ক’দিন আগে কলেজ স্ট্রিট গিয়ে ভাস্কর চক্রবর্তী কিনে এনেছি। ফেরার পথে একজন, বইয়ের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে আচানক বললেন, তোমাদের বয়সিরা এসব পড়ে? তিনি কে, কে জানে! এর উত্তরও আমার জানা ছিল না। কেন তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, তা কি আজ বুঝি? হয়তো বা! সেদিন শুধু বলেছিলাম, পড়ব বলেই তো নিয়ে যাচ্ছি। পড়তে শুরু করে দেখি, সে এমন বই যে বন্ধ করলেও বন্ধের নাম নেই। আসলে কবিতা বইয়ের কোনও মলাটই হয় না। কবিতারা স্বচ্ছন্দে মলাট পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, তারপর বই হাতে যে বসে থাকে, তার সঙ্গে অনবরত কথা বলে যায়।
১০.
মেস যে চিরকালের নয়, এমন কথা কস্মিনকালে আমাদের মাথাতেও আসেনি। কলেজ কেউ বাঙ্ক করলেও করতে পারে, মেস মিস করে না।
এমনকী, বন্ধুরাও, যারা মেসবাসিন্দা নয়। মেস তাদের কাছে বাইরের ঘর। পরিচিত হয় বন্ধুবান্ধবদের নামে। ক্রমে মেসের নেশা গাঢ় হয়ে এলে দিনে অন্তত একবার চুমুক না দিলে স্বস্তি নেই। কেউ কেউ এইভাবে দূরে থেকে কাছে, বাকিরা কাছে থেকেও দূরে। আমার ধারণা, মেস-ই আসলে তার বাসিন্দাদের চিনে নেয়। মেসের দরজা সচরাচর কারও জন্য বন্ধ হয় না বটে, তবে সবার জন্য দরজা ভিতর থেকে বন্ধ হয় না। মেস যাকে রাখে, সে বেশ থাকে।
কখনও মেসের চোখে পড়ে গিয়েছিলাম নিশ্চিতই। থাকার দায় সারে যে মেস, তার জানলায় হয় ঝুল, মেঝে স্যাঁতসেতে, নয় দরজায় ছিটকিনি লাগে না। একটা ভাঙাচোরা দেশের মানচিত্র যেন। সেইসব মেসের ভিতর আর একটা মেস থেকে যায়, গল্পে-গল্পে, বাঁচার রসদ নিয়ে। মেসের আগেও আমি মেসের সেই গল্পে ঢুকে পড়েছিলাম। তখন গড়িয়া-যাদবপুর হাতে ঘটাং স্টার্ট দেওয়া অটো। পেয়িং গেস্টে যেহেতু মাসোহারা খরচ, তাই দিনে গোটা পাঁচেক টাকা এক্সট্রা গেলে মাসের শেষে খুব একটা টেনশন নেই। গড়িয়া শীতলা মন্দির পেরিয়ে, জোড়া পেট্রোল পাম্প থেকে উলটোদিকে হাঁটা দিলে শ্মশান। তারই কাছাকাছি একটি বাড়ির দোতালায় তখন মাথা গুঁজেছি। কলকাতায় ডানা ভেঙে এসে পড়ে এর আগে টালিগঞ্জ চত্বরে বেশ কিছুদিন কেটে গিয়েছে। স্টুডিওপাড়ার গল্পগুলো অতি উত্তম কিনা সেদিন পরখ করা হয়নি। জীবন সিনেমার মতোই। তবে তিন ঘণ্টায় ফুরোয় না। যাদের ডানা ভাঙে তাদের অনেক হেঁটে হেঁটে নতুন উড়ান জোগাড় করতে হয়। সেদিন তাই শুধু বাসের জানলায় টেকনিশিয়নের দরজা ভেসে এলে বুঝতাম– চণ্ডিতলা এল বলে। এবার নামার উদ্যোগ করতে হবে।
পিসিমার নিরিবিলি ফ্ল্যাটে তখন আস্তানা। সদ্য ঘরের মায়া বিদায় নিয়েছে বলেই বাইরের টান কিঞ্চিৎ বেশি। পড়া সারার বালাই নেই, সন্ধেবেলা শান্ত পাড়া ঘুরতে ঘুরতে তাই মালঞ্চ-এর সামনে। ভ্রু-পল্লবে ডাক দিলে, এ শহরে সব দেখা হয় সিঙ্গল স্ক্রিনে। সিনেমাই সিঙ্গল আর যুগলকে এক হলে বেঁধে রাখে। ক’দিন আগেই বাসে শুনেছি এক ভদ্রলোক বলছেন ‘যুগলসের সামনে বেঁধে দেবেন’। ভাবি, অবাক হয়ে, যুগল তো এমনিই বহুবচন, আবার যুগলস কেন! পরে অবশ্য ভ্রম কেটেছে। যা হোক, সিনেমাহলের চারপাশের জীবনে বরাবরই যেন রঙিন কাগজের নকশা ঝোলানো। ফুল ফোটে তাই মালঞ্চ-এও। সেসব পেরিয়ে যেতে যেতে ঘাড় উঁচু করে একবার দেখে নিই উপরে রাজত্ব করছেন ‘ফনা’ আমির খান, কিংবা শাহরুখ বলছেন ‘কভি আলবিদা না কহেনা’। কলেজ আসা-যাওয়ার পথেই ‘প্রিয়া’, পোস্টার বদলে গেলে চলন্ত বাসের জানলা থেকে মনে হয়, রাস্তা বুঝি বা পোশাক বদলেছে। রাসবিহারীতে দাঁড়িয়ে দেখি ‘শূন্য এ বুকে’। ওদিকে হাতজোড় মাদার টেরিজা। এক ভাবেই দাঁড়িয়ে। পোস্টার শুধু বদলে বদলে যায়, কলকাতার অঙ্গরাগ। সিনেমা দেখা তখনও যৎসামান্য। কলেজ বুঝে নেওয়ার ঠেলায় কলজেয় হাওয়া লাগে না। মাঝে শুধু একদিন ‘প্রিয়া’তে শনিবার দুপুরবেলা গিয়ে দেখে এসেছি ‘দোসর’। লোকজন বিশেষ ছিল না। ‘নন্দন’ তখনও নিয়মিত নয়। ‘বং কানেকশন’ এর ঠিক আগে না পরে খেয়াল নেই। তবে, সে ছবিই মূলত কলেজপড়ুয়াদের হলে হাতছানি দিয়ে ডাকল। ভাষা, অ্যাপ্রোচ সবদিক থেকেই বেশ আমাদের মনের মতোন। রাইমা সেন পাগলা হাওয়ার বাদল দিনে যাবতীয় পাগলামিকে প্রশ্রয় দিয়ে সেই যে তাকালেন ক্যামেরায়, তাঁকে উপেক্ষা করে সাধ্য কার! ‘চোখের বালি’ই চোখের মণি হয়ে উঠলে ‘নৌকাডুবি’ স্রেফ সময়ের অপেক্ষা মাত্র!
যাই হোক, মালঞ্চে অবশ্য তখন ঢুঁ দেওয়ার জো নেই, অতএব বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখাই সার। দেখে হাঁটতে হাঁটতে ইন্দ্রপুরী পেরিয়ে, কিশোরকুমারকে ডানদিকে রেখে আবার বাড়ির রাস্তায় ঢুকে পড়া। আলো-অন্ধকারে যাই, মাথার ভিতর যদিও কোনও বোধ কাজ করে না। বোধহয়, সন্ধের ওই চক্করটা ছিল পল দু’পল সবকিছু থেকে পালিয়ে বেড়ানো। কেননা, সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরও আছে, যে, পড়ার বয়সে পড়তে মানুষের মোটেও ভালো লাগে না। তায় আবার শুকনো মেকানিকস্!
……………………………………………
এফএম স্টেশন জুড়ে তখন বাংলা আধুনিক গানের কেউ বলে ফাল্গুন কেউ বলে পলাশের মাস। আমি জানি, আমার সর্বনাশ। সেমি কন্ডাক্টর কি আর জানে ব্রহ্মা কী কী জানে! আমার সেই একলা ঘরের দেশে ম্যাপ পয়েন্টিংয়ের বিন্দুতে বিন্দুতে তখন শ্রীকান্ত, লোপামুদ্রা, রূপঙ্কর, মনোময়, শমীক, শুভমিতা। আমি তাঁদের সঙ্গে বসে বইয়ের পাতা ওলটাই দু’-চার। দূরে শ্মশান নিজের মতো অপেক্ষা করে। প্রতিদিন অবশ্য সেখানে শোক ডুকরে ওঠে না।
……………………………………………
সেই আপাত নিরীহ টালিগঞ্জ পাড়ার তুলনায় গড়িয়া যেন অনেক মুখরা। কিছুদিন পর অনিবার্য কারণে যখন সিনেমাপাড়া দিয়ে যাতায়াত বন্ধ করতে হল, তখন এই কোলাহলকে হলাহল না ভেবে, মোড়ের সঙ্গেই বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিতে হল দ্রুত। সবথেকে বড় কথা, এইখানে থাকতে গিয়ে বুঝলাম, শ্মশানের নৈঃশব্দ্য কথাটা সর্বৈব সত্যি নয়। আমার দোতালার জানলা দিয়ে যতটুকু দেখা যায়, তার থেকে শোনা যায় বেশি। শোক সর্বদা নীরব নয়, শব্দ প্রার্থনা করে। সে-শব্দের অর্থ থাক বা না-ই থাক। একদিন রাতে ঘুমের ভিতর সেরকমই শব্দ শুনে চমকে উঠে বসেছি। জানলা সব খোলা, মাথার উপর বনবন করে ফ্যান ঘুরছে। বাইরের চাঁদ ঘরেও খানিক ঘোরাঘুরি করছে আর তার মধ্যে ঢেউ-বাতাসে ভেসে ভেসে আসছে সেই শোকধ্বনি। কে চলে গেছেন, কেই-বা তাঁর জন্য আকুল, আমি জানি না। শুধু সেই ধ্বনিটুকু আমার কানে থেকে গেল। এখনও। নির্জন ঘরে কোনোদিন জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে খানিক আলপনা এঁকে দিলে আমি স্পষ্ট শুনতে পাই মানুষের জন্য মানুষের সেই পিছুডাক। কাকে যেন ফিরে পাওয়ার কাতরতা। যে চলে গেছে সে ফিরবে না জেনেও যে-আর্তি বাতাসে আরও কিছুক্ষণ থেকে যেতে চায়। জীবন্তের পৃথিবীতে সেটুকুই প্রাণ। পূর্ণচ্ছেদ অভ্যেস মাত্র, লেখার, জীবনেরও। সে অভিজ্ঞতার কাছাকাছি এলে বোঝা যায় পৃথিবী বস্তুত পলকা দু-একটা সাদা খই বই নয়! ইচ্ছেখুশি উড়ে যায় এলোমেলো।
সেই ঘর থেকে মাত্র কয়েক পা হেঁটে এলে আবার রাস্তার স্বর পালটে যায়। যেন স্কেলটাই বদলে গেল। বাজার শুরু হওয়ার আগে থেকেই তার হালকা একটা আভাস থাকে শব্দে। শীতলা মন্দির থেকে যত মোড়ের দিকে যাওয়া যায় সেই শব্দটার ভিতর যেন ঢুকে পড়া। সত্যি বলতে তার কোনও কেন্দ্র পাওয়া যায় না। যে কোনও বাজারের এ-এক অদ্ভুত মজা। কোনও এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে যেদিকে ঘাড় ঘোরানো যায়, মনে হবে, বাজারটা যেন অন্য দিকে খানিক বেশিই ঝুঁকে আছে। অনেকটার জীবনের মতোই। গড়িয়ার মোড় ধরে ঘুরতে ঘুরতেই একদিন তা প্রথম টের পেলাম। যদিও পুরো জায়গাটা ঠিক বাজার নয়, তবু রাস্তার দু’পাশ জুড়ে হরেক বিকিকিনি। লোক, অটো, সাইকেল মিলিয়ে মিশিয়ে বেশ বাজারেরই আয়োজন। মূল বাজারটা রাস্তার এক পাশে, একটু আবডালে। তবু এই ব্রিজ পেরিয়ে পুরো রাস্তাটা হাঁটতে হাঁটতে এসে যদি মোড়ের একদম মাথায় দাঁড়ানো যায়, মনে হবে বাজারটা বুঝি এন্ড্রুজ কলেজের দিকে কিঞ্চিৎ ঝুঁকে আছে, কিংবা নাকতলার দিকে লম্বা হয়ে গেছে। শনি-কালী মন্দিরে পুজো হয়, রিকশার রূপকথায় শব্দ খানিক বেশিই। ঠিক ওইখানটায় বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকা যায় না। কোনোদিন তাই বেঁকে যাই কলেজের দিকে, কোনোদিন গঙ্গা কিংবা খালের পার দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কাঠের বান্টি ব্রিজ। সেই সব হাঁটার না ছিল কোনও উদ্দেশ্য, না বিধেয়। কিন্তু ওই নানান লোকের ভিড়ে হাঁটতে হাঁটতে মনে হত, এই এক সন্ধেযানে চড়ে সবাই যেন কোথাও না কোথাও চলেছি। যখন হাঁটা বন্ধ, তখন নেমে যাওয়া। তারপর ফিরে আসা সেই দোতলার ঘরে। জানলা খোলাই থাকে। রেডিওটা বাড়িয়ে দিই। এফএম স্টেশন জুড়ে তখন বাংলা আধুনিক গানের কেউ বলে ফাল্গুন কেউ বলে পলাশের মাস। আমি জানি, আমার সর্বনাশ। সেমি কন্ডাক্টর কি আর জানে ব্রহ্মা কী কী জানে! আমার সেই একলা ঘরের দেশে ম্যাপ পয়েন্টিংয়ের বিন্দুতে বিন্দুতে তখন শ্রীকান্ত, লোপামুদ্রা, রূপঙ্কর, মনোময়, শমীক, শুভমিতা। আমি তাঁদের সঙ্গে বসে বইয়ের পাতা ওলটাই দু’-চার। দূরে শ্মশান নিজের মতো অপেক্ষা করে। প্রতিদিন অবশ্য সেখানে শোক ডুকরে ওঠে না। সেদিন বুঝি, শ্মশান আদতে নিস্তব্ধতাই ভালোবাসে।
সেইসব একা একা ঘুরে ঘুরে কথা বলার সন্ধেগুলো অবশ্য কীরকম যেন ঘিসাপিটা হয়ে গেল দিনেদিনে। পেয়িং গেস্টে যেহেতু খাবার পাওয়া যায়, তাই রান্নাবান্নার চিন্তা নেই। পড়াশোনা বিস্তর পড়ে আছে, কিন্তু পড়ার ইচ্ছে নেই। পিসিমার বইয়ের ভাঁড়ারে থাকা যত জয় গোস্বামী পড়া হয়ে গেছে। আবার পড়তে ইচ্ছে করে, লোকনাথ ভট্টাচার্যের ‘ভোর’, ‘বাবুঘাটের কুমারী মাছ’। কিন্তু সে এখন নাগালের বাইরে। ক’দিন আগে কলেজ স্ট্রিট গিয়ে ভাস্কর চক্রবর্তী কিনে এনেছি। ফেরার পথে একজন, বইয়ের প্যাকেটের দিকে তাকিয়ে আচানক বললেন, তোমাদের বয়সিরা এসব পড়ে? তিনি কে, কে জানে! এর উত্তরও আমার জানা ছিল না। কেন তিনি প্রশ্ন করেছিলেন, তা কি আজ বুঝি? হয়তো বা! সেদিন শুধু বলেছিলাম, পড়ব বলেই তো নিয়ে যাচ্ছি। পড়তে শুরু করে দেখি, সে এমন বই যে বন্ধ করলেও বন্ধের নাম নেই। আসলে কবিতা বইয়ের কোনও মলাটই হয় না। কবিতারা স্বচ্ছন্দে মলাট পেরিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে, তারপর বই হাতে যে বসে থাকে, তার সঙ্গে অনবরত কথা বলে যায়। এ আসলে খুবই অনর্গল ঘটনা, তবু লোকে বলে গম্ভীর মানুষ! সেই শ্রেষ্ঠ কবিতার বইটা কোথায় যেন হারিয়েও ফেলেছিলাম। পরে একবার মেলা থেকে ভাস্করের দুটো খণ্ড কিনে দিয়েছিলেন ধীরাজদা, ধীরাজ বোস, যিনি ‘রবিশস্য’ পত্রিকার সম্পাদক। আর একজনও পাতায় পাতায় ঘোরাচ্ছেন তখন, মলাটের এ-পার ও-পার হওয়ার পরেও খেয়া পারাপার বন্ধ নাহি রে আজিকে। পূর্ণেন্দু পত্রী, ‘কথোপকথন’। প্রথমটার সঙ্গে দেখা হল যাদবপুরে, দিবাকরের পুরনো মেসে, ওরই বইয়ের থাকে। বোধহয় মেসের সঙ্গে সেই আমার প্রথম কি দ্বিতীয় দেখা। হাতে করে এনেছিলাম, আর ফেরত দিইনি। আজও আমার কাছেই আছে। যাদবপুরের সঙ্গেও সেই আমার গোড়ার কথোপকথন।
কলেজ শেষে প্রায়শই তখন বন্ধুর মেসে। গল্প করি। বেরিয়ে চা খাই। আস্তে আস্তে বুঝতে পারি আমি গড়িয়া থেকে যাদবপুরের দিকেই ঝুঁকে পড়ছি ক্রমশ। কিন্তু ডেরা আলাদা বলে প্রতিদিন ফিরতে হয়। এক একদিন সন্ধে গড়িয়ে গেলে সে-বাড়ির মালকিনের থেকে ফোন আসে, ‘তুমি ফিরছ?’ বলি, ‘এই আর একটু পরে।’ বন্ধু চোখ মট্কে বলে, ‘কেমন তোর খোঁজখবর রাখে, বল!’ তা বটে। যাঁদের পেয়িং গেস্ট, তাঁদের বাড়িতে সাকুল্যে জনা চারেক। স্বামী-স্ত্রী, তাঁদের বয়স্কা মা, আর একমুঠো জোনাকি আলোর মতো বাড়ির খুদেটি। কথা বলতে পারে না, হাঁটতেও না। মাঝেমধ্যে সে মায়ের সঙ্গে আমার ঘরে এলে দিব্যি জিনিসপত্র ওলটপালট করতে পারত। যা যেখানে আছে, তা ছুড়ে ফেলে ভারি মজা পায়। বাচ্চারা ব্যাকরণ মানে না। ভারি ভালো লাগে তাকে। তাক করে যাতে সে শুধু আমার ছোট্ট রেডিওটা ধরে টান না-মারে সেদিকেই আমার খেয়াল। মোটামুটি মিনিট দশেক সে ঘরে থাকলেই ঝড় উঠেছে, বাউল বাতাস। একদিন মেসের আড্ডা শেষে গড়িয়ার কোলাহলকে অবজ্ঞা করে বাড়ি ঢুকলাম। কিন্তু যে সময়ে বাড়ির কাজের দিদি খাবার দিয়ে যান, সেদিন ঘড়ি ঘুরে যায়, তিনি আর আসেন না। কী হল? চিন্তিত সামান্য। একটু পরে তিনি আসেন, খাবারও দেন। আর সেই সঙ্গে জানান, সেদিন বিকেলেই বাচ্চাটিকে নিয়ে তার মা নাকি বাড়ি ছেড়ে চলে গেছে। আর ফিরবে না। বাড়িতে চাপা অশান্তি।
সেই টাকা-দিয়ে-থাকা বাড়ির জন্য হঠাৎ কেমন যেন খারাপ লাগে। কচিমুখটাকে আর যদি কখনও না দেখি! মনে হল, এখুনি টের পেলাম খুব প্রিয় একটা বই কোথায় যেন হারিয়ে ফেলেছি।
…পড়ুন মেসবালক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ৯। বোবার শত্রু নেই, বন্ধু তো আছে
পর্ব ৮। মেস কি কোনও নারীচরিত্রবর্জিত একাঙ্ক নাটক!
পর্ব ৭। যে ভাতের হোটেলে মাছকে ‘তেরা ক্যায়া হোগা কালিয়া’ বলতে হবে না, সেখানেই রোজের বেঞ্চি বুক করতাম
পর্ব ৬। মেসের বাড়ি না থাকলে দেশের বাড়িকে ঠিক চেনা যায় না
পর্ব ৫। মেসে থাকতে গিয়ে বুঝেছিলাম বিছানা আর বেডের মধ্যে বিস্তর তফাত
পর্ব ৪। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ কখনও মেসে থাকেননি
পর্ব ৩। মেস আসলে জীবনের ক্রিকেট-সংস্করণ
পর্ব ২। আদরের ঘরের দুলালদের সদর চেনাল মেস
পর্ব ১। মেস এমন দেশ যেখানে বাঁধাকপির পৃথক আত্মপরিচয় চিবিয়ে নষ্ট করা যায় না