বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ‘হাতে খড়ি’ নামের একটা গল্পে আমরা দেখি প্রধান চরিত্র মিটু হাতে খড়ি পাওয়ার আগেই লিখতে শিখেছে দেখে তার মা নিতান্ত আতঙ্কিত হয়ে বলে ওঠেন, ‘খবরদার খবরদার। আর অ আ মুখে এনো না। হাতে খড়ি না দিয়ে– মা সরস্বতীকে প্রণাম না করে পড়লে, কি লিখলে, কি কুল খেলে, মা ভয়ানক চটে যান। একেবারে বিদ্যা দেন না। খবরদার।’ অথচ আজ থেকে বছর পঞ্চাশেক আগে যখন আমার হাতেখড়ি হয়েছে তার অনেক আগেই স্লেট-পেনসিলে অ-আ লেখা হয়ে গিয়েছে আমার। তার জন্য কাউকে বিচলিত হতে দেখিনি।
‘বলি কুঁড়ের সর্দার, বয়স তো প্রায় তিন মাস হল, এখনও ওড়ার সাহস হয় না। তুই কি বল দেখি– পায়রা না কেঁচো?’– এই বলে চিত্রগ্রীবের বাবা তাকে ঠেলতে ঠেলতে কার্নিশের ধারে নিয়ে এল। বাবার বকুনির ঠেলা এড়াতে চিত্রগ্রীব সরতে সরতে একেবারে কার্নিশের ধারে এসে গেছে, এমন সময় বাবা তার শরীরের ভার দিয়ে ঠেলে তাকে একেবারে নিচেই ফেলে দিলে। কিন্তু আধফুট পড়তে না পড়তেই ডানা মেলে দিল চিত্রগ্রীব। উড়তে শুরু করল। সম্পন্ন হল তার আকাশচারিতার হাতেখড়ি। ‘চিত্রগ্রীব’ নামের এই বইতেই ধনগোপাল মুখোপাধ্যায় লিখেছেন ঈগল মা-এর সন্তানদের উড়তে শেখানোর কাহিনি। সে আরওই মারাত্মক! মা ঈগল যখন বোঝে যে, বাচ্চারা এবার লায়েক হয়েছে, উড়তে শেখার উপযুক্ত হয়ে উঠেছে গায়ে-গতরে, তখন সে বাচ্চাদের বাসায় রেখে একদিন পার্মানেন্টলি চলে যায়। অপেক্ষা করতে করতে বাচ্চারা যখন নিশ্চিত করে বোঝে– খাবার নিয়ে মা আর কোনওদিনই ফিরে আসবে না, তখন তারা বাধ্য হয়ে পা বাড়ায় আকাশে। নিজেই নিজের হাতেখড়ি দেয় উড়তে শেখার। শিক্ষাক্ষেত্রে এমু পাখির বাচ্চারা আবার আরও দড়! ফোটার সময় হয়ে এসেছে এমন ডিমের সামনে মা এমু পাখির গলায় বিপদ সংকেতের আওয়াজ শোনালে নাকি সেই ডিম নড়ে ওঠে। সাত জন্মে মায়ের মুখ না-দেখা, মায়ের গলার আওয়াজ না-শোনা বাচ্চারা সাবধানবাণী শুনে পালাতে চেষ্টা করে। বিপদসংকেত চেনার শিক্ষা তারা পেয়েছে উত্তরাধিকার সূত্রে জন্মগতভাবে।
মানুষের বাচ্চার কিন্তু তা হওয়ার জো নেই। খুব সামান্য কয়েকটা জৈবিক বা শারীরবৃত্তীয় কাজ ছাড়া প্রায় সব কিছুই তাকে শেখাতে হয় হাতে ধরে। তবে না সে মনুষ্য-পদবাচ্য হয়ে উঠবে। প্রাচীন গ্রিসের এক দার্শনিক বলেছিলেন, ভগবান সব জীবকেই কিছু না কিছু বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছেন। পাখিকে দিয়েছেন ওড়ার ক্ষমতা, ঘোড়াকে দৌড়নোর ক্ষমতা, তেমনই মানুষকে দিয়েছেন জ্ঞানচর্চা করার ক্ষমতা। চোদ্দো-পনের শতকের ইটালিতে এই জন্য ‘হিউম্যানিস্ট’ বা মানবতাবাদী বলা হত জ্ঞানচর্চাকারীদেরই। যাঁরা মানুষের জন্য নির্দিষ্ট বিশেষ কাজটাই করে থাকেন। ‘হিউম্যানিস্ট’ কথার মানে আজ বদলে গিয়েছে, কিন্তু সেই ঐতিহ্য রয়ে গিয়েছে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের হিউম্যানিটিজ বিভাগের মধ্যে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
আনুষ্ঠানিক দিকটা বাদ দিলে, যে কোনও বিদ্যাচর্চাতেই হাতেখড়ি একটা হয়। তবে সবচেয়ে গোপনে হয় মহাবিদ্যাচর্চায় হাতেখড়ি। সে কারা দেন কীভাবে দেন– আর কোথায় দেন আমার জানা নেই। কিন্তু এর প্রকৃষ্টতম উদাহরণ দেখেছি অলিভার টুইস্ট অবলম্বনে তৈরি ‘মানিক’ নামের একটি বাংলা সিনেমায়। এখানে দুর্বৃত্ত ফকিরচাঁদ তার শিক্ষাকেন্দ্রে চুরিবিদ্যার শিষ্যদের মধ্যে মানিক-কে বসিয়ে পকেটমারিতে হাতেখড়ি দিতে শুরু করে।
……………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………………
জন্মের পরে অন্যান্য জন্তু-জানোয়ারের তুলনায় মানুষের শিক্ষার কালটা বেশ দীর্ঘ। এর কারণ লুকিয়ে আছে মানুষের বিবর্তনের ইতিহাসের মধ্যে। বলা হয়, আজ থেকে ৬০ কি ৭০ লক্ষ বছর আগে মানুষের পূর্বপুরুষরা যখন প্রথম গাছ থেকে নেমে এসেছিল, তখনই সে দু’-পায়ে হাঁটার চেষ্টা করে। হাত দু’খানা ফাঁকা রাখতে চেয়েছিল বাড়িতে, মানে গাছে রেখে আসা বাচ্চা বা অশক্ত সদস্যদের জন্য খাবার বয়ে আনার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সোজা হয়ে হাঁটার ফলে মায়েদের জননপথ সংকীর্ণ হতে শুরু করে। বাচ্চারা জন্ম নেয় নরম মাথা আর অপরিণত মস্তিষ্ক নিয়ে। এর ফলে মানুষের বাচ্চা জন্মের পরেই বাছুরের মতো চট করে দাঁড়াতে শেখে না বটে, কিন্তু মস্তিষ্ক ধীরে ধীরে বিকশিত হয় বলে তার নতুন জিনিস শেখার প্রবণতা ও ক্ষমতা অনেক বেশি থাকে।
এরই জন্য মানুষের শিক্ষাগুরু লাগে। যিনি হাতে ধরে শিখিয়ে দেবেন ‘অ’-এর টান ‘ক’-এর আঁকড়ি। বৈদিক মতে, কল্পের অন্তর্গত যে গৃহসূত্র তাতে গৃহস্থের বেশ কয়েকটি অবশ্য পালনীয় কর্তব্য বা সংস্কার রয়েছে। এরই একটি হল ‘বিদ্যারম্ভ’ বা মতান্তরে বেদারম্ভ। আমাদের বাঙালি বাড়ির হাতে খড়ি অনুষ্ঠান এই বিদ্যারম্ভের বিবর্তিত রূপ বলে মনে হয়। যদিও বৈদিক মতের বদলে এটি পুরাণ ও স্মৃতি নির্ভর হওয়ায় এর সঙ্গে যুক্ত আচার-অনুষ্ঠানের নানা বৈচিত্র লক্ষ করা যায় স্থান ও কালভেদে। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়ের ‘হাতে খড়ি’ নামের একটা গল্পে আমরা দেখি প্রধান চরিত্র মিটু হাতেখড়ি পাওয়ার আগেই লিখতে শিখেছে দেখে তার মা নিতান্ত আতঙ্কিত হয়ে বলে ওঠেন, ‘খবরদার খবরদার। আর অ আ মুখে এনো না। হাতে খড়ি না দিয়ে– মা সরস্বতীকে প্রণাম না করে পড়লে, কি লিখলে, কি কুল খেলে, মা ভয়ানক চটে যান। একেবারে বিদ্যা দেন না। খবরদার।’ অথচ আজ থেকে বছর পঞ্চাশেক আগে যখন আমার হাতেখড়ি হয়েছে তার অনেক আগেই স্লেট-পেনসিলে অ-আ লেখা হয়ে গিয়েছে আমার। তার জন্য কাউকে বিচলিত হতে দেখিনি।
আনুষ্ঠানিক দিকটা বাদ দিলে, যে-কোনও বিদ্যাচর্চাতেই হাতেখড়ি একটা হয়। তবে সবচেয়ে গোপনে হয় মহাবিদ্যাচর্চায় হাতেখড়ি। সে কারা দেন কীভাবে দেন– আর কোথায় দেন আমার জানা নেই। কিন্তু এর প্রকৃষ্টতম উদাহরণ দেখেছি অলিভার টুইস্ট অবলম্বনে তৈরি ‘মানিক’ নামের একটি বাংলা সিনেমায়। এখানে দুর্বৃত্ত ফকিরচাঁদ তার শিক্ষাকেন্দ্রে চুরিবিদ্যার শিষ্যদের মধ্যে মানিক-কে বসিয়ে পকেটমারিতে হাতেখড়ি দিতে শুরু করে। ফকিরচাঁদের চরিত্রে শম্ভু মিত্র আর নিলি’র চরিত্রে তৃপ্তি মিত্রের অভিনয় এই সিনেমার অবিস্মরণীয় সম্পদ। এই সূত্রে অনেকের মনে পড়তে পারে বাসু চ্যাটার্জির ‘ছোটি সি বাত’ সিনেমার কথা। যেখানে ইনকনফিডেন্ট নায়ক অমল পালেকরকে রমণী-মোহন বিদ্যায় হাতেখড়ি দিয়েছিলেন অশোক কুমার।
বিদ্যারম্ভ বা হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শিশুর সামনে এক আশ্চর্য জ্ঞানভাণ্ডার উন্মুক্ত হয়ে যায়। যে জ্ঞান তার পূর্বপুরুষেরা সঞ্চয় করেছেন হাজার হাজার বছর ধরে। এই ভাণ্ডারে প্রবেশের দরজাটা হাতে ধরে পার করিয়ে দেওয়াটাই গুরুর কাজ। তারই প্রথম ধাপ হিসেবে হাতেখড়ি অনুষ্ঠানের গুরুত্ব। ইদানীং ইন্টারনেটের সৌজন্যে অনেকরকম চমকপ্রদ বদল চোখে পড়ে বাঙালি সংস্কৃতির ধরনধারণে। ইলেকট্রনিক বা ই-ফরম্যাটে এখন পুজো, ভাইফোঁটা বা বিয়ে হওয়ার কথাও শুনেছি; কিন্তু ই-হাতেখড়ি সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানতে পারিনি। প্রথমত, অনুষ্ঠানটা বাচ্চাদের। দ্বিতীয়ত, হাতে ধরে দাগা-বোলাতে শেখানোর মতো ই-প্ল্যাটফর্ম বোধহয় এখনও তৈরি হয়নি। তবে অনুমান করা যায় যে, ভার্চুয়াল রিয়ালিটি আর আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের যুগপৎ ব্যবহারে এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আমরা খুব তাড়াতাড়িই এই ধরনের অ-মানুষিক হাতেখড়ি অনুষ্ঠান দেখতে পাব। তখনও আমাদের ভরসা জোগাবেন একলব্য এবং রাসসুন্দরীর মতো ব্যক্তিত্ব। মানবসমাজের বিধিনিষেধের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না রেখেই যাঁরা নিজেই নিজের হাতটা শক্ত করে ধরে হাতে তুলে নিয়েছিলেন নিজেদের বই আর হাতিয়ার।
…পড়ুন সরস্বতী পুজোর আরও ফিচার…
সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায়: আদিতে চার হাত, তবে সরস্বতী দু’-হাতেও বিদ্যেবতী
তন্ময় ভট্টাচার্য: সরস্বতী নদী ও আদিগঙ্গা: প্রচলিত মৃত্যু-তত্ত্বের বিপরীতে
অরিঞ্জয় বোস: প্রেমে ফেল করলে পাশ করায় পাশবালিশ
পাকিস্তানী বাহিনীর নির্মম অত্যাচারের কথা বলতে বলতে তাঁর অশ্রুসজল চোখ দেখে শুধু সেই সময় নির্বাক হয়েছিলাম তা’ নয়, আজও তাঁর সেই চোখ দেখতে পাই, শুনতে পাই মানুষের প্রতি মানুষের বর্বরোচিত অত্যাচারের সেই গল্প বলতে বলতে তাঁর রুদ্ধ কণ্ঠস্বর।