অভিনয়ের এই বিপুল কেরিয়ার কেবল ছায়াছবি নয়, নাট্যমঞ্চ কিংবা রেডিও নাটকেও ছড়িয়ে রয়েছে। আবার ছবির জগতে আসার আগে গল্পও লিখতেন নির্মলকুমার। পরবর্তী সময়ে অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকেও চলেছে সাহিত্যচর্চা। সমরেশ বসুর মতো কিংবদন্তি সাহিত্যিক ছিলেন বন্ধু। ‘চৌরঙ্গী’র সংখ্যাটি সবদিকেই আলো ফেলেছে।
এক যে ছিল সময়। যে সময়টা বাঙালির মুঠোর ফাঁক দিয়ে আলগোছে বিলীন হয়ে গিয়েছে ক’বে! কিন্তু সেই হারানো সময়ের জলছাপ এখনও রয়ে গিয়েছে। পুরনো চলচ্চিত্র বা গল্প-উপন্যাসের জগৎ ছুঁয়ে এলে তাকে দেখা যায়। ‘চৌরঙ্গী’ পত্রিকার নির্মলকুমার সংখ্যা হাতে নিলেও তেমনই অনুভূতি জেগে ওঠে। নির্মলকুমার একজন শক্তিশালী অভিনেতা ও সুদর্শন নায়ক মাত্র নন। বাঙালির সেই স্বর্ণযুগের এক প্রতিনিধি তিনি। তাই তাঁর সম্পর্কে পড়তে পড়তে আস্ত এক সাদা-কালো অতীত ভেসে ওঠে চোখের সামনে। যে অতীত কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হয়।
শুনতে পাই বরবেশে অপেক্ষমাণ নির্মলকুমারকে উত্তমকুমার ডাকছেন, ‘এই নিমে। শিগগির নেমে আয়।’ তাঁর আসার কথা চারটেয়। এলেন ছ’টায়। বরকর্তাবেশী নির্মলকুমার রীতিমতো উৎকণ্ঠায় ভুগছিলেন। গোধূলি লগ্নেই যে বিয়ে! কিন্তু মহানায়ক এসে জানালেন, তাঁর গাড়ির ড্রাইভার ন্যাপা পথ হারিয়ে নির্মলকুমারের বাড়িটাই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সেই কারণেই বিলম্ব! এদিকে কনে মাধবীর বাড়িতে রটে গিয়েছে উত্তমকুমার আসছেন বরকর্তা হয়ে! পড়তে পড়তে ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর মাসের দিনটা যেন চোখের সামনে অ্যালবামের ছবির মতো ফুটে উঠতে থাকে। বা বলা ভালো যেন সেটাও কোনও সাদা-কালো ছবিরই দৃশ্য মনে হয়। ‘‘…কাতারে কাতারে মানুষ এসে ভিড় করেছে মাধবীদের বাড়ির সামনে। বিয়েবাড়িতে বর দেখার জন্যই হুড়োহুড়ি পড়ে যায় জানি। এই প্রথম দেখা গেল বর নয়, বরকর্তাকে দেখবার জন্য হুলস্থুল কাণ্ড! যেহেতু বরকর্তাটি হলেন উত্তমকুমার। জনা দশেক পুলিশ এবং একজন সার্জেন্ট লাঠিসোঁটা হাতে নিয়েও সে ভিড়কে সামাল দিতে পারছেন না।… বরবেশী উত্তমকুমারকে দেখে ‘গুরু গুরু’ রবে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করে সমবেত জনতার একটা অংশ ছুটে এল বরের গাড়ির দিকে।’’ এই দৃশ্য মুহূর্তে হারানো সময়কে দমকা হাওয়ার মতো মেলে ধরে চোখের সামনে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
প্রথম ছবি ‘শেষের কবিতা’য় তিনি ছিলেন অমিত রায়। ‘সেদিন নবাগত নির্মলকুমারকে অমিত রায় রূপে দেখে দর্শকদের মধ্যে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। দর্শক বলতে লাগল– এ যেন একদম রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস থেকে উঠে আসা চরিত্র।’ (সে বিনে আর জানে না– জানে না এ মন/ দিব্যেন্দু দে) প্রথম ছবিই তাঁকে রুপোলি পর্দায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ‘পরেশ’, ‘উপহার’, ‘কালিন্দী’, ‘ক্ষণিকের অতিথি’, ‘কমললতা’র মতো অসংখ্য ছবিতে তাঁর অসাধারণ অভিনয় দর্শককে মুগ্ধ করেছে। এর মধ্যে ‘কমললতা’ ছবিতে গহর গোঁসাইয়ের চরিত্রটিকে তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা বলে মনে করেন অনেকেই।
………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
পরবর্তী প্রজন্ম নির্মলকুমারকে দেখেছেন মূলত টিভির পর্দায়। তিনি যেন সত্যিই সেযুগের নিখাদ বাঙালিয়ানায় গড়া এক মানুষ। বাঙালির সেই স্বর্ণযুগের এক মূর্ত চরিত্র। সম্রাট মুখোপাধ্যায়ের ‘চিরস্নিগ্ধ নির্মাল্য’-তে পাচ্ছি ‘নির্মলকুমার আমাদের প্রাণের আরাম। নির্মলকুমার আমাদের চোখের আরাম। কারণ নির্মলকুমার অভিনীত চরিত্ররা এতটাই সত্তাগতভাবে আমাদের পরিচিত যে সেখানে অপরিচিতের কোনো দূরত্ব জাগে না।… সবসময়ই যেন আটপৌরে-গৃহস্থ-বাঙালিয়ানায় স্নাত নির্মলকুমার অভিনীত চরিত্রেরা।’
ঘোর উত্তম জমানাতেও যে নায়করা তাঁদের স্বকীয়তায় রুপোলি পর্দা মাতিয়ে রেখেছিলেন, তাঁদেরই অন্যতম নির্মলকুমার। একদিকে উত্তম যেখানে কুয়াশায় ঢাকা ‘লার্জার দ্যান লাইফ’, নির্মলকুমারের অবস্থান যেন ঠিক তার বিপ্রতীপে। তাঁর ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ই ছিল ধুতিপাঞ্জাবি বা বড়জোর ঢোলা পাজামা-পাঞ্জাবি। এমনকী প্যান্টের ক্ষেত্রেও দেখা যেত তা ঢিলেঢোলা। সম্রাট লিখেছেন, ‘… ওঁর অঙ্গে-অঙ্গে যেন একটা সময়ের আটপৌরে গৃহস্থ বাঙালিয়ানা বাঁশি বাজাচ্ছে।’
প্রথম ছবি ‘শেষের কবিতা’য় তিনি ছিলেন অমিত রায়। ‘সেদিন নবাগত নির্মলকুমারকে অমিত রায় রূপে দেখে দর্শকদের মধ্যে একটা আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছিল। দর্শক বলতে লাগল– এ যেন একদম রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস থেকে উঠে আসা চরিত্র।’ (সে বিনে আর জানে না– জানে না এ মন/ দিব্যেন্দু দে) প্রথম ছবিই তাঁকে রুপোলি পর্দায় প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল। পরবর্তী সময়ে ‘পরেশ’, ‘উপহার’, ‘কালিন্দী’, ‘ক্ষণিকের অতিথি’, ‘কমললতা’র মতো অসংখ্য ছবিতে তাঁর অসাধারণ অভিনয় দর্শককে মুগ্ধ করেছে। এর মধ্যে ‘কমললতা’ ছবিতে গহর গোঁসাইয়ের চরিত্রটিকে তাঁর জীবনের অন্যতম সেরা বলে মনে করেন অনেকেই। মহানায়ক ও মহানায়িকার সঙ্গে দাপটে অভিনয় করেছিলেন তিনি। ভোলা যায় না ‘ছায়াসূর্য’ ছবিতে ঘেঁটুর (শর্মিলা) কাকার চরিত্রে তাঁর অভিনয়ও। আবার ‘বাঞ্ছারামের বাগান’ ছবিতে করা ছোট্ট চরিত্র কিংবা আরও পরে ‘আতঙ্ক’ ছবিতে প্রৌঢ়ের অসহায়তাতেও তাঁর অভিনয় স্মরণীয়। কিংবা আরও পরে ‘দহন’-এর সেই দুঁদে উকিলের চরিত্রটি!
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
আরও পাতাবাহার: নির্দোষকেও নির্বাসনের শাস্তি দিতে পারে মিডিয়া ট্রায়াল
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………….
অভিনয়ের এই বিপুল কেরিয়ার কেবল ছায়াছবি নয়, নাট্যমঞ্চ কিংবা রেডিও নাটকেও ছড়িয়ে রয়েছে। আবার ছবির জগতে আসার আগে গল্পও লিখতেন তিনি। পরবর্তী সময়ে অভিনয়ের ফাঁকে ফাঁকেও চলেছে সাহিত্যচর্চা। সমরেশ বসুর মতো কিংবদন্তি সাহিত্যিক ছিলেন বন্ধু। ‘চৌরঙ্গী’র সংখ্যাটি সবদিকেই আলো ফেলেছে। নির্মলকুমারের সাক্ষাৎকার থেকে তাঁর নিজের লেখা আত্মকথার টুকরো, সহ-অভিনেতা, পরিচালকদের স্মৃতিচারণ, পরবর্তী প্রজন্মের শ্রদ্ধার্ঘ্য, নির্মলকুমারের জীবনের বিভিন্ন দিক নিয়ে প্রবন্ধ– দুই মলাটের মধ্যে ধরা রয়েছে সমগ্র শিল্পী-জীবনই। সেই সঙ্গে রয়েছে চলচ্চিত্রপঞ্জি, নাট্যপঞ্জি, জীবনপঞ্জি, শিল্পীর জীবন এবং তাঁর কাজের বিভিন্ন আলোকচিত্র। এর আগেও এই পত্রিকার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌম্যেন্দু রায় কিংবা জোছন দস্তিদার ইত্যাদি সংখ্যা পাঠকমহলে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এই সংখ্যাও সেই দলেই পড়বে নিঃসন্দেহে। যত্নের ছাপ পাতায় পাতায়।
তবে এই ধরনের সংখ্যার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ আসলে হারিয়ে যাওয়া সময়কেও ছুঁয়ে দেখা। নির্মলকুমারের জীবনের নানা পর্বের দিকে লক্ষ রাখার সময় সময়ের বালিও বুঝি ঝরে পড়ে সেখানে। বিশ্বরূপা-য় নাটক করার সময় তরুণ নির্মলকুমারকে সহ অভিনেতা ছবি বিশ্বাস স্নেহমিশ্রিত ধমক দিচ্ছেন, ‘আরো চার পা এগিয়ে দাঁড়াও, লাথি মারবো না হলে।’ নির্মলকুমার লিখছেন, ‘আমি তাড়াতাড়ি চার পা এগিয়ে গেলাম। দর্শক না হলে শুনতে পাবে না তো।’ কিংবা সুচিত্রা সেন ফোন করছেন নির্মলকুমারকে।
–এই নিমে, সকালে ক’টায় ঘুম থেকে উঠিস?
–যখন বলবেন, তখন উঠব।
–কাল রাত তিনটেয় উঠবি?
–অ্যাঁ! তিনটেয় উঠব কেন?
–আমি তিনটের সময় তোকে তুলব। যেখানে শুটিং করতে যাব সেখানে সকাল ছটায় সূর্যের আলো এলেই ক্যামেরা স্টার্ট করে দেবে। না হলে বেশি বেলা হলে আমায় নিয়ে শুটিং করতে অসুবিধে হয়।
এমনই নানা ব্যক্তিগত স্মৃতি। কিন্তু সময়ের প্রিজমে তা আর ‘ব্যক্তিগত’ থাকে না। পড়তে পড়তে নির্মলকুমার ও বাঙালির হারিয়ে যাওয়া সময় একাকার হয়ে যেতে থাকে। সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে এই দিকটাই। যে সময়টা হারিয়ে গিয়েছে, সেটাই দু’হাতে ধরা যাচ্ছে, এর চেয়ে চমৎকার অনুভূতি আর কী হতে পারে?
ছবি: ‘চৌরঙ্গী– নির্মলকুমার সংখ্যা’ থেকে সংগৃহীত
চৌরঙ্গী
নির্মলকুমার সংখ্যা
৪০০