Robbar

ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে?

Published by: Robbar Digital
  • Posted:April 24, 2024 6:10 pm
  • Updated:April 24, 2024 6:10 pm  

অজস্র গল্পের কথা তুলে বলার পরিসর হয়তো নেই, কিন্তু প্রথম দু’টি গল্পে দেখতে পাচ্ছি মূলধারার বিজ্ঞানের কথা তোলেননি এণাক্ষী। বরং চেতনার ছাঁচে ঢালাই লজিক-ঘটিত প্লট ফেঁদেছেন। কিন্তু তৃতীয় গল্প থেকে তিনি পদার্থবিদ্যার সূত্র ধরেই গল্প ফাঁদবেন। এবং ‘বিস্ময়’ সায়েন্স ফিকশন পত্রিকায় লেখা পরপর কয়েকটি গল্পে, সাত-আট দশকে তিনি চলে যাবেন এক অত্যন্ত মূল্যবান ওয়ার্ল্ড বিল্ডিংয়ের দিকে। ‘অমরাবতী’ আমার কাছে বহুদিনের মধ্যে পড়া অনন্য বাংলা কল্পবিজ্ঞান, ১৯৭৩ সালের ‘বিস্ময়’ সায়েন্স ফিকশন পত্রিকায় লেখা।

যশোধরা রায়চৌধুরী

১১.

এবার নাম করতে হয় এণাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের। ১৯৩৪-এ ইংরেজি ভাষার ছাত্রী ছিলেন। একাধারে ইংরেজি অনুবাদক, বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসুর জীবনীকার এবং বাংলায় অজস্র কল্পবিজ্ঞান গল্পের লেখক এণাক্ষী। তাঁর লেখা ‘মানুষ যেদিন হাসবে না’ সংকলনটি উল্লেখ্য। অন্যান্য বই– ‘দাদুর দোয়াতদানি’, ‘বাজপাখির ডানা’। প্রথম এণাক্ষী যে লেখাটি লিখে কল্পবিজ্ঞানের দরজায় পা রাখলেন, সেটি অদ্রীশ বর্ধন সম্পাদিত ‘আশ্চর্য!’ পত্রিকার জন্য ‘ধোঁয়া’। এক বিখ্যাত লেখকের টেপ রেকর্ডারের মধ্যে আছে তাঁর সুপার পাওয়ারের রহস্য। তিনি লেখার চরিত্রগুলিকে বাস্তব করে তোলেন। আর এভাবেই এসে যায় রহস্যময়ীরা। রসালো বাংলা গদ্যের হাতটি এণাক্ষীর ভরপুর ছিল, ছিল গল্প বলার এক কুশলী কলম।

Kalpabigyan Rachana Samagra || A Classical Bengali Science Fiction Book By Best Selling Author Enakshi Chattopadhyay || Trending [Hardcover] Enakshi Chattopadhyay

আরেক গল্প ‘স্বর্গ’ পুরোপুরি সত্য-মিথ্যার ধাঁধা বা নীতিনৈতিকতার গল্পের অ্যাবসার্ডিটিকে তুলে আনছে। এক অতি বুদ্ধিদীপ্ত কাহিনির মূল সূত্র গাঁথা থাকে মানুষের লোভের সঙ্গে। এণাক্ষীর গল্পের সংখ্যা অযাচিত বেশি নয় বলেই কি তাঁকে আমরা ঠিক করে চিনলাম না? নাকি বাংলা সাহিত্যের পুকুরে আজও কল্পবিজ্ঞান ব্রাত্য ও একটেরে হয়ে রয়ে গেল বলে? নাহলে এই রসবোধের বাংলাভাষায় যে মেধাবুদ্ধির ঝলক আছে, তা আমাদের সাত-আটের দশকের সার্বিক মেধাচর্চার সময়েরই ফসল। এক ব্যাঙ্ক ডাকাত পুলিশের গুলি খেয়ে স্বর্গে চলে যায়। কী সেই স্বর্গ? যেখানে কোনও সুখের অভাব নেই, ড্রয়ার খুললেই রাশি রাশি টাকার নোট বেরিয়ে আসে। অর্থাৎ সেখানে চুরি ডাকাতি প্রভৃতি অপকর্ম করার কোনও প্রয়োজনই নেই, আর সেটাই ওই স্বর্গকে ব্যাঙ্ক ডাকাতের কাছে করে তোলে নরক… বন্দিশালা।

অজস্র গল্পের কথা তুলে বলার পরিসর হয়তো নেই, কিন্তু প্রথম দু’টি গল্পে দেখতে পাচ্ছি মূলধারার বিজ্ঞানের কথা তোলেননি এণাক্ষী। বরং চেতনার ছাঁচে ঢালাই লজিক-ঘটিত প্লট ফেঁদেছেন। কিন্তু তৃতীয় গল্প থেকে তিনি পদার্থবিদ্যার সূত্র ধরেই গল্প ফাঁদবেন। এবং ‘বিস্ময়’ সায়েন্স ফিকশন পত্রিকায় লেখা পরপর কয়েকটি গল্পে, সাত-আট দশকে তিনি চলে যাবেন এক অত্যন্ত মূল্যবান ওয়ার্ল্ড বিল্ডিংয়ের দিকে। ‘অমরাবতী’ আমার কাছে বহুদিনের মধ্যে পড়া অনন্য বাংলা কল্পবিজ্ঞান, ১৯৭৩ সালের ‘বিস্ময়’ সায়েন্স ফিকশন পত্রিকায় লেখা। ‘অমরাবতী’ ৬,৫০০ শব্দের আশপাশে আঁটসাঁট বুননে, যেন বা একটা উপন্যাসকে ধরে রাখে তার ছোট আধারে। এখানে খুব সন্তর্পণে লিঙ্গনির্ধারিত সামাজিক রোল প্লে, বা বিজ্ঞানের নানা ধারায় পুরুষনারীর পদচারণার বিষয়টি আনা হয়েছে। মেধাবী এণাক্ষী গল্পের শুরু করেছেন এক মহাকাশযানের ভেতরে। চারটি পুরুষ (তাদের নামকরণে আছে আরেক মজা, তারা জয়ন্ত, মাণিক, কুমার ও বিমল। হেমেন রায়ের চরিত্রদের মনে পড়ছে না?) গেছে ‘রোহিণী’ নামের এক প্রজেক্টে মহাকাশ সফরে। পৃথিবীতে ফেরার সময়ে তাদের বয়স মাত্র আট বছর বেড়েছে কিন্তু পৃথিবীতে ইতিমধ্যে কেটে গিয়েছে ১০০ বছর। কাজেই ফেরার পর চেনা আর কাউকে দেখতে পাবে না তারা। কীভাবে তা হয়? কত সরল ভাষায় বিজ্ঞানকে বিবৃত করছেন এণাক্ষী, পড়া যাক তা।

Bismay: the Bengali SF magazine: April 2015

‘উপগ্রহ যেমন আর পৃথিবীতে ফেরে না, গাছ থেকে আপেল যেমন মাটিতেই পড়তে বাধ্য, সেই একই নিয়মে তাদেরও অন্য এক সৌরজগৎ থেকে ফিরতে ফিরতে পার হয়ে যাবে এক শতাব্দী, পার হতেই হবে, তা না হলে বিশ্বজগতে সব নিয়মকানুন ভুল হতে হয়। তাদের রোহিণী তিনশো চারের নেভিগেশন রুমে অবশ্য কালস্রোত থেমে আছে। একেবারে গতিহীন না হলেও তাদের ক্যালেন্ডার চলেছে তাদের নিয়মে। তাদের হিসেবে যে দিন আট বছর পুরো, সে দিন ঘরে ফেরার দিন, পৃথিবীর ততদিনে একশোবার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করা হয়ে গিয়েছে।

এই আট বছর রোহিণী তিনশো চার ছুটেছে বিপুল বেগে, কেননা একমাত্র বেগ দিয়েই জয় করা যায় সময়, পার হওয়া যায় দূরত্ব। যেসব দূরত্ব বিংশ শতাব্দীতে মনে করা হত নাগালের বাইরে, সেইসব অকল্পনীয় দূরত্ব পাড়ি দেওয়ার মতো দ্রুতগামী যান তৈরি হয়েছে। অন্য গ্রহে যাওয়াই ছিল একসময় কঠিনতম চ্যালেঞ্জ, এখন মানুষ অবলীলাক্রমে পাড়ি দিচ্ছে অন্য সৌরজগতে, চিনছে অচেনা সূর্যরশ্মির বর্ণালিরেখা, পরীক্ষা করছে উপাদান।’

এমনই এক সেটিং থেকে শুরু গল্প, কিন্তু আমরা জানতে পারি, যে মিশন গিয়েছিল বহিঃব্রহ্মাণ্ডে তা এবার পৃথিবীতে ফিরছে দুরুদুরু বুকে, এবং ভাবছে, তাদের পরিচিত মানুষেরা কেউ তো আর বেঁচে নেই।

desh_deshe_boi-chitra

ফলে, জয়ন্তর কাছে ভেসে আসছে সেই আট বছর আগের স্মৃতি, রাকা বলে যে মেয়েটিকে সে ভালোবাসত, সে তার সঙ্গে এই মহাকাশযাত্রায় সফরসঙ্গী হয়নি। বরঞ্চ নিজের গোপন অমরাবতী প্রজেক্টের কাজে থেকে গিয়েছিল পৃথিবীতেই। এখানেই লিঙ্গ ও তার জেন্ডার-নিরিখের বিজ্ঞানচর্চা নিয়ে লিখছেন এণাক্ষী–

‘রাকার ল্যাবরেটরি। অজস্র মেয়েরা কাজ করছে সেখানে, দেখতে তার মন্দ লাগত না। কোনও আশ্চর্য কারণে মহাকাশবিজ্ঞানে মেয়েদের ততটা উৎসাহ কখনোই দেখা যেত না, যতটা দেখা যেত এইসব ছোটখাটো, সীমাবদ্ধ, হাতে করে ধরাছোঁয়ার ব্যাপারে, যেমন জীবকোশ, উদ্ভিদতত্ত্ব। জয়ন্তর নিজস্ব ধারণা ছিল, মেয়েদের স্নায়ু দুর্বল, মহাকাশের নিশ্ছিদ্র শূন্যতার মধ্যে গিয়ে তারা বিহ্বল হয়ে পড়বে, কাজ করবার শক্তি হারিয়ে ফেলবে। আপেক্ষিকতাবাদ বোঝা কি এদের কর্ম? বড়জোর এরা অণুবীক্ষণের নীচে পোকামাকড়দের পর্যবেক্ষণ করবে– শুনলে আবার রাকা চটে টং হত। পোকামাকড় অবশ্য ঠাট্টা করে বলত জয়ন্ত। সে ভালো করেই জানত পোকামাকড় নয়, রাকার প্রাণের জিনিস হল ক্রোমোজোম। তার থেকেও আছে ক্ষুদ্রতর কণা। কে ভেবেছিল এসব কথা কোনওদিন?

জয়ন্ত তো ভাবেইনি। এসবই রাকার কাছ থেকে শোনা বিদ্যে।

ক্রোমোজোম প্রসঙ্গে পৌঁছতে পারলে আর তাকে থামানো শক্ত হয়। সমস্ত মুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, চোখ জ্বলতে থাকে, নিশ্বাস দ্রুত হয়; সেই উচ্ছ্বসিত মেয়েটির সামনে দাঁড়িয়ে কেমন নিষ্প্রভ হয়ে যায় জয়ন্ত, মনে হয়, বিজ্ঞানের কাছে যে নিজেকে উৎসর্গ করেছে, তাকে সেই পথ থেকে সে বিচ্যুত করতে পারে কোন অধিকারে? স্টেটের দাবি তার কাছে অনেক বেশি, বিজ্ঞানের দাবি, সমস্ত পৃথিবীর দাবি।

কতদিন আগে এক পণ্ডিত বলেছিলেন, আশ্চর্য অন্তর্দৃষ্টির সঙ্গে– বাস্তব আমাদের পথপ্রদর্শক। শুধু সাহস থাকতে হবে, প্রচণ্ড সাহস, সেই সাহস সম্বল করে এগোতে হবে, তবে যদি আমরা জীবনের রহস্যের গুপ্ত দরজা খুলতে পারি। তা-ই তো করলাম আমরা, করিনি কি? কে ভেবেছিল, ক্রোমোজোমের মধ্যে আছে ক্ষুদ্রতর কণা– যার সামঞ্জস্য, সম্ভাবনা আর নিখুঁত কাজ করার শক্তি থেকে একদিন বস্তুর জগতে প্রেরণা আসবে। তা-ই তো এল। প্রাণের মধ্যেই আছে মিনিয়েচার প্রকৃতি, ডিএনএ-র পাকানো দড়ির মধ্যে…’

এণাক্ষীর কলমের আঁচ নিশ্চিতভাবেই পাঠক এখানে পাচ্ছেন। একইসঙ্গে মানবিক একটি গল্প, সঙ্গে ভবিষ্যতের পৃথিবীর কথা, মিলেমিশে উঠে আসছে এ কাহিনিতে। স্পয়লার দেওয়া নিষেধ, কিন্তু শেষাবধি ২০৯১ সালের পৃথিবীতে ফিরে আসা দলটি কী পেল পৃথিবীতে? ধ্বংস ও বায়ুদূষণ পরবর্তী সেই মাটির নিচের সভ্যতায় জয়ন্ত কি ফিরে পাবে তার রাকাকে? পাবে, কিন্তু পুরোটা পাবে না। আর এখানেই কুশলতার সঙ্গে ওপেন এন্ডেড কাহিনি বুনেছেন এণাক্ষী, ক্লাইম্যাক্সকে ‘শেষ হয়ে হইল না শেষ’-এর আদল দিয়েছেন।

সম্প্রতি এণাক্ষীর ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নানা গল্প নিয়ে যে কাজ হচ্ছে এ এক আশার কথা। এণাক্ষীর বেশ কিছু কল্পবিজ্ঞান অনুবাদ-কাজ আছে নারলিকর বা আর্থার সি ক্লার্কের গল্প থেকে। একত্র করে কল্পবিশ্ব প্রকাশনা এক মলাটে ধরে দিচ্ছে– এ খুব জরুরি। পাশাপাশি জীবনে তিনি অনেককিছু ঘটিয়েছেন, স্বামী পরমাণু বিজ্ঞানী শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিবাহের পর, যৌথভাবে ‘পরমাণু -জিজ্ঞাসা’ বইটির জন্য ১৯৭৪ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার লাভ করেন। ছোটদের লেখার জন্য ২০০৪ সালে পান ‘বিদ্যাসাগর পুরস্কার’। প্রেমেন্দ্র মিত্র থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বাংলা সাহিত্যকে ইংরেজিতে অনুবাদের কাজটি তিনি করে গেছেন সারা জীবন। বিক্রম শেঠের ‘স্যুটেবল বয়’-কে এনেছেন বাংলায়। কথা ট্রান্সলেশন অ্যাওয়ার্ড দু’বার পেয়েছিলেন। তবু, লেখকের আসল সাফল্য তাঁর পাঠকপ্রীতিতে। ২০২১ সালে অনন্তযাত্রী হয়েছেন এই বহুপ্রজ লেখক। বহুগুণে গুণান্বিতা এণাক্ষী যেন আজও অনেকটাই অনাবিষ্কৃত ভূখণ্ড। তাঁকে আরও পড়ি আমরা।

(চলবে)

…পড়ুন সায়েন্স ফিকশনারী-র অন্যান্য পর্ব…

পর্ব ১০। লীলা মজুমদারের কল্পবিজ্ঞানের মহাকাশযানে উঠে পড়েছিল বঞ্চিত মানুষও

পর্ব ৯। জরায়ুযন্ত্রে পরিণত হওয়া নারী শরীর কি ডিস্টোপিয়া, না বাস্তব?

পর্ব ৮। উরসুলার মতো সফল নারী লেখককেও সম্পাদক পাঠাতে চেয়েছিলেন পুরুষ ছদ্মবেশে

পর্ব ৭। উরসুলা লেগুইন কল্পকাহিনির আইডিয়া পান স্ট্রিট সাইনগুলো উল্টো করে পড়তে পড়তে

পর্ব ৬। কেবলমাত্র নারীরচিত সমাজ কেমন হবে– সে বিষয়ে পুরুষের অনুমান সামান্য

পর্ব ৫। একমাত্র মানুষের মাংসই সহ্য হত ভিনগ্রহী শিশুটির!

পর্ব ৪। পাল্প ম্যাগাজিনের প্রথম লেখিকা

পর্ব ৩। রোকেয়ার ‘সুলতানার স্বপ্ন’ কি কল্পবিজ্ঞান সংজ্ঞার সবগুলো শর্তই পূরণ করতে পেরেছিল?

পর্ব ২। সুলতানার স্বপ্নেই বিশ্বের প্রথম নারীবাদী ইউটোপিয়ার অবকাশ

পর্ব ১। চ্যালেঞ্জের বশেই লেখা হয়েছিল পৃথিবী প্রথম কল্পবিজ্ঞান কাহিনি, লিখেছিলেন একজন নারীই