বাংলাতেও আদি চার হাতের মূর্তি ফিরে ফিরে আসছে। আমি তাতে অসুবিধা দেখি না। হতে পারে, বাঙালিচোখ এই মূর্তি দেখতে অভ্যস্ত নয়। তাই খটকা লাগতে পারে। এ-কথাও ঠিক যে, বাঙালির সামাজিক মানচিত্র থেকে বাঙালি ক্রমশ কমছে। ফলত ভিন প্রদেশের সংস্কৃতির খানিক খানিক ছায়া আজকাল প্রকট হয়ে উঠছে বলেই দেখতে পাই। গণেশ মূর্তির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এর পিছনে নির্দিষ্ট কোনও অর্থনৈতিক কারণ আছে কি-না, তা আলাদা আলোচ্য বিষয়, তবে সামাজিক কারণ তো নিশ্চিতই আছে।
সরস্বতী কি ‘বিদ্যেবতী’ বলেই তাঁর চার হাত?
তুলিকলা নিয়ে আজীবনের গেরস্থালি করেছি বলেই বোধহয় আমার দিকে এ-প্রশ্ন ছুটে আসে। ভাবি, সত্যিই তো ছোট থেকে ‘বীণা রঞ্জিত পুস্তক হস্তে’ দেবী ভগবতী ভারতীর দুটি হাতই দেখেছি। স্কুলে হোক বা মা দুগ্গার পাশে তাঁর এই রূপ দেখেই আমাদের আঁখি না ফেরে। সনৎ সিংহ মশায় যে গানে গানে তাঁকে খোলা চিঠি লিখে ফেললেন, আর সে-চিঠি একরকম বাঙালি বালকদের সর্বজনীন মনের কথা হয়ে উঠল, চোখ বুজলে কল্পনায় সেই সরস্বতী বিদ্যেবতীর দুই হাতের দেবীরূপই তো ভেসে আসে। অথচ অনতি-অতীতে আমাদের চারপাশে চার হাতের দেবীমূর্তি যে গড়া হচ্ছে না, তা কিন্তু নয়। এমনটা আমাদের সময়ে বড় একটা দেখিনি। এমনকী, বাংলা ছবির ঘরানাতেও চার হাতের সরস্বতী তেমন দেখা যায় না। নন্দলাল বসু দেবীর যে রূপ এঁকেছেন সেখানেও তাঁর দুই হাত-ই। অবশ্য রাজা রবি বর্মার ছবিতে বরাবর দেবীকে চার হাতেই দেখা গিয়েছে। অর্থাৎ কি না দেবীর চার হাত থাকতেই পারে। তবে, বাংলায় তার বড় একটা চল ছিল না।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
চার হাতের দেবী সরস্বতী বাংলায় দুই হাতের এই প্রচল রূপ পেলেন কী করে? এই বিবর্তনের মূল হল বাঙালির দুর্গাপুজো। সে পুজোও গোটা ভারতের থেকে অন্যরকম, অকালবোধন, আমরা জানি। এখন, দুর্গাকে ঘরের মেয়ে বলেই কল্পনা করে মঙ্গলকাব্যের বাংলাভূমি। শারদপ্রাতে মেয়ে আসে ঘরে, সঙ্গে আসে তার সন্তানসন্ততিরা। তাদের মধ্যে আছে সরস্বতী। দশভুজা দুর্গামূর্তির পাশে লক্ষ্মী এবং সরস্বতীকে দুই হাতের মূর্তি হিসেবেই কল্পনা করা হয়েছে। ফলত এই রূপই ছড়িয়ে পড়েছে বাংলায়, যা আজ বাঙালির কালেকটিভ মেমরিতে ঢুকে পড়েছে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
তাই বলে চার হাতে দেবীকে কল্পনা করা কিন্তু একেবারে অমূলক নয়। হিন্দুপুরাণ অনুযায়ী দেবীরূপের যে আদি ভাবনা, সেখানে কিন্তু তাঁর চার হাতই আছে। সেই সঙ্গে পাওয়া যাচ্ছে ময়ূরকে। অর্থাৎ দেবীকে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, সম্পদ, সৌন্দর্যের সম্মিলনমূর্তি হিসাবেই কল্পনা করা হয়েছে। রবি বর্মার ছবিতে দেবী তাই এই রূপে ধরা দিয়েছেন। রাজস্থানী ছবির ঘরানাতে, এবং অন্যান্য প্রদেশের পটগুলির দিকে তাকালেও সরস্বতীকে চার হাতেই দেখা যাবে। ব্যতিক্রম এই বাংলা। আমাদের মনে যে দুই হাতের দেবীমূর্তিই প্রতিষ্ঠিত, তার কারণ, মূর্তি হোক বা ছবিতে আমরা সরস্বতীকে সেভাবে দেখতেই অভ্যস্ত। বাংলার পট, পুতুলেও দেবীর দু’টি হাত। সুতরাং বাঙালিমানসে দেবীর এই মূর্তিই চিরস্থায়ী ছাপ ফেলেছে। তাহলে প্রশ্নটা গিয়ে দাঁড়াল এই জায়গায় যে, চার হাতের দেবী সরস্বতী বাংলায় দুই হাতের এই প্রচল রূপ পেলেন কী করে? এই বিবর্তনের মূল হল বাঙালির দুর্গাপুজো। সে পুজোও গোটা ভারতের থেকে অন্যরকম, অকালবোধন, আমরা জানি। এখন, দুর্গাকে ঘরের মেয়ে বলেই কল্পনা করে মঙ্গলকাব্যের বাংলাভূমি। শারদপ্রাতে মেয়ে আসে ঘরে, সঙ্গে আসে তার সন্তানসন্ততিরা। তাদের মধ্যে আছে সরস্বতী। দশভুজা দুর্গামূর্তির পাশে লক্ষ্মী এবং সরস্বতীকে দুই হাতের মূর্তি হিসেবেই কল্পনা করা হয়েছে। ফলত এই রূপই ছড়িয়ে পড়েছে বাংলায়, যা আজ বাঙালির কালেকটিভ মেমরিতে ঢুকে পড়েছে।
ইদানীং অবশ্য বাংলাতেও সেই আদি চার হাতের মূর্তি ফিরে ফিরে আসছে। আমি তাতে অসুবিধা দেখি না। হতে পারে, বাঙালি-চোখ এই মূর্তি দেখতে অভ্যস্ত নয়। তাই খটকা লাগতে পারে। এ-কথাও ঠিক যে, বাঙালির সামাজিক মানচিত্র থেকে বাঙালি ক্রমশ কমছে। ফলত ভিন প্রদেশের সংস্কৃতির খানিক ছায়া আজকাল প্রকট হয়ে উঠছে বলেই দেখতে পাই। গণেশ মূর্তির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। এর পিছনে নির্দিষ্ট কোনও অর্থনৈতিক কারণ আছে কি না, তা আলাদা আলোচ্য বিষয়, তবে সামাজিক কারণ তো নিশ্চিতই আছে। আমার মনে হয়, এই যে সরস্বতীর চার হাতের মূর্তি গড়া হচ্ছে, তাতে নতুন প্রজন্মের বাঙালি মৃদু চমকালেও তেমন আশ্চর্য হবে না। কেন-না এখনকার দিনে একটু রিসার্চ করে দেবীর আদিকল্পটি চিনে নেওয়া খুব কঠিন কাজ নয়। এবং তা যদি নতুন করে জানা যায়, তাহলে ক্ষতি তো কিছু নেই। শুধু একটা কথাই বলার যে, চার হাত করতে গিয়ে সরস্বতী মূর্তিকে কালী মূর্তি করে ফেলা চলবে না। দেখতে হবে, মূর্তির গড়নটি যেন ঠিক থাকে, ভারসাম্যের জায়গাটি যেন রক্ষিত হয়। একই সঙ্গে দৃষ্টিনন্দন হওয়া তো মূর্তি নির্মাণের আবশ্যিক শর্ত। মূর্তি যদি মূর্তির ব্যাকরণ মেনেই হয়, তাহলে চার হাত হলে অসুবিধা তো নেই, বরং দূরের অতীতকে আর একটু কাছ থেকে চিনে নেওয়া যাবে।
আমি নিজে অবশ্য চার হাতের সরস্বতী মূর্তি কখনও আঁকিনি। আদিতে চার হাত থাকলেও, আমার কাছে সরস্বতী দু’-হাতেও বিদ্যেবতী। তবে, নতুন যে শিল্পীরা কাজ করছেন, চার হাতের দেবীমূর্তি নির্মাণ করছেন, তাঁদের কাজ দেখেছি। নান্দনিকতার নিরিখে মূর্তিগুলি যে চমৎকার, তা কিন্তু কোনওভাবেই অস্বীকার করা যাবে না। আমাদের হিন্দু ধর্মের প্রাচীন সাবেকি এবং সনাতনী দেবী সরস্বতীর চিত্রকল্পের যত বর্ণনা রয়েছে এবং তার চিত্ররূপ রয়েছে, সেগুলো প্রায় সবই চার হাতের সরস্বতী দেবীমূর্তি, এবং তা সত্যিই মনোমুগ্ধকর এবং অনবদ্য। আমাদের কাছে ফিরে আসছে সেইসব আদি রূপই, যা নতুন প্রজন্মের কাছে শিক্ষণীয়।
…পড়ুন সরস্বতী পুজোর আরও ফিচার…
তন্ময় ভট্টাচার্য: সরস্বতী নদী ও আদিগঙ্গা: প্রচলিত মৃত্যু-তত্ত্বের বিপরীতে
অরিঞ্জয় বোস: প্রেমে ফেল করলে পাশ করায় পাশবালিশ
চিরন্তন দাসগুপ্ত: শুধু স্লেট-পেনসিলে নয়, পকেটমারিতেও হয় হাতেখড়ি
১৯৩৭ সালে পিল কমিশন প্যালেস্তাইনে ধর্মের ভিত্তিতে ভূখণ্ড ভাগের প্রস্তাব দেয়। এটাও ভারতের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গান্ধীজির পক্ষে মেনে নেওয়া অসম্ভব ছিল। কারণ এদেশেও তখন ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ অর্থাৎ ‘টু নেশন’ তত্ত্ব ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে।