৬৬ খ্রিস্টাব্দে ইহুদিরা রোমের বিরুদ্ধে যখন বিদ্রোহ করল, তখনও একটা ধূমকেতু আকাশে নেচে এল। মনে করা হয় এটি হ্যালি হতে পারে। ব্যাটা পুরনো অপরাধী। জোসেফাস লেখেন এটি জেরুজালেম ধ্বংসের সংকেত। ৪৫১ খ্রিস্টাব্দে আবার ইউরোপে যুদ্ধ। বর্বর ও রোমানরা লড়ে পড়ল কাতালাউনিয়ান সমভূমি নিয়ে। সেবারেও একটা ধূমকেতু দেখা যায়। পাদ্রিরা বললেন, এটি রক্তপাতের সংকেত। যুক্তিটা ছিল– ধূমকেতু নাকি হাজিরই হয় এমন একটা মেন্টাল স্টেটে, যেখানে নিষ্ঠুর অপদেবতার মতো নীরবে সে হুংকার দেয়, ‘আমিই যুদ্ধ শুরু করেছি। আমিই সে দৃশ্য দেখতে এসেছি! বেশ করেছি।’
১৩.
ধূমকেতু। মহাকাশের সংসারে এক ভ্রাম্যমাণ যাযাবর। দেখতে তারার মতো ঝলমলে হলেও জিনিসটা গগনময় ধেয়ে বেড়ায় ঠিক যেমন দলবদলু রাজনীতিবিদরা ছুটে চলে অনবরত! শুধু তফাত হল, এই মহাজাগতিক দুষ্টুমি তার উজ্জ্বল লেজ নিয়ে অযাচিত ভাবে উদয় হয় নিজের খেয়ালেই। সেখানে কোনও আখের গোছানোর মামলা নেই, নেই কোনও ইডি, সিবিআই-র ভয়। কিন্তু মানব সভ্যতার যেহেতু সেলেস্টিয়াল সারপ্রাইজ পছন্দ হয়নি কোনও দিন, তাই দুম করে আসা ধূমকেতু জন্মলগ্ন ইস্তক অপয়ার প্রতীক। মেসোপটেমিয়ার কাদামাটির লেখক থেকে আমাদের ইন্টারনেট-প্রজন্ম পর্যন্ত এটি নিছক অলক্ষণের দূত। কিন্তু কেন? একটা বরফ আর ধুলোর টুকরো মানুষকে এত্ত ভয় পাওয়ায়? সে বেচারা তো শুধু সূর্যের চারপাশে ঘোরে যতক্ষণ না নিভে যায়। কিন্তু এই আয়ুকালেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের মানুষের মনে জ্বলে ওঠে সন্দেহ, আশঙ্কা, প্রশ্ন!
মেসোপটেমিয়ায়, খ্রিস্টপূর্ব ২৪০০-এ পুরোহিতরা আকাশের দিকে তাকিয়ে প্রথম ধূমকেতুটা দেখে ঘোষণা করেছিল– ‘ঈশ্বর ক্ষুব্ধ!’ তারপর মাটির ফলকে লিখে পাকাপাকিভাবে সার্টিফাই করল জিনিসটা অপয়া। কিন্তু কতটা অপয়া? অনেকটা! এর জন্য বিপর্যয় আসতে পারে, বন্যা হতে পারে, দুর্ভিক্ষ হতে পারে, হয়তো ডুমুরের ফুলও ফুটতে পারে ঘনঘন। অমঙ্গলের কথা আগাম জানানোর জন্য দেবতারা যেহেতু সরাসরি চিঠি পাঠাতে পারে না, তাই ধূমকেতুর মতো আতশবাজি পাঠায়। আর মানুষও এই বিশ্বাস শতাব্দী ধরে চালিয়ে যায়, কেবল ধূমকেতু বাবাজি ঠাওর করতে পারে না, তাকে দেখলেই সকলে এত চটছে কেন?
খ্রিস্টপূর্ব ১১৪৫-তে, চিনের শাং রাজবংশের হাড়ে লেখা আছে– ‘ঝাড়ু নক্ষত্র’ সমৃদ্ধি ঝেটিয়ে বিদায় করে। সুসময়কে উড়িয়ে দেয় ধুলোর মতো। সম্রাট চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়ে উদাসীন চোখে ভাবেন রাজবংশ শেষ হবে তবে। ধূমকেতু হাজির হলে কিন্তু জ্যোতিষীদের পোয়া বারো। তাদের ভবিষ্যদ্বাণী ভুল হলে তারা আকাশের এই আচমকা দস্যুকে দায়ী করায় সুযোগ পান ফ্রি-তে। রাজার রক্তচক্ষু থেকে নিজেদের বাঁচাতে ঝাড়ু নক্ষত্রের বেয়াদব লেজ ধরে পার পেয়ে যান মানে মানে।
রোমে আবার এটি বিশ্বাসঘাতকতার নাটক। সিজারের ধূমকেতু যখন ঝলমল করে উঠল, জুলিয়াস সিজার ছুরির আঘাতে মারা গেলেন। জনতা, যে হামেশাই তামাশা দেখতে চায়, তর্ক জুড়ে দিল– এটি কি সিজারের আত্মার দেবত্ব প্রাপ্তি নাকি রোমের খারাপ দিনের সংকেত? ক’দিনেই বিশৃঙ্খলতার চোটে প্রজাতন্ত্রের ডুগডুগি বাজে আর ধূমকেতু পায় দোষ। ঠিক যেন মার্চের ইডস্ পরিকল্পনা করে জিনিসটাকে আকাশ থেকে পাঠিয়েছে!
৬৬ খ্রিস্টাব্দে ইহুদিরা রোমের বিরুদ্ধে যখন বিদ্রোহ করল, তখনও একটা ধূমকেতু আকাশে নেচে এল। মনে করা হয় এটি হ্যালি হতে পারে। ব্যাটা পুরনো অপরাধী। জোসেফাস লেখেন, এটি জেরুজালেম ধ্বংসের সংকেত। ৪৫১ খ্রিস্টাব্দে আবার ইউরোপে যুদ্ধ। বর্বর ও রোমানরা লড়ে পড়ল কাতালাউনিয়ান সমভূমি নিয়ে। সেবারেও একটা ধূমকেতু দেখা যায়। পাদ্রিরা বললেন, এটি রক্তপাতের সংকেত। যুক্তিটা ছিল– ধূমকেতু নাকি হাজিরই হয় এমন একটা মেন্টাল স্টেটে, যেখানে নিষ্ঠুর অপদেবতার মতো নীরবে সে হুংকার দেয়, ‘আমিই যুদ্ধ শুরু করেছি। আমিই সে দৃশ্য দেখতে এসেছি! বেশ করেছি।’ লেখকরা তাই এটিকে অশুভ বলবে না তো কী করবে?
৬৮৪ খ্রিস্টাব্দের জাপানে নিহোন শোকি লেখেন একটি ধূমকেতু যখন আসে তখন ধরেই নিতে হবে রাজনৈতিক ঝগড়া শুরু হল বলে। চিন-প্রভাবিত জ্যোতিষশাস্ত্র আবার এটিকে উচ্ছেদের নোটিশ হিসেবে দাগিয়ে দিল। ধূমকেতু কিন্তু ঘুণাক্ষরেও জাপানি রাজনীতিতে আগ্রহী ছিল না। কিন্তু বেচারার টাইমিং-সেন্স অপূর্ব। ঠিক যেন অভ্যুত্থানের সঙ্গে এসেছে। তাই দরবারিরা নিজেদের অপশাসনের দোষ দেয় না, তারা ধূমকেতুকে দায়ী করে।
১০৬৬ খ্রিস্টাব্দে শালা বলা নেই কওয়া নেই, হ্যালি আবার ফিরে এল। তাও আবার ইংল্যান্ডের আকাশে। অ্যাংলো-স্যাক্সন ক্রনিকল গম্ভীর। কি না, রাজা হ্যারল্ড দ্বিতীয়র জন্য ব্যাপারটা ঘোর অপয়া আর বলতে বলতে তিনি হ্যাস্টিংসে তীরের শিকার হন। প্রায় ৫০০ বছর পেরতে না পেরতেই ১৫৭৭ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে হইচই। তিচো ব্রাহে ধূমকেতু দেখেন, তাই জনতা তটস্থ। ক্রমেই ঘনিয়ে এল ইংল্যান্ডে স্প্যানিশ আক্রমণের ভয়। জার্মানিতে বেদম যুদ্ধ। ধূমকেতু দুটোর জন্য দায়ী হল।
১৬৬৪ খ্রিস্টাব্দের লন্ডনে ফের একটা ধূমকেতু এল। সঙ্গে নিয়ে এল মহামারী আর মহাঅগ্নিকাণ্ড। ইংরেজরা নাটকীয় ভঙ্গিতে চেঁচাল, ‘এই তো ঈশ্বরের সংকেত। এটি মৃত্যু ও আগুনের ঘোষণা।’ স্যামুয়েল পেপিস লেখেন ধূমকেতু আর কিচ্ছু নয় কেবল একটা বরফের পাথর। কিন্তু কে শোনে কার কথা? আতঙ্কিত জনতা বলল, ‘মাজাকি হচ্ছে? বরফে কখনও আগুন ধরে? এটাই আসল নাটের গুরু, সকল বিপর্যয়ের জন্য দোষী।’
১৬৮০ সালে একখানা মহা ধূমকেতু আসে। এটির লেজ উজ্জ্বল, এমনকী কোহিনুরের লোভের চেয়েও উজ্জ্বল। তার রোশনাই আলোকিত করে তুলল ইউরোপে অটোমান আক্রমণের ভয়, আমেরিকায় গুটিবসন্ত, ভারতে মুঘল পতন। ধূমকেতু এসব দোষের দোষী। বিশ্বব্যাপী অন্ধবিশ্বাসের কাঠগড়ায় তাকে কেউ একটা সুযোগও দিল না আত্মপক্ষ সমর্থনের। দিলে হয়তো সে বলত ‘মাই লর্ড, আমি মহাশূন্যের বরফের গোলা, মানব সভ্যতার ব্লেম গেম এর খেলনা নই।’
১৮৩৫ সালে হ্যালি যখন আবার ফিরে আসে, তখন বিজ্ঞান পার্টি নষ্ট করে কুসংস্কারের। এডমন্ড হ্যালি কমেটের কক্ষপথ ব্যাখ্যা করেন। ১৯১০ সালে পৃথিবী জানতে পারে, হ্যালির লেজে সায়ানোজেন গ্যাস আছে। ফের ঝামেলা। সংবাদপত্র চিৎকার করে উঠল ‘বিষ!’ নিউ ইয়র্ক থেকে দিল্লি আতঙ্ক সামলাতে না সামলাতেই মেক্সিকোতে বিপ্লব। ভারতে ঔপনিবেশিক অশান্তি। এবং ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগেও আবার একটা ধূমকেতু। ব্যস, আর দেখে কে? অপয়ার আখ্যান হয়ে উঠল ন্যায্য।
১৯৯৭ সালে হেল-বপ ধূমকেতু যখন এল, সেটা দেখতে এতটাই মনোহর ছিল যে সারা বিশ্ব উঠল চমকে। কিন্তু হেভেন্স গেট সম্প্রদায় ছাড়ল না তাকেও, শেষের সংকেত বলে দাবি করে বসল। বিজ্ঞান বেচারা ধূমকেতুর পাশে দাঁড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু হলে হবে কি, ধূমকেতুর তো কপালটাই পোড়া! আসবি তো আয় ২০২০ সালেই ফের আসতে হল নিওয়াইজ কমেটকে। সঙ্গে এল কোভিড অতিমারী! নেটিজেনদের একাংশ ডালগোনা কফি বানাতে বানাতে বিশ্ব অশান্তির জন্য দায়ী করল তাকে আর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা মুগ্ধ হয়ে দেখলেন একবিংশ শতাব্দীর অশিক্ষা।
এবার ধূমকেতুও ক্লান্ত। অপয়ার অপবাদ বইতে বইতে সে পোড়া মিল্কিওয়ে ছেড়ে চলে যেতে চায় শান্ত কোনও গ্যালাক্সিতে। যেখানে নালক গল্পের ঋষিরা থাকেন। যাঁরা তাঁকে দেখামাত্রই পুলকিত হবেন আর প্রণাম করে বলবেন– নিশ্চয় কোনও মহাপুরুষ জন্মালেন, কপিলাবস্তু বা অন্য কোথাও।
……………..অপয়ার ছন্দ অন্যান্য পর্ব……………..
পর্ব ১১। শুধু একটা হ্যাঁচ্চো– বলে দেবে কীভাবে বাঁচছ
পর্ব ১০। অপয়ার ছেলে কাঁচকলা পেলে
পর্ব ৯। চোখের নাচন– কখনও কমেডি, কখনও ট্র্যাজেডি!
পর্ব ৮। জুতো উল্টো অবস্থায় আবিষ্কার হলে অনেক বাড়িতেই রক্ষে নেই!
পর্ব ৭। জগৎ-সংসার অন্ধ করা ভালোবাসার ম্যাজিক অপয়া কেন হবে!
পর্ব ৬। প্রেম সেই ম্যাজিক, যেখানে পিছুডাক অপয়া নয়
পর্ব ৫। ডানা ভাঙা একটি শালিখ হৃদয়ের দাবি রাখো
পর্ব ৪। জন্মগত দুর্দশা যাদের নিত্যসঙ্গী, ভাঙা আয়নায় ভাগ্যবদল তাদের কাছে বিলাসিতা
পর্ব ৩। পশ্চিম যা বলে বলুক, আমাদের দেশে ১৩ কিন্তু মৃত্যু নয়, বরং জীবনের কথা বলে
পর্ব ২। শনি ঠাকুর কি মেহনতি জনতার দেবতা?
পর্ব ১। পান্নার মতো চোখ, কান্নার মতো নরম, একা
আজ ১৩ ফেব্রুয়ারি। ৩৯ বছর আগে জিয়ার স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে ইকবাল বানো নিষিদ্ধ কালো শাড়ি পরে মঞ্চে ওঠেন, ৫০,০০০ মানুষের সামনে গান ‘হাম দেখেঙ্গে’। রাতারাতি নিষিদ্ধ হন তিনি। তাতে কী? ততক্ষণে জেগে উঠেছে জনতা। রাষ্ট্রের নজরদারি এড়িয়ে সেই গানের রেকর্ডিং মুহূর্তে ছড়িয়ে দেওয়া হয়।