হিসাবখাতা সবই জানত। কার কেমন খরচের হাত। কে বেশি মেসের দিক দেখছে, আর কে নিজের খরচের বেহিসেব সামাল দিতে মেসে ডিম গুঁজে দিচ্ছে, খাতা তারই কনফেসন বক্স। তাকে আমরা কোনও দিন গোপন করিনি। সকলেই অতএব সব দেখে নিতে পারত। এরপর, এক সময় আমরা ম্যানেজরীয় সভ্যতাটাই তুলে দিলাম। ম্যানেজার আবার কী! আমরা সবাই রাজা।
প্রচ্ছদ দীপঙ্কর ভৌমিক
১২.
জীবন নামের রাস্তাটায় ‘ভালো থাকা’ আসলে ফুটপাথ। কখনও থাকে, কখনও হাঁটতে হাঁটতে ফুরিয়ে যায়। বহু কিসিমের মানুষের সঙ্গে দেখা, কেউ সহৃদয়, কেউ নয়। রাস্তার খোঁজ বলে দেয় কেউ, অনেকেই মুখ ঘুরিয়ে নেয়। তবু, রাস্তা কাউকে না-ছাড়লেও ফুটপাথ কেউ ধরে রাখে না। মেসে এসে বুঝলাম ভালো থাকা-র ফুটপাথটাই আস্ত রাস্তা হয়ে গেছে।
বেডে প্রথম যেদিন ঘুম ভাঙল, যেন পোক থেকে লোক হয়ে উঠলাম। খানিক লায়েক লায়েক! কেউ তোমাকে চোখে হারাচ্ছে না, তাড়াচ্ছেও না। কারও কাছে তোমার চাবি দেওয়া নেই। ঘরের চাবি ভেঙে তোমাকে কেউ নিয়ে যাওয়ারও নেই। ইচ্ছা নামক শক্তি-পীঠে সেই যেন প্রথম মাথা ঠেকানো। তুমি কে? নহ পুত্র, নহ ভ্রাতা, যদি সকলে সকলের পাশে থাকো বিপদে সংকটে, তবে, তোমাকে চিনে রাখবে হিসাবের খাতা। মেসের ঘরকন্নায় সে এক আজব চিজ। মস্ত ব্যাপার সন্দেহ নেই! পাইপয়সার হিসাব তারই নখদর্পণে। অথচ থাকে একেবারে ঘরের কোণে। কেজো প্রয়োজনের বাইরেই যে জীবন মহার্ঘ, হিসাবখাতার সেই কোণঠাসা অবস্থানেই আমরা তা খাসা বুঝেছি। মনীষীরা নিশ্চিত এ ব্যাপারে মণিরত্ন ভাবনা রেখে গিয়েছেন। মেস মাগনায় এমন কত দর্শন বিলিয়ে যায়। শুধু চেয়ে দেখলেই হয়।
এই দেখা আর দেখানোর ভিতরই সমস্তটা। রাস্তা নিজেই ট্রাফিক পুলিশ, সব কিছু দেখাতে থাকে। কোনদিক বরাবর যেতে হবে, কখন থামতে হবে, লাল-সবুজ-হলুদ সংকেতে রাস্তা পথিককে নিয়ন্ত্রণ করে। ফুটপাথ স্বভাবে বাউল, তার সে বালাই নেই। সে থাকলে নিজেই পথ করে দেয় নইলে নয়। এর আগে যখন যেখানে থেকেছি, এমনকী, বাড়িতেও সে সবই রাস্তার নিয়মে বাঁধা। মেস দেখানো পথের বদলে, পথের খোঁজে নামিয়ে দিল। দূর থেকে দেখলে অবশ্য খানিক বেসামাল মনে হয়। মনে হয়, বুঝি জনাকয় উচ্ছন্নে যাওয়ার পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন। আমরা জানি, এ আসলে সেই গল্পটা যা আমরা রোজ একটু করে লিখছি। আমরাই লেখক, আমরাই চরিত্র। ঘটনার ভিতরেও আমরা, বাইরেও। সাবালকত্বের খাতিরে খানিক যা-ইচ্ছে-তাই করার সুযোগ মেলে না বলা ভুল। তবে সেই সঙ্গে এ-ও জানি, এমন কিছু করা যায় না, যাতে মেসের ডিফেন্স নড়ে ব্রাজিল-জার্মানি ঐতিহাসিক কেলেঙ্কারি হয়ে যায়। নিয়মের শাসন করে কেউ তা গেঁথে দিচ্ছে না। এখানে যে কোচ, সে-ও খেলোয়াড়। এই নতুন জীবনটার ভিতর আমরা এত অনায়াসে ঢুকে পড়ি যে আলাদা করে আর বর্ণপরিচয়ের দরকার পড়ে না। কেউ এখানে চমকাচ্ছে না, ধমকাচ্ছে না। পরিবারে যে একরকমের এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা, তার জমানত জব্দ। অথচ এ-ও এক পরিবার। তুমি কর্তা অথচ কর্তৃত্ব নেই।
সবথেকে বড় কথা, সিদ্ধান্ত নেওয়া। যুগপৎ একার এবং সবার। এই দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা করতে শিখলেই হল। আপনারে লয়ে ব্যস্ত রহিতে আসে নাই কেহ মেসের ঘরে। তাহলে? আবার নিজেরটুকু একেবারে না-ভাবলেও নয়। এ আসলে জড়িয়ে থাকার জড়োয়া। মূল্যবান বলেই তার দেখা মেলে না সচরাচর। আমরা মেসবাসীরা শুধু জানতাম, ট্যাঙ্কে জল না-থাকলে জমানো এক বালতি জল পুরোটা খরচ করে ফেলতে নেই। অন্যের দরকারের জন্য খানিকটা রেখে দিতে হয়। এই যে নিজের জীবন থেকে খানিকটা অন্যের জন্য তুলে রাখা, এই রেওয়াজ আমাদের পূর্বাশ্রমে তেমন করে ছিল না। ভাই-বোনের ক্ষেত্রে এটা হয়, তবে সে সম্পর্কে কেউ তো ‘অপর’ নয়। মেসের হিসাবখাতা এই অপরের ভূত তাড়িয়ে পাতায় পাতায় জড়ানো জীবনটার খোঁজ রাখত সবথেকে ভালো।
একেবারে গোড়ায়, যখন হোম ডেলিভারিতে খাওয়া, তখন এক রকমের হিসাবপত্তর। তার বাইরেও নানা জিনিস কিনতে হয়। ভাগাভাগির সংসারে লিখে রাখা দস্তুর। খাতার জরুরি ব্যবহার আসে, যখন রান্না-বান্না বাজারহাট পুরোদস্তুর। বাজার দুশো, চারশো, ছশো যে কোনও অঙ্কের হতে পারে। তবে কিনা অঙ্ক কথা বলে। যে দুশোর বাজার করে এনেছে, সে কি মেসের দরকারে করেছে! অর্থাৎ যথেষ্ট বাজার মজুত ছিল বলেই কম টাকায় সেরেছে! মাছ কি এনেছে, চারা না কাটা! অথবা যে ছ-শোর বাজার করেছে, তার দরুন তরিজুত খাওয়া-দাওয়া হয়েছে ঠিকই, তবে তাতে কি খাতার ভারসাম্য রক্ষা হবে! অর্থাৎ কোনও এক রবিবার দারুণ খাওয়ার দরুন, সাত দিন সোয়াবিন সহায় হবে না তো! এসব বিচার বিবেচনার ভার থাকে মেস ম্যানেজারের। অনভিজ্ঞের অপেরায় দু’-একজন ঠিক জুটে যায়, যাকে দেখে মনে হয়, সংসার একে ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়েই পাঠিয়েছে। তার ঘাড়েই দায়িত্ব। দেখেশুনে সে বুঝে যায় মেসের দাঁড়িপাল্লা কোনদিকে হেলেছে। বাকিরা বাজার করে আর টাকার অঙ্ক লিখে রেখেই খালাস। কিন্তু ম্যানেজারের অত অল্পে ছাড় নেই। ক্যাশ আর গ্যাস দুয়ের হিসাবই তাকে রাখতে হয়। টাকার হিসাব তাও নয় বলেকয়ে ম্যানেজ হয়ে যায়, কিন্তু গ্যাস ফাঁকা হয়ে গেলে পূর্ণদিবস অরন্ধন। আমাদের এই সংসারের তো মালিক নেই। এলপিজি, ইন্ডেন তাই আমাদের সদয় হয় না। বাধ্য হয়েই মেসে মেসে ছোট গ্যাসের কারবার, আমরা বলি কাটা গ্যাস। চার কেজি গ্যাসের একটা সিলিন্ডার, মাথাতে আভেন নিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বড় কড়াই বসিয়ে তাতে সাবধানে খুনতি নাড়তে হয়, কেননা পলকা সেই আভেনের অটল যোজনায় মোটে বিশ্বাস ছিল না। যাদবপুরে এখন যেখানে সাবওয়ে, তার ঠিক পাশের গলিতেই দেখা মিলত। চড়া দাম। তা হোকগে! আমরা মেসবাসীরা থেকে থেকেই পাশাপাশি দোকানে গিয়ে লাইন দিতাম। যে মেসের সংগতি আছে, তারা দুটো গ্যাস কিনে রাখত। যার গতি নেই, তার ম্যানেজারকে খেয়াল রাখতে হত, এর সঙ্গে দু’-লিটার কেরোসিন যেন কিনে রাখা থাকে। বাই চান্স গ্যাস ফুরিয়ে গেলে স্টোভ দিয়ে অন্তত কাজ চালিয়ে নেওয়া যাবে।
তবে মেসে-গ্যাসে এই সম্পর্কে সবথেকে অন্তর্ঘাত করত ওয়াশার। সিলিন্ডার আর আভেনের জোড়মুখে তার বাস। তা রবার যেটা সেটা রবে, এই তো স্বাভাবিক। তবু সে রবার যে কেন ক্ষয়ে যায় কিংবা নড়ে যায় কিংবা বেচাল হত আমাদের জানা নেই। হঠাৎ হঠাৎ মাসি বলত, গ্যাস লিক্ করছে। ব্যস শুরু হত সবাই মিলে ঝুঁকে পড়ে গ্যাসের অপচয় বাঁচানোর প্রাণান্ত চেষ্টা। তা সেই চেষ্টাই সার; ওয়াশার ওই ছাপোষা পাবলিকের মতোই; আছে তো আছে দিব্যি আছে, বিগড়োলে দিল্লি বহু দূর।
হিসাবখাতা এ সবই জানত। কার কেমন খরচের হাত। কে বেশি মেসের দিক দেখছে, আর কে নিজের খরচের বেহিসেব সামাল দিতে মেসে ডিম গুঁজে দিচ্ছে, খাতা তারই কনফেসন বক্স। তাকে আমরা কোনও দিন গোপন করিনি। সকলেই অতএব সব দেখে নিতে পারত। এরপর, এক সময় আমরা ম্যানেজরীয় সভ্যতাটাই তুলে দিলাম। ম্যানেজার আবার কী! আমরা সবাই রাজা। যিনি সবারে দেন মান, তিনিই তো আপনি ফিরে পান, অতএব, তুমি অন্যকে মাংস কিনে না খাওয়ালে, তুমিই বা পাতে তা পাবে কেন! বক্তব্য স্পষ্ট এবং সহজ। তোমার ‘জমার ঘর’ ফাঁকা আর অন্যের ‘খরচের ঘর’ ক্রমশ ভরে উঠলে, এক সন্ধেয় তা দেখে লজ্জা কি তুমি পাবে না, ও বন্ধু! মানুষ যে মানুষের জন্য ভূপেন হাজারিকা সে-কথা আর কতবার গেয়ে গেয়ে বোঝাবেন!
তবু এই জমা-খরচের হিসাবে কিছু গরমিল হয়েই যেত। মেসবাসীর হিসাবশাস্ত্র এমন কুটিল যে স্বয়ং কৌটিল্যও অনেক হিসাব করে তল পান না। অভিভাবকদের বিন্দুমাত্র দোষ ছিল না। তাঁরা খরচের টাকা হিসাব করেই পাঠাতেন, সময়ে কিংবা সময়ের আগেই। মেসে যারা থাকত, তাদেরও কি আর তছরুপের দায়ে ফেলা যায়! তবু কী করে যেন টাকা ভ্যানিস। অনেক হিসাব করে, ব্যক্তিগত খাতায় লিখে রেখেও কূলকিনারা মেলে না। আশ্চর্য উপায় বাতলে একজন ঠিক করল যে, সে রোজ একশো টাকা করে তুলবে। তাতে য’দিন চলে চলবে। তবু খরচের সেই এক্সট্রার হিসাব মেলেনি। সেদিন আমরা জানতাম না যে, আজীবন তা আর মিলবেই না। মাইনে আনতে মাস ফুরোয় জীবন একদিন অবশ্য বুঝে যায়, যতই মানী হোক মানিব্যাগ মানে কোনও কালেই এক ব্যাগ মানি নয়।
তবে আমরা তলিয়ে দেখেছি, এই খরচ না-মেলার ডাকাতি করত ফোনের সার্ভিস প্রোভাইডার। সেই বাজারে সেগুলো প্রত্যেকেই ভাত দেওয়ার ভাতার নয়, বিল বাড়ানোর গোঁসাই। এসটিডি বুথগুলো তখনও বহাল তবিয়তেই। কাচের ঘরে ঢুকে পড়ে রঞ্জনাকে বলে দেওয়াই যায়, আমি আর আসব না। গান তো আর ফোনের বিলের হিসাব রাখে না। যারা রাখে, বুথের বাইরে বসে, একবার তাদের দিকে আড়চোখে শুভদৃষ্টিতেই বোঝা যেত, এবার কেটে না-দিলে পকেটে বিপর্যয়। তা ছাড়া অন্য কেউ অপেক্ষা করছে বাইরে, লাইন দিয়ে। একজনের কথা শেষ হলে, আর একজন কথা সেরে নেবেন। অতএব তাঁকে অনন্ত অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রাখারও তো মানে হয় না। এসটিডি বুথ অনেক বেশি পাড়াতুতো। সে থাকতে থাকতেই আমাদের হাতে উঠল মোবাইল। যেমন ব্যক্তিগত, তেমনই মূর্খ বড়ো, সামাজিক নয়। অবশ্য সেদিন তাই-ই ছিল হাতে চাঁদ। পেয়ার কিয়া তো ডরনা কিয়া, হাতে আছে নোকিয়া। অতএব মিনিট কয়েকের কথা, তাও আবার লোকচক্ষু বাঁচিয়ে আর বাকি দিনরাত একবুক কথায় হাবুডুবু খাওয়ার দিনে ইতি। রাত বাকি, বাত বাকি, ফোনের বিলও বাকি। তখন সদ্য কল প্রতি এক টাকা নিরানব্বই পয়সার অচলায়তন ভাঙছে। কিন্তু ভাঙা কি আর সহজ ব্যাপার! কলরেট কমানোর আলাদা রিচার্জ করে তবে ফোন কোম্পানিকে বলা যে হুকুম তোমার ফলবে না হে! এর মধ্যে আবার রাতের নির্দিষ্ট সময়ে কথা বলার আলদা টপ-আপ। শ’খানেক এসএমএস জোটাতে আলাদা রিচার্জ। দিনকাল দ্রুত বদলাচ্ছে। সে সময় টকটাইমের হিসাব রাখতে না পারার অক্ষমতা আসলে সেই আঙুরফল টক।
মেসের খাতা তা বিলক্ষণ জানত। হিসাবের বাইরে যেটুকু প্রেমের কবিতা, তা লেখা থাকত না বটে। তবে জমার ঘরে শূন্যতার ভিতর ঢেউটুকু কারও অজানা ছিল না। মাঝেমধ্যে নিজেরা খাতা খুলে চমকেও উঠতাম। জমার যা বহর তাতে কপালে খাবার না জোটারই কথা। মেসে তবু উপোসের রীতি নেই। কেউ-না-কেউ খাইখরচ দিয়েই দেয়। পেট চলে যায়, মাস চলে যায়, পাতা উলটে গেলে ওলটানো গণেশকে আবার সোজা করার পালা।
এভাবেই চলে। হিসাব মিলে যায়। আমাদের ভালো থাকার ফুটপাথে একখানা ভালো রাখার হিসাবখাতা কোথাও না কোথাও ঠিক থেকেই যায়।