শেষবারের মতো তালা দিলাম দরজায়। বহুবার এই ঘরে বন্ধুরা মেতেছি তরজায়। সেসব নয় আবার নতুন করে ফিরে পাওয়া যাবে। শুধু পড়ে রইল সেই শোকধ্বনিতে জেগে ওঠা মাঝরাত্তির। মাথার কাছের জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়া চাঁদের আলোয় ছায়া গুলে আলপনা আঁকার মুহূর্ত। সেই খুদেটার সব ওলটপালট করে দেওয়া ঝড়। একা একা রাত অব্দি আমার গানের সঙ্গে ঘর করা। মাথার কাছে বসে রেডিও-র রাত জাগা। আর অন্নদা দিদির সেই সস্নেহ বলা, তোমাকে আমি রান্না করে পাঠিয়ে দেব। ঘর যেমনই হোক, ছেড়ে যাওয়া ঘরে মেরা কুছ সামান থেকেই যায়।
গ্রাফিক্স: দীপঙ্কর ভৌমিক
১১.
হারিয়ে যাওয়া সবকিছুর সঙ্গে একদিন আবার যদি হঠাৎ দেখা হয়ে যায়, তবে কেমন হবে! ভাবি। হারানো লাট্টু, লেত্তি; হারিয়ে যাওয়া বই, পেন, পোশাক, বন্ধু; হারিয়ে যাওয়া আমি! সে বড় সুখের সময় নয়। হারিয়ে পাওয়ার ভিতর হয়তো বস্তুগত আনন্দ আছে, হারিয়ে যাওয়ার ভিতর মাথুর। যে-দেখা আর কখনই হবে না, সেই দেখাটির জন্য জীবনভর অপেক্ষার একতারা একা একা বেজে যায়।
যে-বাচ্চাটি রঙচঙে বেলুনের খুশি হয়ে আসত ঘরে, তার সঙ্গে সঙ্গত আমার আর দেখা হবে না কোনও দিন। অথবা হয়েছে। এই শহরের কোনও বাস-ট্রাম-মেট্রোয়। হেঁটে যাওয়া ফুটপাথে কখনও, কোনও দিন। পরস্পরকে স্বভাবতই চিনতে পারিনি আমরা। সত্যি বলতে, খুব কম মানুষকেই তো চিনি আমরা। মানুষে মানুষে অচেনা এখনও জমে আছে বলেই আছে মানুষে মানুষে আগ্রহ। সোনালি ধানের উৎসব আষাঢ়ের কাছে অচেনা, তবু সেই দূরত্বেই জীবনের যাবতীয় শস্য।
যে ক’দিন তারপর ছিলাম সে-বাড়িতে, বাচ্চাটি ও তার মা আর ফিরে আসেনি।
গড়িয়া থেকে আমি তখন পুরোপুরি যাদবপুরের দিকেই ঝুঁকে পড়েছি। এদিকে সামনে সেমিস্টার। এর মধ্যে ঘর খোঁজা, লটবহর সরানো বেশ কঠিন। আরও শক্ত একেবারে নতুন সিস্টেম তৈরি করে তার ভিতর গুছিয়ে বসা। মাসের পর মাস ফাঁকি জমে জমে পড়া এখন কয়েক দিস্তে। সেসব শেষ মুহূর্তে রাতদিন জেগে সাবাড় করার দরুন বদহজমের এমনিতেই চূড়ান্ত সম্ভাবনা। তাও গোঁতা খেয়ে তোতাপাখি হয়ে কিছু একটা দেখে নেওয়া যাবে’খন, কিন্তু সেটুকুও না হলে শিয়রে সাপ্লি। সিজিপিএ, ওয়াইজিপিএ আর ভারতের জিডিপি ক্যালকুলেশন এমন জটিল যে কখনই সহজে কনক্লুশনে পৌঁছনো যায় না। রিস্ক না নিলে গেন হয় না জানি, তবে তারপর পেন হলে ঠেকায় কে! অতএব সিদ্ধান্ত নেওয়া গেল, মাসখানেকের ব্যাপার, সিনেমার প্রসেনজিতের মতো দাঁতে দাঁত চিপে কাবার করে দিলেই হল। কিন্তু খাবার আসে কোত্থেকে? ঘটনার পরপর দিন দুই-তিন সমস্যা ছিল না। একদিন হল, অবধারিত। সে-বাড়িতে কাজ করতেন যে দিদি, তিনি এসে বললেন, বাড়ির কারওই মনমেজাজ ভালো নেই। স্বাভাবিক। ওঁরা ইদানীং এখানে থাকছেনও না, অন্য ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করছেন। আমি যেন খাবার-দাবারের একটা ব্যবস্থা করে নিই। এই পড়লাম অকূল-পাথারে। আমার পরাণ যাহা খায়, কে খাওয়ায়? এতদিন সে-চিন্তা কখনই সেভাবে ছিল না। এক-আধদিন নয় ম্যানেজ করে নেওয়া যায়। দিনের পর দিন চলবে কী করে? না আছে সরঞ্জাম, না জানি রান্না। দিনকয় দিনে ভাতের হোটেল, রাতে রুটি করে চলল।
একদিন রাতে বাড়ির মালিক– দাদা বলেই ডাকতাম– তাঁর সঙ্গে দেখা। আমার পাশের ঘরটিই ছিল তাঁর কাজের জায়গা। অনেক রাতে সেখানে খুটখাট শুনে সে-ঘরের দরজায় উঁকি দিলাম। দেখি, চেয়ারে বসে আছেন বটে, তবে কাজ তেমন কিছু করছেন না। আগে রাত জেগে তাঁকে এই ঘরেই মগ্ন থাকতে দেখেছি। সিভিল-ইন্টিরিয়রের কাজ ছিল তাঁর। আমায় দেখে ডাকলেন, বসলাম গিয়ে উলটোদিকের চেয়ারে। বুঝলাম, তিনি ঈষৎ নেশাগ্রস্ত।
বললেন, ‘সবই তো শুনেছ!’
আমি ঘাড় নাড়ি। জানি তো সবই। অনেকক্ষণ চুপচাপ। কেউই কথা বলি না। বন্ধুবান্ধবদের আজব প্রেমের গজব কাহিনি বাদ দিলে, সেই প্রথম একটা ভাঙা সম্পর্কের তীব্র এবড়োখেবড়ো টের পাচ্ছি। অস্বস্তিকর খরখরে সেই নীরবতা। জানতে ইচ্ছে করে, কেন তিনি চলে গেলেন? বাচ্চাটির সঙ্গে আর যোগাযোগ করা যাবে কি-না! খুব কাছের মানুষ চলে গেলে নিজেকে কি অংশত মেঘলা মনে হয়? নাকি নিজেরই খানিকটা মিলিয়ে যায় চিরতরে! মুখে অবশ্য কথাটি সরে না। সেই অদ্ভুত রাতে, কী করে যেন আমি শিখে যাই, আমাদের এত এত কথার ওপারে এমন একটা জায়গা আছে যা আদতে এক মস্ত সাদা খাম। কোনও কথাই সে প্রত্যাশা করে না। বহুদিন পর কাশ্মীরে, অনেকটা উঁচুতে, গন্ডোলা থেকে নেমে বিস্তীর্ণ বরফের সাম্রাজ্যের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, এই বুঝি কথাহীন নীরবতায় জমে থাকা সেই সাদা পৃথিবী।
কতক্ষণ বসে ছিলাম খেয়াল নেই। হঠাৎ শ্মশান থেকে চেনা আওয়াজ ভেসে আসায় ভদ্রলোক সংবিৎ পেলেন। আমিও। বললেন, ‘জানি তোমার সমস্যা হচ্ছে। একটু ম্যানেজ করে নিও।’ টাকা-পয়সা নিয়েও কোনও সমস্যা হবে না, তা-ও জানালেন। আমি আরও একটু থেকে, এবার ‘আসি’ বলে উঠে পড়লাম। তিনি ঘাড় হেলালেন আলতো। গেট পেরিয়ে যাওয়ার সময় শুধু বললেন, ‘মন দিয়ে পোড়ো কিন্তু।’ আমি তাকাই, হাসি। বোধহয় তিনিও জানেন, সে-বাড়িতে থাকার পালা আমি গুটিয়ে ফেলব ক্রমশ। আর কি দেখা হবে কখনও? সম্ভবত দু’জনেই জানতাম, না হওয়াই স্বাভাবিক। হয়ওনি।
অতএব যাদবপুর। মেস যেন রাজার চিঠি। বিকেলে দিবাকরের সঙ্গে বেরিয়ে ঘর খুঁজতে থাকি। তারও তো একটা নতুন মেস দরকার। ‘ব্রোকার’ যাঁদের চিনি সবাইকে বলি। খুব বেশি খুঁজতে হয় না, পেয়েও যাই। মাঝে শুধু ক’টা দিন আর পরীক্ষা। একদিন সকালে না-পড়লেই-নয়; বইয়ে মুখ গুঁজে। সেই দিদি এলেন ঘর পরিষ্কার করতে। তাঁকে বললাম, নতুন মেস খুঁজছি। পরীক্ষাটা হলেই চলে যাব। তিনি বললেন, সেই ভালো। এখানে বাড়ির আর কেউ থাকতে চাইছেন না। বেশিরভাগ দিন কেউ থাকেনও না। ফলত ওঁদের ফ্ল্যাট তালা-বন্ধ। আর উপরের ফ্লোরে আমি একা। দিদির মতে, একা একা এভাবে থাকা মোটেও কাজের কথা না। কথায় কথায় জানতে চাইলেন, কীভাবে এখন খাওয়াদাওয়া করছি। সব শুনে মুহূর্তমাত্র সময় না নিয়ে বললেন, ‘শোনো তুমি বোধহয় জানো না, আমার বর এখানেই কেয়ারটেকারের চাকরি করে।’ বোঝো কাণ্ড! তাঁকে তো রোজই দেখি। ওঁদের দু’জনকে কথা বলতেও দেখেছি। তাঁরা স্বামী-স্ত্রী জানব কী করে! দিদি বললেন, ‘একটু দূরেই আমাদের বাড়ি। তোমার জন্য আমি দু’বেলা রান্না করে বরের হাতে পাঠিয়ে দেব। কাউকে কিছু বলার দরকার নেই।’
কাউকে বলব আর কী! এত দ্রুত তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আর দ্ব্যর্থহীন জানিয়ে দিলেন যে আমার বলার কথা কিছু গুছিয়েই উঠতে পারলাম না। এমনকী, টাকা-পয়সার কথাও জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম। আশ্চর্য, যে দিদি ভুল করেও সে-কথা মুখে আনলেন না। যেন, সেইটে সবচে’ অপ্রাসঙ্গিক। অথচ গোটা দুনিয়া বিপরীতে ঘুরছে। সেদিন সন্ধে পেরিয়েই ফিরেছি। দেখি খানিক পরেই আমার স্টিলের তিন-থাকিতে খাবার পাঠিয়ে দিয়েছেন তিনি। রাতে একলা ঘরে খেতে বসলাম। বন্ধু রেডিওটা তখনও সারেঙ্গি। একলা যুবকের কিছু কথা সে-ই শুধু জানে যা আর কেউ জানে না; কিছু মুহূর্তের সে-ই শুধু একান্ত সাক্ষী। যেমন এই মুহূর্তেরও। খেতে খেতে সেদিন মনে হল, ভাগ্যিস পণ্যায়িত পৃথিবী এখনও স্নেহ পদার্থটিকে স্পর্শ করতে পারেনি। আজও তার বীজধান তোলা আছে হৃদয়ে কারও। এখনও তা-ই বিশ্বাস করি। যত কমপিউটর আসুক, আর যাই ছাই এআই, পৃথিবী যতই যুক্তি-প্রযুক্তিতে ভাগ-বাঁটোয়ারা হোক, মানুষের ঋণ তবু শেষ অব্দি মানুষের কাছেই।
……………………………………………….
খুব কাছের মানুষ চলে গেলে নিজেকে কি অংশত মেঘলা মনে হয়? নাকি নিজেরই খানিকটা মিলিয়ে যায় চিরতরে! মুখে অবশ্য কথাটি সরে না। সেই অদ্ভুত রাতে, কী করে যেন আমি শিখে যাই, আমাদের এত এত কথার ওপারে এমন একটা জায়গা আছে যা আদতে এক মস্ত সাদা খাম। কোনও কথাই সে প্রত্যাশা করে না। বহুদিন পর কাশ্মীরে, অনেকটা উঁচুতে, গন্ডোলা থেকে নেমে বিস্তীর্ণ বরফের সাম্রাজ্যের সামনে দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল, এই বুঝি কথাহীন নীরবতায় জমে থাকা সেই সাদা পৃথিবী।
……………………………………………….
পরীক্ষা এল যথানিয়মে। ক’টা দিন পড়া ছাড়া, খাওয়া নিয়ে আর একটা মুহূর্তও ভাবতে হয়নি। পরীক্ষা শেষ হতেই সব বাঁধাছাদা করে নিলাম দুই বন্ধু মিলে। তারপর গাড়ি ভাড়া করে সোজা যাদবপুরের মেস। কথাবার্তা তো পাকা-ই ছিল। বেরনোর আগে দিবাকর আমার ছেড়ে-যাওয়া-ঘরের কোনা কোনা দেখে নিল। কিছুই পড়ে থাকছে না। শেষবারের মতো তালা দিলাম দরজায়। বহুবার এই ঘরে বন্ধুরা মেতেছি তরজায়। সেসব নয় আবার নতুন করে ফিরে পাওয়া যাবে। শুধু পড়ে রইল সেই শোকধ্বনিতে জেগে ওঠা মাঝরাত্তির। মাথার কাছের জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকে পড়া চাঁদের আলোয় ছায়া গুলে আলপনা আঁকার মুহূর্ত। সেই খুদেটার সব ওলটপালট করে দেওয়া ঝড়। একা একা রাত অব্দি আমার গানের সঙ্গে ঘর করা। মাথার কাছে বসে রেডিও-র রাত জাগা। আর অন্নদা দিদির সেই সস্নেহ বলা, তোমাকে আমি রান্না করে পাঠিয়ে দেব। ঘর যেমনই হোক, ছেড়ে যাওয়া ঘরে মেরা কুছ সামান থেকেই যায়।
যাবার আগে দিদির বরের হাতে চাবি দিলাম। খাওয়া-দাওয়ার দরুন টাকার কথা বলতেই প্রবল আপত্তি। আচ্ছা বেশ, হিসেবপত্তর চুলোয় যাক, মিষ্টি খাওয়াতে তো পারি। তাতে তিনি রাজি। বললাম, ‘দিদির সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।’ বললেন, ‘সে তো এখন বাড়িতে।’ বাড়ি কোথায়? ঠিকানা বাতলে দিলেন। দুই বন্ধুতে খুঁজে খুঁজে গিয়ে পৌঁছলাম সেখানে। বসলাম তাঁর ঘরে, খানিকক্ষণ। কোথায় যাচ্ছি, কোথায় থাকব খোঁজ নিলেন। ফেরার সময় হল। দিদি, হাত ধরে বললেন, ‘ভালো থেকো।’ মোটে দু’শব্দের ভিতর কী নিশ্চিন্তে থেকে যায় মানুষ। আমিও বলি– ভালো থেকো।
আমরা কেউ-ই জানি না, কে কীভাবে ভালো থাকব। তবু আমাদের মন্দের ভালো বেঁচে থাকার গায়ে আলতো আহ্লাদে লেগে থাকে এই ‘ভালো থেকো’ পূর্ণিমা। শহর কবজা করা কুবেরের বিষয়আশয় তা নয়। তারা আর কী করে বুঝবে ছড়িয়ে ছটিয়ে টুকরো হয়ে স্মৃতির উচ্ছিষ্ট নিয়ে মানুষের এই বেঁচে থাকা, ‘তবু সব বৃক্ষ আর পুস্পকুঞ্জে যে যার/ ভূমিতে দূরে দূরে/ চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা।’
…পড়ুন মেসবালক-এর অন্যান্য পর্ব…
পর্ব ১০। বই বন্ধ করলেও, বন্ধ হয় না কিছু কিছু বই
পর্ব ৯। বোবার শত্রু নেই, বন্ধু তো আছে
পর্ব ৮। মেস কি কোনও নারীচরিত্রবর্জিত একাঙ্ক নাটক!
পর্ব ৭। যে ভাতের হোটেলে মাছকে ‘তেরা ক্যায়া হোগা কালিয়া’ বলতে হবে না, সেখানেই রোজের বেঞ্চি বুক করতাম
পর্ব ৬। মেসের বাড়ি না থাকলে দেশের বাড়িকে ঠিক চেনা যায় না
পর্ব ৫। মেসে থাকতে গিয়ে বুঝেছিলাম বিছানা আর বেডের মধ্যে বিস্তর তফাত
পর্ব ৪। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথ কখনও মেসে থাকেননি
পর্ব ৩। মেস আসলে জীবনের ক্রিকেট-সংস্করণ
পর্ব ২। আদরের ঘরের দুলালদের সদর চেনাল মেস
পর্ব ১। মেস এমন দেশ যেখানে বাঁধাকপির পৃথক আত্মপরিচয় চিবিয়ে নষ্ট করা যায় না