অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার, আর থাকে এক বই। এই যা কিছু আঙুলের ফাঁক-গলতি, ধরে নেওয়া যাক, তাদের আর দেখা মিলবে না। অথচ ছিল। এই মেলাতেই। প্রদীপ দাশশর্মার মহাজীবন আর টুকরোজীবন। সময়ের সুড়ঙ্গ থেকে মুখ বের করে আছে। ইতিহাস, ইতিহাস-ই। সুচেতনা, যূথিকা বহুযুগের ওপার থেকে, যেন রক্তের বোন। তবু দ্বীপ এখনও দূরতম। এইসব ভ্রান্তিবিলাসের ভিতর স্মৃতির প্ররোচনা, গভীর ইতিহাস।
এ-বছর বইমেলায় শিল্পী এবং হস্তশিল্পের প্রদর্শন যাঁরা করেন, তাঁদের বসার অনুমোদন দেওয়া হয়নি। কারণ সঙ্গত অথবা অসঙ্গত তবু প্রসঙ্গত অজানা। কেউই ঠিক জানেন না, তবু সকলেই জানেন যেন। যেন-তেন প্রকারেণ… যাকগে, বরং সাঁ করে এই অর্বাচীন ক্যাসেটের রিল সময়ের পেনসিলে ঘুরিয়ে চলে যাওয়া যাক আসানসোল বইমেলায়। সাল-তারিখ ভেবে লাভ নেই। কেউ মনে করতে পারলে ভালো, চিনতে পারলে চিনবেন। ঘাসের মলাটে বসে আছেন ‘আসানসোল বইমেলার পক্ষিণী’ মায়া চট্টোপাধ্যায়। পাশে রাখা অনেক বই। তাঁর পাশে আর একজন। দু’-পা ছড়িয়ে বসে। বিক্রি করছেন শবরদের শিল্পকলা। পটশিল্প, মুখোশ, পুঁতির মালা। এঁকে তো চেনা যায় না! প্রদীপ দাশশর্মার, অনুমান করতে পারি, দু’চোখ প্রশ্নাতুর। অতএব উদয়ন ঘোষ, এগিয়ে এসে, ধরিয়ে দেন দু’চার পরিচয়পত্র। যথা, ‘হাজার চুরাশির মা’, ‘অরণ্যের অধিকার’। হ্যাঁ, ঝাঁজরা হয়ে যাওয়ার মতোই তথ্য। মহাশ্বেতা দেবী। ‘শবরদের অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার লঘু প্রচেষ্টা। নিজের বই বেসাতি না। আমি তার সম্মুখে ঝুঁকি।’ হায় ঝুঁকে যাওয়া ২০২৫! বইমেলা! ঝুঁকি কে নেবে! মহাশ্বেতা প্রচ্ছদ হয়েছিলেন সরস্বতী পুজোর প্রেক্ষিতে। বইমেলার ক্যালেন্ডারে সরস্বতী পুজো থাকে, প্রচ্ছদে আর মহাশ্বেতা কই!
না-থাকারই কথা। কথাটার শুরুতে ‘হয়তো’ লিখেছিলাম, কাটলাম। থাকবেই না। এখন আর ঋত্বিক ঘটক আসবেন নাকি! সংবর্ধনা, কাতর শক্তি তরুণ তখন, সরে যাবেন, আর সাদা পাতলুন-পাঞ্জাবিতে ‘পতনের উঁচু-নীচু’ ঋত্বিক, জ্বলন্ত বিড়ি, আগুন ছুঁয়েছে সবুজ সুতো, সেই পাঞ্জাবির স্পর্শ যার গায়ে- সেও তরুণ, তার কাঁধে কি হাত দেবেন! একটা মুহূর্ত। ভোলা যায় নাকি! যেন দেওয়ালে গেঁথে থাকা অতর্কিত আক্রমণের বুলেট। অভিমান, ঋত্বিক। ‘কোমল গান্ধার’ দেখেননি কেউ। ওই যে নতুন নায়ক, সুচিত্রা-উত্তম তো নেই। অথচ সংবর্ধনা। অথচ সেদিন তুমুল ঋত্বিক। এখন, হায় ঋত্বিক! তাঁর ছবি দেখাতে নাকি বাধা ২০২৫-এ। তা নিয়েও চাপান-ওতোর, রাজনীতি, রাজনীতি– করবী ফল, আত্মবিষ।
সুতরাং, পবিত্র বিক্ষোভ। চলছিল, ছিলই। স্বাধীনতার আগে থেকেই। জীবনানন্দে কি তার ইঙ্গিত ছিল না? জলপাইহাটি? তা ছাড়া সুচেতনা। ‘মেয়েমানুষ’ মাত্র নন। তাহলে? একটা আইডিয়া। দর্শন। বিপ্লবের ভূমি। জীবনানন্দের কমলালেবুর উপর টীকাকার উদয়ন কি তাঁকে তেমন বুঝবেন! বুঝতে চাইবেন। তাহলে আসরে যতীন্দ্রনাথ ঘোষ। সোনার তরী, তিনি মনে করেন, রবীন্দ্রনাথ ওই একটা কবিতা লিখে নোবেল পেতে পারেন। উপন্যাসে হলে কবিতায় নয় কেন? তিনিই বোঝাবেন, সুরঞ্জনা, বনলতা আর সুচেতনা এক নন। কেবল মহিলা নন। বিপ্লব আসবে কী করে? যদি চেতনায় মল জমে থাকে? সুচেতনা তাই দূরতম দ্বীপ। যত দূরতম তত শুধু মাতিয়ে তোলা, খেপিয়ে তোলা। বুঝিয়ে তোলা নয় ভাবনার বীজতলা। বোধ কি কাজ করে মাথার ভিতরে? মুক্তধারা মনে পড়ে। স্বাধীনতার আগে থেকেই সে গোলোযোগ তলে তলে। তবু সব গোলেমালে হয়ে যায়, চুকেবুকে যেতে থাকে। ইতিহাস খানিক নিজের কাছেই যেন নিজে গা-ঢাকা। একদিন তাই অবশ্যম্ভাবী নকশালবাড়ি। বন্দুকের নল। কিন্তু, এত রক্ত কেন! যূথিকার কাছে, এখন, তবে যাওয়া যেতে পারে: পৃথিবীর অভিভাবিকা সে/ তাকে পড়াতে হয় ইতিহাস। চারু মজুমদার স্বীকার করে নেবেন সমাজতন্ত্রের লড়াইয়ে বিচ্যুতি। একজন মানুষের মৃত্যু, সমস্ত সতর্কতায়, ঘোষণা করবে রাষ্ট্র। রাষ্ট্রও তবে কী আর কম ভীতু! সেইসব ঘটমান অতীত হবে। যূথিকা, ইতিহাস পড়াবেন। সাদা, কস্তা পেড়ে শাড়ি। কঠিন চিবুক। ইতিহাসের ক্ষয়, অর্জন তাঁর বোঝানোর দায়। তবু নীরা আরও বেশি খ্যাতির। খাতির আদায় করে নেয় ‘হট কেক, জাস্ট বেকড’। নীরার শরীরে পিচ্ছিল সাবান। মধ্যবিত্তের খিদে। অন্য মাত্রার। কিন্তু যূথিকা খিদের ওপারে, ফিলোজফি। গা-জোয়ারি মন্তব্যের ঝান্ডা নয় হে, বলছেন, সুশীল সিংহ। যদি তর্ক করো, তাহলে বাংলা কবিতার আবহমানে ডুব দিয়ে এসো। কে করবে সেই তর্ক! বইমেলায় এখন থেকে মুক্তমঞ্চ নামঞ্জুর।
অতএব এই পপকর্নের মতো পলকা মুখরোচক সময়ে জীবনের কোন তাস হাতে রাখা যায়, এ হিসাব বড় গোলমালের। সব তাস ঘেঁটে গেছে। কে আবার গোছাবে! জীবন, ফিরে দেখলে, এমনই। এলোমেলো। টুকরো-টাকরা। যেন কোনও শাস্ত্রবিরোধী ন্যারেটিভ। শুরুও নেই, শেষ নেই। কেবলই দৃশ্যের জন্ম। ভাবনার প্রোটিন। অথবা এটাই শাস্ত্র। শস্ত্র বলতে স্মৃতি। জীবন ছাড়া জীবনের বিষ ঝাড়া যায় না। চুরি যাওয়া জীবন খুঁজতে ফকিরের নখদর্পণ আজ কোথায়! একে দেশভাগ, সব পরিযায়ী রাজমিস্ত্রি হয়ে গেছে এখন। তার পর, এত বছর পরে হিন্দু-মুসলমানে কী লাঠিখেলাই না লাগিয়েছে রাজনীতি। এখন, মৌলবী সাহেব আপনি কোথায়! আওরঙ্গজেব কত খারাপ, সবাই জানে। জোর জোর করে তা বলা হয়। আগে বলা হত, এখনও, এখন হোয়াটসঅ্যাপ বিশ্ববিদ্যালয়। বাদশাহি ফরমান তবু বলে, কোনও ব্রাহ্মণের উপাসনায় যেন বাধা না দেওয়া হয়, কোনও হিন্দু মন্দিরের কাজে! সে কথা আপনারই বলার। লোকটা, বাদশা ভূ-ভারতের মালিক হয়েও পার্সোনালি গরিব। বলার কথা আপনার। ইতিহাস পড়ানোর, হয়তো যূথিকার মতো নয়। তবু ইতিহাসের সবরকম পাঠই তো জরুরি। দোহাই আল্লা! মৌলবী সাহেব, এখন শুধুই নিরুদ্দেশ সম্পর্কে ঘোষণা। এদিকে, বইমেলায় কত ধর্ম-ধর্ম পুণ্যলোভ। কোন ধর্ম?
কী আর বলার তবে! বদল তো হবে, হবেই। বেলা অবেলা কালবেলা। মেলার আর কী দোষ? যে কোনও কর্তৃপক্ষ বলবে, সময়ের চরিত্রের সঙ্গে সিদ্ধান্ত সকলই সঙ্গতিপূর্ণ। তা-ই সই! সইতে হয়। অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার, আর থাকে এক বই। এই যা কিছু আঙুলের ফাঁক-গলতি, ধরে নেওয়া যাক, তাদের আর দেখা মিলবে না। অথচ ছিল। এই মেলাতেই। প্রদীপ দাশশর্মার মহাজীবন আর টুকরোজীবন। সময়ের সুড়ঙ্গ থেকে মুখ বের করে আছে। ইতিহাস, ইতিহাস-ই। সুচেতনা, যূথিকা বহুযুগের ওপার থেকে, যেন রক্তের বোন। তবু দ্বীপ এখনও দূরতম। এইসব ভ্রান্তিবিলাসের ভিতর স্মৃতির প্ররোচনা, গভীর ইতিহাস। তা চিনে জীবন নামের এই গাধাকে বলতে ইচ্ছে করে, সকলই ঘোড়ার ওয়াস্তে… ধুর, ছিল নাকি, থাকবে নাকি, চিরকাল? হাতে এখনও আছে ‘উইন্ডস্ক্রিনের ধুলো’। বইমেলায় এখনও ধুলো নিষিদ্ধ নয় যাহোক!
উইন্ডস্ক্রিনের ধুলো
প্রদীপ দাশশর্মা
প্রকাশক: ব্ল্যাকলেটার্স
৩৫০ টাকা