের শিরোনাম ‘পথের শেষ কোথায়’; প্রথম অনুচ্ছদেই, ঔপন্যাসিক, কাহিনির অন্ত্যসীমা ঘোষণা করেন, অধ্যাপক প্রবোধবাবুর চিন্তা-সূত্রে ‘এই উনিশ শো ছিয়াশি।’ একেবারে কোম্পানি-শাসন থেকে পশ্চিমবঙ্গের বামফ্রন্টের শাসনকাল অতি দীর্ঘ সময়ের মধ্যে, ঐতিহাসিক বিশিষ্ট চরিত্র থেকে অতি সাধারণ চরিত্রের চলাফেরা, বেড়ে ওঠা, হারিয়ে যাওয়ার পটভূমি হিসেবে স্থান করে নেয় কাশীপুর রাজসভা, কাশীপুরের আশপাশের গ্রাম, দুধভরিয়া নদী-জঙ্গল-ডুংরি, রেলশহর আদ্রা, স্বাধীনতা-পূর্ব পুরুলিয়া শহর, বিহারের অন্তর্ভুক্ত মানভূম এবং বঙ্গভুক্ত পুরুলিয়া। প্রায় দেড় শতক জুড়ে ব্যাপ্ত সময়-পরিসর জুড়ে যিনি প্রধান, তাঁকে ইঙ্গিত করেই উপন্যাসের নাম। নাম একটা তাঁর ছিল একদিন, নরোত্তম দে। বভিন্ন অনুপান দিয়ে পান সাজতেন আর কথা সাজাতেন। সে-কথকতায় মিশে যেত মানভূমের ঝুমুর, নাটগীতি আর পুরাণের কাব্যকাহিনি। সুমিষ্ট তাম্বুল আর সুমধুর কথার টানে মানুষ তাঁর কাছে ছুটে আসত। কথার সুবাস একদিন গিয়ে পৌঁছল সিংহদেব মহারাজের কানে। ডেকে পাঠালেন তিনি কারণ ‘শরীরীসম্ভোগ; শিকারের উত্তেজনা’র বাইরে মহারাজের ‘আরও কিছু প্রয়োজন’। সে-প্রয়োজন মিটল নরোত্তমের আত্মপ্রকাশে। পিতৃকুলের নাম ও পদবী বিসর্জন দিয়ে নরোত্তম হয়ে উঠলেন ‘বড়ায়িনন্দন।’
……………………………………
সমীর মণ্ডলের লেখা প্রীতীশ নন্দীর অবিচুয়ারি: প্রীতীশদা কী কী ভাবে মরতে চাইতেন না
……………………………………
কথাই বড়ায়িনন্দনের প্রাণ, তাঁর মান-মর্যাদা-সম্পদ-সমৃদ্ধি এবং ঐতিহ্য। পালিত পুত্র ও শিষ্য, তাঁর আশ্চর্য কথনশৈলীর উত্তরাধিকারী বেণুমোহনকে একদা তিনি বলেছিলেন, ‘এই যে কথন তা আসলে জলের মতো। বহমান কথার ধারা সাগরের ঢেউ হয়ে এসে শ্রোতাদের ভিজিয়ে দেয়।’ কথন নিয়ে বড়ায়িনন্দনের অনুভূতির মধ্যে আছে কথক ও শ্রোতার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। অন্যদিকে, বেণুমোহন নিস্তারিণীকে বলতেন, ‘তারিণী আমাদের জীবনের গল্প যখন আমরা বলি তখন কি তার সবটুকু বলি! যখন যেমন করে বলতে ইচ্ছে করে তেমন করে বলি। তাতে কত কথা বাদ যায়, কত ছোট কথা বড়ো হয়, কত বড় কথা হারিয়ে যায়।’ এইখানে পৌঁছে মনে হয়, বড়ায়িনন্দন ও বেণুমোহন, পিতা ও পুত্র মিলে যেন কথকতার সম্পূর্ণ স্বরূপটি মেলে ধরলেন। হয়তো এর মধ্যে আছে, আধুনিক কথাসাহিত্যেরও আত্মজীবন। আমার তো এমনই মনে হয় যে, বিশ্বজিৎ রায়ের এই উপন্যাস আসলে, প্রায় বিলুপ্তির পথের বাঁকে হারিয়ে যাওয়া আমাদের বাংলার কথকতা-শিল্প ও তার শিল্পীদের জন্য, গদ্যে রচিত এক দীর্ঘ এপিটাফ।
অহল্যাভূমি পুরুল্যা, আসলে, পঞ্চম শতকের জৈন গ্রন্থাদির প্রাচীন বজ্রভূম। বেণুমোহনের পুত্র পতিতপাবনের স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে আরও অনেক পরের এই ঝাড়িজঙ্গলের দেশ; এই দেশ পার হয়ে নীলাচলে গিয়েছিলেন চৈতন্যদেব, ‘দিব্যপুরুষ’। তিনিই ভেঙে দিয়েছিলেন বর্ণাশ্রমের শিকল, সেই ধারাবাহিকতাতেই অব্রাহ্মণ বড়ায়িনন্দনদের আত্মপ্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা, যা দেখে অসূয়ায় ছিন্নভিন্ন ব্রাহ্মণ কাত্যায়ন। তিনি দেখেন ব্রাহ্মণভূমের স্বপ্ন। বিবেচক মহারাজ সিংহদেবের কাছে কোনও সমর্থনই জোটাতে পারেনন না তিনি। আনখশির দুর্নীতিগ্রস্ত, উচ্চাশী, অসূয়াকাতর কাত্যায়নের জন্যেই মহারাজ সিপাহী বিদ্রোহ সমর্থনে, ইংরেজ সেনাপতির পশ্চাদ্ধাবনে গিয়ে চিহ্নিত হলেন। দু’বছরের কারাবাসের মেয়াদশেষে তিনি ফিরে এলেন ঠিকই, তবে পূর্ব-গরিমা আর রইল না। কাত্যায়নেরই চক্রান্তে, ইংরেজদের সহযোগিতায়, বড়ায়িনন্দন ও নয়নতারা অগ্নিদগ্ধ হয়ে মারা গেলেন কথকতার যুগ শেষ হয়ে এলো। ‘অগ্নিদৃশ্য’ এবং ‘নদী ও মৃত্তিকা’ শিরোনাম-চিহ্নিত পরিচ্ছেদ দু’টি এ-উপন্যাসের কাব্য-কথকতার চমৎকার নিদর্শন; প্রথমটিতে বড়ায়িনন্দন-হত্যা, দ্বিতীয়টিতে নির্জন সুড়ঙ্গপথে মহারাজ ও কনিষ্ঠার মিলন, নবজন্মের ইঙ্গিত। ইতিহাস, লোকশ্রুতি ও কল্পনার মিশেলে, বাক্যের মন্থর চলনে পুরনো ইতিহাসের শেষ দৃশ্যটি অনবদ্য দুধভরিয়া নদীটি তখন আপন মনে প্রবহমাণ। ইংলন্ডেশ্বরী ও দেশজ রাজ্যের সম্পর্কের বাইরে নদী ও মৃত্তিকা মানব-মানবীর স্মৃতি সঞ্চয়ে পূর্ণ, প্রচলিত ইতিহাস-ভূগোলে তার সাক্ষ্য থাকে না। উপন্যাসের প্রায় মাঝামাঝি এসে এখানেই থেমে যায় উনিশ শতকের কথকতা। কাহিনি বাঁক নেয়, উপন্যাসের চলন পাল্টায়, ভাষাও বদলে বদলে যেতে থাকে– আমরা যেন ইতিহাসের পাহাড়-জঙ্গল পার হয়ে, দুরন্ত অশ্বপৃষ্ঠ থেকে নেমে, সমতলে এসে পড়লাম। কাহিনিতে এখন মুখ্য হয়ে উঠবে স্বাধীনতার আগের ও পরের আদ্রা-পুরুলিয়া।
……………………………………
সুধীর মিশ্রর লেখা প্রীতীশ নন্দীর অবিচুয়ারি: ‘হাজারো খোয়াইশে অ্যায়সি’-র গল্পটা অল্প শুনেই বলেছিলেন, কাল অফিসে এসে টাকা নিয়ে যেও
……………………………………
উপন্যাসের ‘নিবেদন’ অংশে বিশ্বজিৎ-এর দু’টি মন্তব্য আমার খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে– ক. ‘রাজনীতি এই উপন্যাসের উপজীব্য।’ খ. উপন্যাসের লেখক তাঁর ছেলেবেলা পুরুলিয়া শহরে কাটিয়েছেন, অনিবার্যভাবেই তাঁর আত্মজীবনের নানা উপাদান এর মধ্যে বানিয়ে তোলা সত্য হিসেবে প্রবেশ করেছে। বালক নিরুপম ও ইংরেজির অধ্যাপক প্রবোধ বসুরায়ের মধ্যে যে-এক অসম বন্ধুত্ব ও বিনিময় গড়ে ওঠে এবং উপন্যাসের একেবারে শেষে যে-গূঢ় ইঙ্গিত রেখে যায়, আমরা বুঝতে পারি নিরুপমের মধ্যে লেখক নিজে আছেন, আর প্রবোধবাবুর মধ্যে আছেন তাঁর ‘জেঠু’, ‘ছত্রাক’ পত্রিকার সম্পাদক, লোকসংস্কৃতির তন্নিষ্ঠ গবেষক অধ্যাপক সুবোধ বসুরায়। নিরুপমের দেখার মধ্যে বালক-সুলভ সারল্যে ধরা দেন দ্বিধান্বিত প্রবোধবাবু, তাঁর যাবতীয় মধ্যবিত্ততা নিয়ে, সেই ঘেরাটোপ ভেঙে বেরিয়ে আসার ইশারাও লেখক দিয়েছেন। উনিশ শতকের ব্রিটিশ-রাজনীতি, মানভূমের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক, সিপাহী বিদ্রোহ দমন, নীল চাষ, রেলপত্তন থেকে একেবারে খণ্ডিত স্বাধীনতা লাভ পর্যন্ত যে-রাজনীতির উপন্যাস-বিবরণ ‘তাম্বুলি-আখ্যান’ ধারণ করে আছে, তাতে, বড়ায়িনন্দনের আপসহীনতা ও মৃত্যুবরণের মধ্যে আছে প্রাচীন বজ্রভূমের চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয়। সেই আদর্শই অনুসরণ করে চলেন, পুত্র বেণুমোহন। কাত্যায়নের চক্রান্তে পিতার মৃত্যুর পর, কাশীপুর ত্যাগ করে, তিনিই নতুন শহর আদ্রায় বহন করে আনেন তাম্বুল ও কথকতার উত্তরাধিকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একদিন বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন তাম্বুলখানা। পুত্র পতিতপাবনের সঙ্গে বাদানুবাদে, বেণুমোহনের উত্তর খুবই তাৎপর্যবহ– ‘এখন যে তাম্বুলখানা বেঁচে আছে সে তাম্বুলখানা আগেকার মতো কথনচর্চার স্থল নয়। এখন কী হয় এখানে? এই শহরের বাবুরা আসেন। পান খান। তারপর নিজেদের ইচ্ছে মতো তামাকু সেবনের অবকাশ খোঁজেন। রাজনীতি নিয়ে কথা বলেন। এই অলস সময় যাপনের জন্য আমি তাম্বুলখানা চালিয়ে যেতে পারি না। ভূমিকাহীন একজন পান বিক্রেতা হয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না আমার।’ অভিমানী পতিতপাবনের পুরুলিয়া যাত্রা, লোকসেবক সংঘের বিধুশেখর ও লাবণ্যপ্রভা দেবীর সঙ্গে সাক্ষাৎ হল, তাঁদের সহযোগিতায় খুললেন স্বদেশি ভাণ্ডার। তার দেয়ালে ‘মানভূমের গান্ধী’ নিবারণচন্দ্রের স্বদেশি গানের পঙ্ক্তি ‘ওরে ও কালের শিশু। তোদের ভয় নাইরে কিছু (রে) । শ্মশানের ছাই মেখে সব ধররে বিজয় গান।’ এত উদ্দীপনার স্বদেশি ভাণ্ডার স্বাধীনতা-পরবর্তী কালে নব্য রাজনীতি আর কুটিল পুঁজির দাপটে বন্ধ হয়ে গেল– ঐতিহ্যের ক্রমক্ষয় যেন কিছুতেই এড়ানো যাচ্ছে না; তবু হার মানেনি পতিতপাবনের ছেলে দীনু। নিজের বাড়ির একাংশে সে খুলেছে পানের দোকান। লোকে ‘পান-বিড়ির দোকান’ বললে তার কষ্ট হয়। ভাবছে, বিড়ি-সিগ্রেট বিক্রি বন্ধ করে দেবে সে, বাঁচিয়ে রাখবে পান, তাদের ‘কুলচিহ্ন’, বড়ায়িনন্দনের উত্তরাধিকার। শেষ পর্যন্ত সে কি পারবে কালচক্রের সঙ্গে লড়তে। উত্তর জানা নেই।
……………………………………
সঞ্জীত চৌধুরীর লেখা প্রীতীশ নন্দীর অবিচুয়ারি: শুধু লেখা নয়, ছবিও কত গুরুত্ব পেতে পারে, দেখিয়েছিলেন প্রীতীশ
……………………………………
উপন্যাসে, রাজনীতির আর এক ধারায়, লেখক ধরেছেন মানভূমের বিহারভূক্তি, বাংলাভাষীদের ওপর জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা, বাঙালির আন্দোলন, শেষপর্যন্ত মানভূমের কিয়দংশ খণ্ডিত করে নতুন পুরুলিয়া জেলার সৃষ্টি। ত্যাগী দেশব্রতী মানুষদের ‘মুক্তি’ পত্রিকা প্রকাশ, স্বদেশী ভাণ্ডার গড়ে তোলা, এভাবে, বিশাল এক রাজনীতির পটভূমিকায় বিশ্বজিৎ স্থাপন করেছেন তাঁর আখ্যানপট। তার ভেতর দিয়ে পরোক্ষ ভাবে তিনি পর্যটন-লাঞ্ছিত, সুদূর ও অনতিদূর অতীতের গরিমা-বিস্মৃত পুরুলিয়ার প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন আখ্যানে। মকর পরবের দিনে, শীর্ণ কাঁসাইয়ের পাড়ে পাথরের ওপর বসে, সর্বত্যাগী লোকসেবক বিধুশেখরের স্মৃতিসূত্রে ঔপন্যাসিক এনেছেন, বাংলাভাষার জন্য মানভূমবাসীর মরণপণ লড়াইয়ের ইতিহাস; এই আন্দোলনের জন্য টুসু গান লিখেছিলেন ভজহরি মাহাতো– “শুন বিহারি ভাই তোরা রাখতে লাইরবি ডাং দেখাই।’ আসলে, ‘যে ক্ষমতায় যায় সেই ডাং দেখায়’ – পঞ্চাশ-ষাট দশকে, বিধুশেখরের এই রাজনৈতিক পর্যবেক্ষণ, উনিশশো ছিয়াশিতে, প্রবল প্রতাপশালী বামফ্রন্ট শাসনেও সত্য। বড়ায়িনন্দনের প্রকৃত উত্তরাধিকার বর্তায় তাই প্রবোধ বসুরায়ের ওপর। ইংরেজির অধ্যাপক, কিন্তু তাঁর চৈতন্যকে আলোড়িত করে চলে, পাহাড়-জঙ্গল-রুক্ষ সমতলবাসী দেশজ মানুষের নিঃসীম দারিদ্র– “বীজধান নেই, পুঁজি নেই, চাষের বলদ নেই।… যে যেখানে পারছে কাজের সন্ধানে চলে যাচ্ছে।” প্রান্তিক জেলার প্রান্তবাসী মানুষের প্রতি গভীর এই দরদের কারণেই, উপন্যাসের শেষ পর্বের নায়কত্ব তাঁকেই অর্পণ করেছেন লেখক। প্রতিবেশি, নিতান্ত এক বালকের সঙ্গে প্রবোধবাবুর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠা, কথা-বিনিময়ের পথ বেয়ে বিশ্বজিৎ তাঁর ‘আখ্যান’কে অন্তিমে সংহত করেন এক দার্শনিক জিজ্ঞাসা ও প্রত্যয়ে। ক্যারম খেলতে খেলতে নিরুপম সাদা-কালো ঘুঁটি দিয়ে দুর্গ বানায়। ভেতরে লাল খুঁটি পদ্মিনী। স্ট্রাইকারকে গোলা বানিয়ে নিজেই হামলা চালিয়ে পদ্মিনীর পতন ঘটায়। আর্থাৎ চিতোরের রানার পতন হলো। আরেকবার খেলার জন্য বোর্ড সাজায় সে। বোধহয় চায় রানা জিতুন, পদ্মিনী সুরক্ষিত থাকুন। এসবের মূলে জেঠু, তিনিই বলেছিলেন ‘রাজকাহিনি’ পড়তে। পড়ে সেটা খেলায় রূপান্তরিত করে প্রবোধবাবুকেই চমকে দেয় সে। খেলার বিবরণ শুনতে শুনতে প্রবোধবাবু বলেন নিরুপমকে– ‘শুধু কি বেঁচে থাকার দিনবৃদ্ধির নিরুপায় চেষ্টা, অনেক সময় হেরে যাব জেনেও যতক্ষণ পারা যায় ততক্ষণ হেরে যাওয়া খেলাটা আমরা টানতে থাকি। সেটা আমাকে যে মারছে, হারাতে চাইছে সেই শক্তিধরের সঙ্গে আমার মরে যাওয়ার আগে প্রতিবাদী বোঝাপড়া। মরব তো বটেই কিন্তু দান ছাড়ব না।’
‘লায়ন গড’, মহারাজ সিংহদেবের বর্ণময় রোমান্স-ভরপুর ইতিহাস-আখ্যান, প্রথম পর্বে, পাঠককে আচ্ছন্ন করে রাখে ঠিকই, তবে আমার মতো সামান্য পাঠকের কাছে নায়ক বদলে বদলে যায়; বড়ায়িনন্দন থেকে বেণুমোহন, পতিতপাবন, নিবারণচন্দ্র, বিধুশেখর হয়ে সে-নায়কত্ব অর্পিত হয় প্রবোধ বসুরায়ে। দীর্ঘ আখ্যান পরিক্রমার পর ‘দান ছাড়ব না’ এই প্রতিজ্ঞা সম্বল করে, নতুন সময়ের বড়ায়িনন্দন, বিশ্বজিৎ-এর কথকতাকে অভিনন্দন জানাই; আমি নিশ্চিত, আগামীতে, আরও নতুন নতুন আখ্যান পরিকল্পনায় তিনি বাংলা কথাসাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবেন।
…………………………
তাম্বুলি আখ্যান
বিশ্বজিৎ রায়
ধানসিড়ি
৪৫০্