অহিভূষণ মালিক। বাংলার এক অসামান্য শিল্পী, কার্টুনিস্ট ও চিত্র-সমালোচক। এসবের বাইরেও এক আশ্চর্য বাঙালি চরিত্র, যাঁদের আজকাল দেখাই যায় না প্রায়! অহিভূষণ মালিক নিজের ভেতরে থাকা সম্ভাবনাগুলো জাগিয়ে তুলেছেন বই পড়া দিয়ে, ছবি আঁকা দিয়ে, গান গেয়ে, আড্ডা মেরে, এই পৃথিবীর রাস্তাঘাট ঘুরে। ফ্রাঁসোয়া র্যাবেলের ‘গাঁরগাঁতুয়া’– এক ফরাসি পেটুক রাজার গপ্প, অনুবাদ করেছিলেন অহিভূষণ মালিকই। কেনই বা করবেন না? খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসাও তো তাঁর বেঁচে থাকা অমনিবাসের প্রথম খণ্ড।
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ছাদের ঘোরানো সিঁড়ি বসেছিল যাঁর আনুকূল্যে, তিনি সঞ্জীব চট্টোকে বলতেন ‘গুলবাজ’, জানতেন ফরাসি ভাষা। দুরন্ত গাইতেন নিধুবাবুর টপ্পা। এইচএমভি-র তরফ থেকে রেকর্ডের বরাত পেয়েছিলেন, কিন্তু ব্যাপারখানা বাস্তবায়িত হয়নি। টিনটিন-কে বলতেন, ‘ত্যাঁত্যাঁ’। ধর্মতলার মসজিদ গলির বিফ শিঙারা খেতে ভালোবাসতেন। পান-সিগারেট খেতেন না। পরতেন ধুতি-পাঞ্জাবি, পায়ে চটি। চেহারা ভারীর দিকে। ইশকুল বয়সেই যাঁর নাম হয়ে গিয়েছিল ‘মোটা মামা’। নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী সদ্য বিয়ে করে অফিসে যখন জানিয়েছিলেন, আমার এক বিবাহযোগ্য শ্যালিকা রয়েছে, কেউ বিয়ে করবেন? হাত তুলেছিলেন এই ভদ্রলোক। আত্মীয়বন্ধুদের বিয়ে-টিয়ে থাকলে বাড়িতে নেমতন্ন করে স্বপাক আহার করাতেন। ব্যারাকপুরের তাঁর বাড়ির দরজায় লেখা ছিল: ‘কুকুর নাই’। মাঝে মাঝেই চিঠি পেতেন শিল্পী অন্নদা মুন্সীর– অপূর্ব ক্যালিগ্রাফি করা সেই অন্নদা-অক্ষর যাঁরা দেখেছেন, তাঁরা বেজায় ভাগ্যবান (না, আমি নই)। ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় আর্টিকেল লিখতেন কলকাতার বিভিন্ন পুরনো ও বিখ্যাত বাড়িগুলোয় কী ধরনের শিল্পসামগ্রী মজুত আছে, তাই নিয়ে। খিদিরপুরে নানা পেশার লোকজনের স্কেচ করতে পুলিশের চর ভেবে ঘিরে ধরেছিল কিছু লোকে, তবে তেমন গোলমাল পাকেনি। শিল্পীদের ছবি নিয়ে যখন কলাম লিখেছেন, শুধু শিল্পের কথাই বলেননি, লিখেছেন শিল্পীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও– কে কী ধরনের জামাকাপড় পরেন, কীভাবে তাকান, ছাতা নিয়ে হাঁটেন, না বিনা ছাতায়– ইত্যাদি বিচিত্র খুঁটিনাটিও ছিল তাঁর বাঘের মতো হাতের থাবায়। মুখখানা গম্ভীর কিন্তু অন্তরালে হাসি উপস্থিত– ছদ্মরাগ, কপট যুদ্ধবৃত্তিতে ওঁর জুড়ি মেলা নাকি ভার। ফাঁকিবাজ চিত্রসমালোচকরা তাঁর চিত্রসমালোচনা পড়ে নিশ্চয়ই অনুভব করতেন সজোরে কানমলা।
তিনি– অহিভূষণ মালিক। বাংলার এক অসামান্য শিল্পী, কার্টুনিস্ট ও চিত্র-সমালোচক। এসবের বাইরেও এক আশ্চর্য বাঙালি চরিত্র, যাঁদের আজকাল দেখাই যায় না প্রায়! অহিভূষণ মালিক নিজের ভেতরে থাকা সম্ভাবনাগুলো জাগিয়ে তুলেছেন বই পড়া দিয়ে, ছবি আঁকা দিয়ে, গান গেয়ে, আড্ডা মেরে, এই পৃথিবীর রাস্তাঘাট ঘুরে। ফ্রাঁসোয়া র্যাবেলের ‘গাঁরগাঁতুয়া’– এক ফরাসি পেটুক রাজার গপ্প, অনুবাদ করেছিলেন অহিভূষণ মালিকই। কেনই বা করবেন না? খেতে ও খাওয়াতে ভালোবাসাও তো তাঁর বেঁচে থাকা অমনিবাসের প্রথম খণ্ড। এবং সেই রচনাটিও যে ব্যঙ্গাত্মকই। ধর্মতলায় চৌধুরী কেবিনের আড্ডায় হয়তো তাঁরই উদর ভরে উঠত সবচেয়ে বেশি। মনে রাখতে হবে, তাঁর নোলেদাকে– যে নিজের গপ্পে তো বটেই, বিজলি গ্রিলের বিজ্ঞাপনেও হাজির হয়েছিল কেতায়। কিন্তু শিল্প নিয়ে কোনও টিকরমবাজি তিনি রেয়াত করতেন না। চিত্র-সমালোচনার ক্ষেত্রে শুধু যে ছবি দেখার অভিজ্ঞতাটুকুই যথেষ্ট– এ তিনি মনে করতেন না। ছবির নেপথ্য-ইতিহাস বা ভূগোলের স্থানাঙ্ক নির্ণয় একজন চিত্রসমালোচকের কাজ বলেই মনে করতেন তিনি।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
খিদিরপুরে নানা পেশার লোকজনের স্কেচ করতে পুলিশের চর ভেবে ঘিরে ধরেছিল কিছু লোকে, তবে তেমন গোলমাল পাকেনি। শিল্পীদের ছবি নিয়ে যখন কলাম লিখেছেন, শুধু শিল্পের কথাই বলেননি, লিখেছেন শিল্পীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও– কে কী ধরনের জামাকাপড় পরেন, কীভাবে তাকান, ছাতা নিয়ে হাঁটেন, না বিনা ছাতায়– ইত্যাদি বিচিত্র খুঁটিনাটিও ছিল তাঁর বাঘের মতো হাতের থাবায়। মুখখানা গম্ভীর কিন্তু অন্তরালে হাসি উপস্থিত– ছদ্মরাগ, কপট যুদ্ধবৃত্তিতে ওঁর জুড়ি মেলা নাকি ভার। ফাঁকিবাজ চিত্রসমালোচকরা তাঁর চিত্রসমালোচনা পড়ে নিশ্চয়ই অনুভব করতেন সজোরে কানমলা।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………..
কলকাতা কর্পোরেশনের মাঠে, যে আর্ট ফেয়ার চালু হয়েছিল, তার মধ্যমণিদের অন্যতম ছিলেন অহিভূষণ মালিকই। নতুন শিল্পীদের নিয়ে মার্কাস স্কোয়ারের বঙ্গসম্মেলনে একেবারে প্রদর্শনীই দাঁড় করিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। এমনকী, এক ছোটদের ছবির প্রতিযোগিতার বিচারক হিসেবেও তিনি এতটুকুও ধৈর্যচ্যুত হননি, এক এক করে সমস্ত ছবি দেখেছিলেন মন দিয়েই। আবার, হারিয়ে যাওয়া শিল্পীদের ছবির কথাও তিনি বারবার করে মনে করিয়ে দিয়েছেন নানা ছলে-বলে-কৌশলে। ছোটদের জন্য লিখেছেন ‘ছোটদের রঁদ্যা’, ‘ছবির কথা’। ফরাসি চিত্রশিল্পী মারিও উত্রিও-কে নিয়ে ‘উত্রিও’ এবং পল গঁগা-কে নিয়ে লেখা ‘ডিয়ার মাস্টার’। লিখেছেন ভ্রমণকাহিনি– ‘পাঁচরঙা ইউরোপা’। তা ছাড়াও ‘প্রাচীন ভারতের চিত্রকলা’। নোলেদার কমিকস বাদ দিলেও, তারাপদ রায়, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়, গৌরকিশোরের ‘রূপদর্শী নকশা’-তেও তাঁর কাজ অনবদ্য। এবং অবশ্যই, লীলা মজুমদারের ‘পদিপিসীর বর্মিবাক্স’তেও। তাঁর কার্টুন প্রকাশিত হয়েছে বহু, পাঁচের দশকে ‘সত্যযুগ’ সংবাদপত্রে।
অহিভূষণ মালিককে নিয়ে সম্প্রতি একটি সংখ্যা প্রকাশ করেছে ‘কিঞ্জল’ পত্রিকা। এ লেখায় বলা প্রায় সমস্ত কথাই, এই পত্রিকার বলা। তাঁকে নিয়ে বিস্তারিত দু’-মলাটে কথা বলার এটি সম্ভবত দ্বিতীয় পর্ব। কয়েক বছর আগে বিশ্বদেব গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর ‘রঙ্গব্যঙ্গ রসিকেষু’-তে লিপিবদ্ধভাবে কথা বলার ফিতেটি কেটেছেন। এই মাপের শিল্পীকে ১০৪ পাতায় ধরা, নিশ্চয়ই খুব দুরূহ কাজ, সে কাজে অনেকটাই সফল ‘কিঞ্জল’। অনতিদূরে, তাঁকে নিয়ে বৃহদাকারে কাজ না হলে, আর্ট গ্যালারির পেরেকগুলো যেন নড়বড় করে ঝরে পড়ে।
কিঞ্জল পত্রিকা
অহিভূষণ মালিক সংখ্যা
সম্পাদনা: চন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়, মৌসুমী চ্যাটার্জী
১৩০